পিছিয়ে যাচ্ছো, পালিয়ে যাচ্ছো, কাদের থেকে?

আর্যতীর্থ
অবশেষে ছুটি হলো তাঁর। টানা আঠেরো দিন পরে, যুদ্ধ করেননি বটে, কিন্ত ছিলেন পুরো যুদ্ধের ভিতরে, সৌজন্যে কৃষ্ণদ্বৈপায়ণব্যাস। রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কোন কুক্ষণে, এ রক্তক্ষয়ী যুূ্দ্ধ দেখার সাধ হয়েছিলো মনে, আজও বোঝেন নি সঞ্জয়; যুদ্ধে নিহত তাঁর একশো তনয়, আত্মীয় পরিজন সব, টিমটিম করে জ্বলে পাঁচ পাণ্ডব। আঠারোটা দিন ধরে দিয়ে অনর্গল ধারাবিবরণ, অবশেষে সঞ্জয় মুক্ত এখন। শেষ একবার, দেখে নিতে চান নিজের দু চোখে, এতদিন শুধু দিব্যদৃষ্টিতে দেখা সেই কুরুক্ষেত্রকে। সে মাঠে দাঁড়িয়ে সঞ্জয় দেখেন শুধু ভেজা নিরীহ ঘাস, রক্তের ভ্রম নিয়ে ছড়ানো ছেটানো কিছু অশোক পলাশ, এই ভূমি? এই ভূমি? এখানেই যুঝেছিলো প্রাণপণ রথী মহারথী, অযুত সেনানী? শূন্য প্রান্তর খালি, সময় খেয়েছে গিলে আঠারো অক্ষৌহিনী। সত্যি কি হয়েছিলো, নাকি কল্পনা শুধু? মৌনগোধূলিতে ম্লান একা সঞ্জয়, হঠাৎ চমকে দিয়ে এক স্বর বলে ওঠে, ' বোঝো আগে, তবে যাবে পুরো সংশয়' 'কি বুঝবো? 'সপ্রশ্ন দৃষ্টিপাত সে স্বরের উৎস সন্ধানে, কাউকে যায় না দেখা, শুধু স্বর বলে চলে, 'বুঝে নাও কাহিনীর রূপকের মানে।' 'রূপক? ''রূপকই তো, তোমার ইন্দ্রিয়, পাঁচখানা ভাই তাঁরা, পঞ্চপাণ্ডব, লোভ, লালসা আর কাম ক্রোধ যত, শত শত রোজ ছুটে আসে কৌরব। কৃষ্ণ আত্মা তোমার, অমৃত যে আলো জ্বলে সবার অন্তরে, সে যদি সারথি থাকে, উপায় কি কৌরব কোনো ক্ষতি করে?' দৃশ্যত অভিভূত হন সঞ্জয়, তবু সন্দেহ কিছু কূট হয়ে জ্বলে 'ভীষ্ম দ্রোণ কৃপাচার্য, তাঁরা কেন যোগ দেন কৌরবের দলে?' 'সঠিক প্রশ্ন বটে, বয়োজ্যেষ্ঠ যাঁরা, ছেড়ে যান যদি তাঁরা সত্যের পথ, তবে তাঁরা কৌরবের দলে। তাঁদের ওপর দিয়ে যাবে জীবনের রথ।' 'তাহলে কর্ণ? তাঁর কি ভূমিকা এই কাহিনীতে তবে? কৌন্তেয় হয়েও তো তিনি প্রধান শক্তি কৌরবে!' 'কর্ণ বাসনা তোমার, ইন্দ্রিয়দের সে সহোদর ভ্রাতা, স্বভাবত, পাপেদের সাথে তাঁর ভারী সখ্যতা।' 'বুঝলাম কিছু কিছু', বলেন সঞ্জয়, 'একটি শুধু মনে রয়ে গেছে সংশয়।' এ কাহিনীতে কি ভূমিকায় আছেন দ্রুপদকন্যা, রাণী যাজ্ঞসেনী? ' 'তিনি প্রতিবাদ। পাপের বিরুদ্ধে যিনি ওঠান আওয়াজ জেনে রেখো তাঁর নাম দ্রুপদনন্দিনী।' সঞ্জয় নির্বাক। 'সবই রূপক তবে! কে আপনি মহাজীবন, আমাকে পড়ান এই ভারতের পাঠ?' কেউ কোত্থাও নেই, সন্ধ্যার আঁধার এসে ধীরে ধীরে ঢেকে দেয় যুদ্ধের মাঠ।

গোলাপী আভার সর্বনাশে
কতোদিন পেরিয়ে যায়, দিন মাস, বছর, শতাব্দী.. প্রেমিকা বসে থাকে অপেক্ষায়। কতোদিন জড়িয়ে ধরা হয়না, কতোদিন গালে হাত রেখে হাতের উষ্ণতা নেয়া হয়না.. কতোদিন বুকের মাঝে খুব আদরে লুকিয়ে যাওয়া হয়না। কতোদিন চুলের মধ্যে কেউ লুকিয়ে পড়েনা, কতোদিন পিঠের চুল সরিয়ে কেউ চুমু আঁকেনা। কতোদিন চিবুক আলতো করে স্পর্শ করে কেউ বলেনা, এটা এতো সুন্দর! কতোদিন প্রেমিকার চোখে ভালোবাসা দেখা যায়না! এখন প্রেমিক ঘেমে যায়, শার্টের হাতায় ঘাম মোছে, ঘাম মোছে বেশ্যার ব্লাউজে। পুবের আকাশ ঘোলা হয়, প্রেমিকার শাড়ী নীলচে থেকে লালচে হয়, বেশ্যার শাড়ি বিছানার কোণে অলস পড়ে রয়। কতোদিন যায়! কতো সহস্র দিন! প্রেমিক বেশ্যার বুকে শান্তি খুঁজে ন্যায়! কতোদিন প্রেমিকা ভালোবাসেনা...

নির্বাসন
চূড়ান্ত সঙ্গম করে কুকুরেরা। সমসাময়িক নগরে, বৃষ্টির দিনে, নরনারী পুত্রার্থে ধেয়ায় দোতলার লাল মেজে হাঁটুতে বিস্তৃত করে বল অভ্যাসবশত মদ্যপান হয় রতিক্রিয়া-শেষে। এ-বছর শীতকালে কলকাতায় মৌসুমী-শিল্পের প্রদর্শনী হয়েছিলো, ডালিয়ার চন্দ্রমল্লিকার আখাম্বা গতর কেড়ে নিয়েছিলো আদি পুরস্কার কুচ্চ্কাওয়াজ-অন্তে গাইলো পুলিশেও রবীন্দ্রসঙ্গীত ! তবু ন্যূনতম কিছু কবিতাও লেখা হতে থাকে ‘প্রতিপ্রাপকতা’ নাম্নী শব্দ নিয়ে করে না তোলপাড় এইসব লেখকেরা। এইসব লেখকেরা, হায় বেশ্যার নিকটে গিয়ে বলিল না, সম্ভ্রম উঠাও দেখি হে তদ্বির-ভরা দেহখানি—কিংবা কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলে পাবে পুরুষানুক্রম যজমানি!

অথচ চলে গেলে
কীভাবে কীভাবে হবে? যা হয়ে চলেছে, তারও পরে কিছু অসমান কাজ ছেঁড়া-পোস্টারের মতো লুটায় দেয়ালে, খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে আসে নিমগ্ন যুবক— এখন কোথায় কাজ শুরু হবে? এই গোলমালে কিছু কি শান্তভাবে করা যায়? অথচ এখুনি আঙুরলতার মতো উঠে আসে আচ্ছন্ন সময়, আধো-কুয়াশার দিকে চলে যায় মানুষ-মানুষী; বেঁচে থাকবার কাজ এগিয়ে-পিছিয়ে একঠায় এখন স্তব্ধ হয়ে থেমে গেছে। যদি না কখনও সরল জলের মতো জেগে ওঠে আরব্ধ হৃদয় তা হলে কেমন করে খেলা হবে? কীভাবে, কোথায় এক মানুষের সঙ্গে আরেক মানুষ যাবে পথের ওপরে?