রঙ্গবতী

image

একটি বালিকা কেঁদেই যাচ্ছে অফুরান। গণপতিবাসে দুইজন দাসী তাকে শান্ত করতে পারছে না। সম্প্রতি এই বালিকাকে তার মাতা পিতার থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তাদের দাস করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, দূর অরণ্যে। সেখানে বৃক্ষ নিধন করে কৃষিযোগ্য ভূমি উদ্ধার করবার জন্য। কান্নার রব শুনে গণপতির পুত্র কিশোর অনঙ্গ আসে তার কাছে। বালিকার ক্রন্দনের কারণ জানতে চায় দাসীদের কাছে। দাসীগণ তাকে সবকিছু বলে। তখন সে নিজের মাতার কাছে যায়। ‘আমরা এতই নির্দয় যে এক বালিকাকে তার মাতা পিতার থেকে বিচ্ছিন্ন করেছি? ছিঃ!’ তার মাতা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাকে শান্ত করা সম্ভব হয় না। এর পর থেকে সে বালিকাটিকে চোখে চোখে রাখে। সেই বালিকা সেই গণপতিগৃহে বড় হতে থাকে। দুজন দুজনকে সখ্যের চোখে দেখে। দুঃখের স্মৃতি ক্রমে ম্লান হয়ে আসে। তারপর দিন কেটে যায়, বহুদিন, সেই বালিকা বড় হয়ে যায় একদিন।

ভদ্রাসনে সাজ সাজ রব। স্বয়ং মহারাজ পদধূলি দেবেন সায়ংকালে। নগরনটী রঙ্গবতী চিন্তিত আবার আনন্দিতও। কিছুদিন আগেই গণপতি অহিছত্রের রাজকন্যার পাণিগ্রহণ করেছেন। এ’টি মহারাজের চতুর্থ বিবাহ। তাহলে কি নারীর সাহচর্য নয়, অন্য কোনও উদ্দেশ্য? রঙ্গবতী ভাবে। আবার মহারাজ অনন্তনাগ তেমনভাবে মহারাজ নন। তাকে মহারাজ বলে সম্ভাষণ করা হয় বটে, সেটাও ভালবেসে। আসলে তিনি বেশনগরীর গণসংস্থার পুরস্কর্তা। সাধারণত পদটি বংশানুক্রমিক নয়, গণসংঘের দ্বারা নির্বাচিত প্রমুখ। তবু অনন্তনাগ তার পিতার আসনে বসেছেন আপন গরিমায়। নিজ বুদ্ধি ও শৌর্যবলে। গণসংস্থাই তাকে নির্বাচিত করেছে। ভাবনায় ছেদ পরে, পরিচারিকা এসে বলে স্নানের প্রস্তুতি সারা। বেলাও গড়িয়েছে। ইদানীং নগরে জলাভাব দেখা দিয়েছে। পুর্বের মত প্রাচুর্য নেই। হিসেব করে চলতে হয়। তবে নগরনটী বলে তার বিশেষ বরাদ্দ। রাজোদ্যান ব্যতীত ফুলবাগিচাগুলি জলের অভাবে শুষ্ক। এমনটা দশ বছর আগেও ছিল না। সে এই নগরে আসে সেই সময়, বিজিত রাজ্যের ক্রীতদাসী রূপে। সুন্দরী বলে তাকে আলাদা করে ফেলা হয় রাজপুরোহিতের নির্দেশে। আর তার মাতা পিতাকে নিযুক্ত করা হয় কৃষিশ্রমে, দূরে অরণ্যসঙ্কুল স্থানে। সেখানে নাকি অরণ্যসংহার করে চাষাবাদ শুরু হবে। অরন্যবাসী মানুষদেরও ক্রীতদাস করা হয়েছে। শুধু তফাৎ, তারা নিজভূমে দাস। বর্তমান মহারাজ তখন তরুণ যুবরাজ।

জলের প্রার্থনায় বহু যাগযজ্ঞ হয়েছে। ভাণ্ড ভাণ্ড ঘৃত আর সমিধ অগ্নিতে সমর্পিত হয়েছে। পুরোহিতগণ স্বর্ণ, রৌপ্য, গোধন নিয়ে আপন আপন গৃহে ফিরে গিয়েছেন। জলাভাব আরও তীব্র হয়েছে। রাজপুরোহিত বিশেষ চিন্তিত। জলের উপায় চাই সত্বর, নতুবা রাজধানীর অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে ভবিষ্যতে। মহামন্ত্রীর নির্দেশে রাজ অবরোধ সন্নিকট ছাড়া কোথাও আর পথ প্রক্ষালন হয় না। অবশ্য বাকি জাঁকজমক একইরকম আছে। যবন বণিকগন ইদানীং নগরে আগমন করছে। তারা কেউ কেউ যবন ক্রিতদাসীও বিক্রয় করে। কৃষ্ণবর্ণ নাগবণিকরা, বিশেষ করে অগ্রোদকা (আগ্রা) বা মথুরার, তদের বিশেষ প্রিয় এইসকল শ্বেতবর্ণা যবন ক্রীতদাসী।

নগর প্রাকারে অদূরে মহাকালের মন্দির। সেখানে নাগরিকগণ প্রার্থনা করে, জলের আশায়। গঙ্গাধর নিজেই অসহায়। প্রখর সূর্য মাথায় নিয়ে সেখানে এসে দাঁড়ালেন প্রবীণ গণমুখ্য ত্রিবিক্রম। বৃষ্টির প্রার্থনা নিয়ে এসেছেন তিনি মহাকালের চরণে। জল চাই, জল দাও গংগেশ্বর! আকূল প্রার্থনা করেন ত্রিবিক্রম। মহাকাল নিরুত্তর। স্খলিতপদে নিজগৃহে ফেরেন ত্রিবিক্রম। কপালে চিন্তার ভাঁজ। এ নগরের সাথে তার আশৈশব পরিচয়। তার পিতাও মহামন্ত্রী ছিলেন। পরিচারিকারা স্নানে সাহায্য করলে, স্নান সমাপ্ত হোল রঙ্গবতীর। স্নান হোল বটে, তবে মন ভরলো না। কতদিন অবগাহন স্নান করা হয় নি। নদীর জলে সাঁতার কেটে স্নান বড় প্রিয় রঙ্গবতীর। কিশোরীবেলায় সে ঘন ঘনই নদীতে যেত। এখন নগরনটীর তা বারণ। পুরোহিতের আজ্ঞা আর তার যুবতী শরীর। নগরনটী হলেও সে শুধু বিত্তবান শ্রেষ্ঠী আর রাজপুরুষদের ভোগ্যা, কখনও বা রাজভোগ্যা। কখনও জনসাধারণের নয়। স্নানান্তে আহারে বসলো রঙ্গবতী। স্বল্পাহারী সে, আর দ্বিপ্রাহরিক আহার বলে যবচূর্ণের রোটিকা, সামান্য পশুমাংস আর দধি। সাথে অবশ্যই ফল। আহারান্তে বিশ্রাম।

যে কয়েকটি গোষ্ঠী উত্তরের দিক থেকে ধীরে ধীরে দক্ষিণের দিকে ছড়িয়ে পরেছিল, তাদের অন্যতম হোল ভৃগু ও পরশুরামের গোষ্ঠী। এই উত্তরের গোষ্ঠীগুলি যদিও মূলত পশুপালক, তবু প্রজন্মের পর প্রজন্মের যাত্রাপথে আরও বিশেষ কিছু বিদ্যা তারা অর্জন করেছিল। এই গোষ্ঠীগুলি দূর পশ্চিমে পারস্য দেশ থেকে অথবা হিমালয়ে উত্তরে ইলাবৃতবর্ষ থেকে আগত হতে পারে। অথবা এমনও শোনা যায় যে, তারা প্রথমে পারস্যে এসেছিল, তারপর পুর্বে গাঙ্গেয় দোয়াবে। তারপর একদিন দক্ষিণে যাত্রা করেছিল। অগস্ত্য গোষ্ঠীর মানুষেরা ছিলেন জ্ঞান অন্বেষক। শত শত বছরের দীর্ঘ যাত্রায় তারা চিকিৎসা, ওষধি, নদীবিদ্যা, জলসেচ ও শব্দবিজ্ঞান বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। তারা পশুপালনের উত্তরাধিকার বহন করলেও, ধীরে ধীরে তারা তাদের নূতন জ্ঞানের চর্চাতেই মনোনিবেশ করেন। বিশেষ করে চিকিৎসাশাস্ত্রে ও ভাষা বিজ্ঞানে। এই অগস্ত্য গোষ্ঠী সমগ্র মধ্যদেশ ও বিন্ধ্য অতিক্রম করে দক্ষিণে সাগরতট পর্যন্ত পরিব্যপ্ত হয়। তাদের কল্যাণে স্থানীয় মানুষেরা সবিশেষ উপকৃত হতে থাকে। দক্ষিণের মানুষের ব্যবহৃত শব্দাবলী ও উত্তরের শব্দের মেলবন্ধন করে তারা দক্ষিণে তামিল ভাষার জন্ম দেন, সেই ভাষার ব্যাকরণ রচনা করেন। স্বভাবতই, সমগ্র মধ্যদেশ, কলিঙ্গ, কর্ণাট, কাঞ্চী, সৌরাষ্ট্রে তারা আদরণীয় ও পুজিত হয়। এই গোষ্ঠীর এক পুরুষ, অগস্ত্য, বিদর্ভের রাজকন্যা লোপামুদ্রাকে বিবাহ করেন। এর ফলে দুই জনগোষ্ঠীর বৈবাহিক সম্পর্কের হেতু মেলবন্ধন আরও দৃঢ় হয়। এই অগস্ত্য গোষ্ঠী ছিল শিবের পূজারী। এই গোষ্ঠীই সমগ্র দাক্ষিণাত্যে শৈবধর্মের প্রসার ঘটায়।

আর ভৃগুবংশীরা আচরণে অগস্ত্যগণের বিপরীত। তারা ছিল যুদ্ধপ্রিয়, পশুপালক ও শস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী। ধাতু নিষ্কাসনে তারা এতটাই পটু ছিল যে, তারা নিজের অস্ত্র ও শস্ত্রবিদ্যার শক্তিতে অপ্রতিরোধ্য সমরপটু গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল। যদিও গোপালন ছিল তাদের মূল সম্পদ। গোপালনের সাথে সাথে তারা কৃষিকাজে মনোনিবেশ করে। এবং ধীরে ধীরে সম্পদশালী গোষ্ঠীতে পরিণত হয় আর ক্ষমতাশালী হয়। সেই সময় মধ্যদেশে মাহিষ্যতীর রাজা ছিলেন হৈহেয়বংশীয় কার্ত্যবীর্য্য অর্জুন। প্রচণ্ড প্রতাপশালী ও বীর ছিলেন এই অর্জুন। কৃষি ও পশুপালনের অধিকার নিয়ে ভৃগু গোষ্ঠী ও হৈহেয়গণের মধ্যে বৈরিতা উৎপন্ন হয়। প্রথমে ভৃগুবংশীয় জামদগ্নি অর্জুনের পুত্রদের হাতে নিহত হলে, জামদগ্নির পুত্র পরশুরাম অর্জুনের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। শস্ত্রবিদ্যায় পারঙ্গম পরশুরাম কার্ত্যবীর্য অর্জুনকে পরাজিত ও হত্যা করেন। এই পরশুরাম ছিলেন বৈষ্ণব। তার অস্ত্র ছিল কুঠার। সে কুঠার যেমন যুদ্ধের অস্ত্র ছিল, তেমনই অরণ্যনিধনে ছিল প্রধান হাতিয়ার। স্বভাবতইসকল অরণ্যবাসী গোষ্ঠী তাদের ঘৃণার চোখে দেখত। ফলে বৈষ্ণবদের প্রতি ছিল তাদের সন্দেহ। তা ছাড়াও বিষ্ণুর বিবিধ অবতার রাম, পরশুরাম, কৃষ্ণ সকলেই ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী, পররাজ্যগ্রাসী।

গণপতি অনঙ্গনাগ চিন্তিত, কিছুটা বিভ্রান্ত। গুপ্তপুরুষ যে সংবাদ এনেছে, তা যথেষ্ট ভাবনার কারণ। ত্রিবিক্রমের পরামর্শে গণপতি অনঙ্গের নগরনটী রঙ্গবতীকে প্রয়োজন। তাই আজ রঙ্গবতীর আলয়ে মহারাজ নিজে যাবেন। পরিকল্পনাটি বারবার নিজের মনে সাজিয়ে নিচ্ছেন অনঙ্গ। কোনও প্রকারেই ব্যর্থ হতে দিলে চলবে না। এক জটিল রাজনৈতিক পরিকল্পনায় রঙ্গবতী ক্রীড়নক মাত্র, কিন্তু খুব মুল্যবান ক্রীড়নক। মহারাজ অনঙ্গ ভাবেন।

বেশনগরে কিছুদূরে কাকোনাদবোট (সাঁচি) মহাবিহার। সেখানে প্রায় পঞ্চশতাধিক বৌদ্ধ ভিক্ষুর বাস। নাগগণ মনে করে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বৌদ্ধগণ ও জৈনরা গণব্যবস্থার অনুকূল। মধ্যদেশে বৌদ্ধরা বেশ প্রভাবশালী। তারা সরাসরি শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করেন না, তাকে প্রত্যক্ষ প্রভাবিতও করেন না। তবে শ্রেষ্ঠীসমাজে তারা প্রভাবশালী। এই সহাবস্থানের কারণে তাদের মূল্যও দিতে হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে তাদের বুদ্ধের আদর্শ থেকে সরেও আস্তে হয়েছে, শ্রেষ্ঠীদের অভিপ্রায়ে। তবুও তাদের মধ্যে বর্ণভেদ নেই, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ন্যায় তারা ক্ষমতালিপ্সুও নন। তারা যুদ্ধবাজ নন, শান্তিকামী।

সূর্যের তেজ প্রশমিত হয়েছে। এখন প্রসাধনের সময়। দাসীরা সাজাতে বসে রঙ্গবতীকে। মহারাজের আদেশে রাজভান্ডার থেকে বিবিধ উপঢৌকন এসেছে। তার মধ্যে মহার্ঘ্য রেশম বস্ত্র আছে, আছে বিবিধ প্রসাধনী, অলক্তক, ও রত্নাভরণ। আর আছে শুস্কফল ও মদিরা। ময়ূরমাংস ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য। বেশভূষা সম্পূর্ণ হতে সময় লাগলো। দীর্ঘ বেণী, স্ফীত বক্ষে রত্নশোভিত কাঁচুলি, রেশমবস্ত্র, অঙ্গে বিবিধ রত্নের বলয়, হার, কেয়ূর, পাশ, নূপুর আর গলায় পুষ্পমালা। দেহে চন্দনলেপ। নগরনটী রঙ্গবতী প্রস্তুত। গৃহদ্বারে মশাল জ্বলে উঠলো। সেই সময় মহারাজের ভাট এলেন অনঙ্গের আগমনবার্তা নিয়ে। মহারাজপদে অভিষিক্ত হবার পর, এই প্রথম রংগবতীর সাথে অনঙ্গের সাক্ষাৎ। রঙ্গবতী শঙ্কিত চিত্তে অপেক্ষা করে। অকস্মাৎ মহারাজ অনঙ্গ তার গৃহে আসছেন কেন? বিগত দুই বছরে তো গণপতি একবারও রঙ্গবতীর নিলয়ে পদার্পণ করেন নি! তবে কেন আজ অকস্মাৎ তার আগমন। রঙ্গবতীর ওষ্ঠ অভিমানে স্ফুরিত হয়। সে নিজেকে সংযত করে। নানা ভাবনার মধ্যেও রঙ্গবতী স্বয়ং এসে দাঁড়ায় গৃহদ্বারে, মহারাজকে অভ্যর্থনা করার জন্য নগরনটির বিলোলহাস্যে।।

বেশনগর নগরীটি খুবই সুরম্য। পুর্বদিকে প্রবাহিত বেত্রবতী নদী দক্ষিণের বিন্ধ্যপর্বত থেকে বয়ে যায় উত্তরে। শেষে মথুরা রাজ্যে যমুনার সাথে মিলিত হয়। এইভাবে বিন্ধ্যের বারি প্রয়াগে ত্রিসঙ্গমে সমর্পিত হয়। বেশনগরের অদূরে প্রাচীন নগরী কাকোনাদবোটে প্রখ্যাত বৌদ্ধবিহার আর আছে একটি সুদীর্ঘ স্তম্ভ। শোনা যায় যবনসম্রাট অলোকসুন্দরের রাজদূত তার আগমনের স্মারক হিসেবে এ’টি নির্মাণ করেন। বেশনগর অত্যন্ত প্রাচীন নগরী। সে আগে ভদ্রাবতী নামে পরিচিত ছিল। কথিত আছে রাজা রুক্মাঙ্গদ নিজ রানীকে প্রত্যাখ্যান করে অপ্সরা ভিষ্যাকে বরণ করেন। তার নামেই নগরীর নাম হয় ভিষ্যানগর। কালক্রমে ভিষ্যানগর লোকমুখে বেশনগরে পরিণত হয়েছে। আরও শোনা যায়, এই নগরীর রাজা যুবনাশ্ব সম্রাট যুধিষ্ঠিরকে তার অশ্বমেধ যজ্ঞের জন্য শ্বেতঅশ্বটি দান করেছিলেন। অশোক যখন তার পিতা বিন্দুসারের নির্দেশে উজ্জয়িনী নগরীতে সম্রাটের প্রতিনিধি হয়ে অবস্থান করছেন, তখন এই বেশনগরের এক শাক্যবংশীয় শ্রেষ্ঠীর কন্যার প্রতি আসক্ত হন। তিনি সেই কন্যাকে বিবাহ করেন। যদিও অশোক সম্রাট হবার পরে আরও অনেক বিবাহ করেছিলেন, তবু ওই শ্রেষ্ঠীকন্যা, বিদিশাই তার প্রধানা মহিষী হন। তার পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সঙ্ঘমিত্রা বুদ্ধের বানী আর বোধিবৃক্ষের শাখা নিয়ে সিংহলে গমন করেন। এই বেশনগরের প্রতিটি সরণি, প্রতিটি উপলে আছে কত শত গল্প, লোককথা!

পরিবর্তনের কি বিচিত্র গতি! অরণ্যবাসী নিষাদগণ যখন শুধুমাত্র শিকার পরিত্যাগ করে বন কেটে চাষাবাদ শুরু করল, তাদের সমাজজীবন গেল পালটে। আদিম কৌমসমাজ থেকে পরিবার আর সমাজ তৈরি করল তারা। সমাজের সম্পদ বৃদ্ধি হলে ভূমিখণ্ডের ওপর অধিকার কায়েম করতে চাইল, আপন শক্তিবলে তারা তাদের রাজত্ব স্থাপন করল। শুধু বাহুবলে কাজ চলে না, তার পুর্বপুরুষের সংস্কৃতি তারা বহন করে তাদের রক্তে। সেই স্মৃতি সমৃদ্ধ হয় অভিজ্ঞতায়। তৈরি হয় ধর্ম – তার উপাস্য আর সেই উপাস্যের বিগ্রহ, একটু একটু করে। এমনটা ঘটতে কেটে যায় হাজার হাজার বছর। এইভাবেই মধ্যদেশে নাগবংশের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তাদের উপাস্য মহাদেব, তাদের জাতিচিহ্ন বৃষ, সিংহ, ময়ূর, ত্রিশূল, সর্প, বৃক্ষশাখা। তারা জঙ্গল ছাড়লেও, জঙ্গল তাদের ছাড়েনি। ওই যে রক্তে বয়ে চলেছে আদিম কৌমধারা!’ এইসব কথা রঙ্গবতীকে বলেছিলেন আচার্য বৃহস্পতি। বৃহস্পতি আদতে রাজশিক্ষক। রাজার নির্দেশে কুমারদের শিক্ষাদান করেন।

যখন রঙ্গবতী বালিকা ছিল, তখন কুমার অনঙ্গ তার প্রতি আকৃষ্ট হন, তার রূপমোহে। রঙ্গবতীর দেহের বর্ণ যদিও শ্যাম, তবু এই কন্যা বেতসলতার মতই তীক্ষ্ণ, অপরাজিতা ফুলের মত ব্যক্তিত্বময়ী আর ঊষায় সূর্যালোকের ন্যায় শান্তসুন্দর। কুমার অনঙ্গ তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ায়, তার পিতা মহারাজ শিবনাগের চিন্তা কম ছিল নয়া। কিন্তু তিনি যৌধেয়বংশজ বীর। উত্তরের আর্যদের ন্যায় ক্রুর নন। তা ছাড়া নাগ গণরাজ্যে কোনও প্রজাকে অকারণে দমন করা যায় না, বিশেষ করে নারীদের তো নয়ই। তাই গণপতি শিবনাগ ব্রাহ্মণ অগস্ত্য গোত্রজ বৃহস্পতিকে অনুজ্ঞা করলেন, বালিকাটিকে যথোপযুক্ত শিক্ষাদানে। আচার্য বৃহস্পতি রঙ্গবতীকে অত্যন্ত যত্নসহকারে শিক্ষাদান করতে লাগলেন। তিনি বালিকাকে জানালেন উত্তরে আর্যরাজত্বের সাথে মধ্যদেশে এই গণরাজ্যের পার্থক্য। ‘দেবপুত্রশাহী কুষানবংশের মেরুদণ্ড যারা ভেঙ্গে দিয়েছেন, সেই নাগবংশীয়রা শক্তিশালী মহাক্ষত্রপ বংশের রাজা রুদ্রবর্মাকেও পরাস্ত করে উজ্জয়িনী থেকে তাকে উৎখাত করে। নাগ গণরাজ্যের সীমানা উত্তরে অগ্রোদকা, পুর্বে কলিঙ্গ, দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত ও পশ্চিমে সৌরাস্ট্র পর্যন্ত পরিব্যপ্ত। নাগগণ বিভিন্ন গোষ্ঠিতে বিভক্ত। মথুরা, অগ্রোদকা, উজ্জয়িনী, বেশনগর, ছিন্নকূট, পদ্মাবতী ইত্যাদি স্থানে তাদের আপন আপন রাজধানী। গণসংস্থাগার বললে ঠিক হয়। কারণ তারা মুখ্যত গণরাজ্য, প্রজার মতামত নিয়ে রাজা অর্থাৎ গণমুখ্য রাজ্য পরিচালনা করেব। আর এই সকল গণরাজ্যের মুখ্য মহাসংস্থাগার বা কেন্দ্রীয় রাজধানী হোল পদ্মাবতী। নাগগণরাজ্যের পুর্বে শক্তিশালী মগধ সাম্রাজ্য। পরমভট্টারক সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত এখন মগধনরেশ। কিন্তু চরিত্রে মগধ সম্পূর্ণ পৃথক। পররাজ্যগ্রাস তার একমাত্র অভিপ্রায়। পুর্বে সুহ্মদেশে থেকে দক্ষিণ-পূর্বের বঙ্গ গণরাজ্য, উত্তরে লিচ্ছবী গণরাজ্য, দক্ষিণে কলিঙ্গ, কাঞ্চী প্রমুখ রাজ্য এবং উত্তর পশ্চিমে গান্ধারের সীমানা পর্যন্ত সকল রাজ্যই আজ মগধেরসাম্রাজ্যের গ্রাসে। নাগগণের অতীত জন্মভূমি অহিচ্ছত্র আজ তার পদতলে। মালবগণও দীর্ঘ সংগ্রামের পর পরাজিত মগধের করদ। শেষে মালবরাজদূহিতা ধ্রুবাদেবীকে সমুদ্রগুপ্তের পুত্রবধূ করে মালবগণ নিষ্কৃতি পেয়েছে। ইতোমধ্যেই মগধের সেনা লিচ্ছবী, কাশী, কোশল, বৎস, পাঞ্চাল, অন্তর্বেদী প্রমুখকে রাজ্য গ্রাস করেছে। শুধু বাকি আছে নাগগণরাজ্য। যদিও নাগরাজকন্যা দত্তাদেবী সম্রাটের প্রধানা মহিষী, তথাপি নাগদের সংশয় যায় না। যদিও নাগগণরাজ্য সামান্য করদাতা এবং পরক্রমাঙ্ক সমুদ্রগুপ্ত তার দ্বিগুণ ফিরিয়ে দেন উপঢৌকন ও পারিতোষিক হিসাবে, তবুও নাগগণ কদাপি বিস্মৃত হয় না যে তারা করদ। সমুদ্রগুপ্ত নিজে লিচ্ছবীদৌহিত্র, তাতে লিচ্ছবীগ্রাস কি স্থগিত রেখেছেন?’

রাজা অনঙ্গনাগের রথ এসে থামলো রঙ্গবতীর ভদ্রাসনের দ্বারে। দাসীরা কুমকুম, চন্দন, পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগল। আর রঙ্গবতী নিজে রাজাকে প্রণাম করে অভ্যর্থনা করল। রাজার পরনে কঞ্চুকী, মাথায় উষ্ণীষ, গলায় কন্ঠহার। কতদিন পরে সেই বাল্যসখা এসে দাঁড়ালেন দ্বারে। সেইদিনের তরুণ অনঙ্গ এখন গণপতি অনঙ্গনাগ। অনঙ্গ রঙ্গবতীর গৃহে প্রবেশ করে একান্তে বললেন, ‘রঙ্গবতী! আমি আজ তোমার কাছে কিছু চাইতে এসেছি!’ নৃত্যগীতবাদ্যে সন্ধ্যা রমণীয় হয়ে উঠল। শূলপক্ব মাংস ও মদিরার অভাবও ছিল না। তারপর শ্রান্ত হতে সকলে বিদায় নিল, এখন একান্তে শুধু অনঙ্গ আর রঙ্গবতী। সুরাপানে দুজনেই স্বল্প মদির। চক্ষু উজ্জ্বল, কপালে স্বেদবিন্দু। নীরবতা ভাঙলেন অনঙ্গনাগ। ‘রঙ্গবতী! আজ আমি তোমাকে একটি কাহিনী শোনাবো আর কাহিনী অন্তে তোমার কাছে কিছু চাইবো। আশা করি তুমি আমাকে নিরাশ করবে না!’ রঙ্গবতী কিচ্ছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে উত্তর করল, ‘ভট্ট! যৌধেয়রাজ অনঙ্গনাগ নগরনটী রঙ্গবতীকে আদেশ করছেন, নাকি বাল্যসখা অনঙ্গ তার রঙ্গকে কিছু বলছেন?’ ‘এক যৌধেয় আর এক যৌধেয় বাল্যসখীকে নিবেদন করবে!’ অনঙ্গনাগ রঙ্গবতীর হাত দুখানা টেনে নিয়ে বললেন। রঙ্গবতী উৎকর্ণ হলে, অনঙ্গ বলতে শুরু করলেন।

বেশনগরের পুর্বদক্ষিণে পাহাড়শ্রেণী আর ঘন জঙ্গলের মধ্যে এক পীঠ আছে। সেই পীঠ রক্ষা করে নাগদের পুর্বজ নিষাদরা। সেটি দেবীপীঠ। সেই পীঠের আরাধ্যা দেবী পার্বতী। সেই পীঠে পার্বতীর কোনও দেবীমূর্তি নেই, আছে দেবী চণ্ডিকার, আর আছে এক আজ্ঞাচক্র। গুহাগাত্রে অঙ্কিত সেই চক্রের কেন্দ্রে একটি লোহিতবিন্দু। লোহিতবিন্দুকে ঘিরে একটি ত্রিভুজ। সেই ত্রিভুজকে সমভাবে ছেদ করেছে একটি চতুষ্কোণ। ফলে সাতটি ত্রিকোণের সৃষ্টি হয়েছে। সেই সাতটি ত্রিকোণে সাতজন মাতৃকার অধিষ্ঠান। তারা হলেন, ব্রাহ্মী, কুমারী, মহেশ্বরী, বৈষ্ণবী, বরাহী, ঐন্দ্রী, চামুন্ডী। সেই ত্রিকোণ ও চতুর্ভুজকে গিরে রয়েছে দুটি বৃত্ত। প্রতিটি বৃত্তে দ্বাত্রিংশটি পদ্মদল। মোট চৌষট্টিটি পদ্মদল, চৌষট্টি যোগিনীর স্থান। এই চৌষট্টি যোগিনীগণ ওই অষ্টমাতৃকার আজ্ঞাধারী। পদ্মদলকে ঘিরে রয়েছে লতাপুষ্প, সেগুলি অষ্টমাতৃকার ও যোগিনীগণের বাহন।

চৌষট্টি যোগিনীগণ হলেন, বহুরূপা, তারা, নর্মদা, যমুনা, শান্তি, বরুণি, ক্ষেমঙ্করী, ইন্দ্রানী, বরাহী,রণবীরা, বানরমুখী, বৈষ্ণবী, কালরাত্রি, বৈদ্যরূপা, চর্চিকা, বেতালী, ছিন্নমস্তিকা, বৃষবাহনা, জ্বালা-কামিনী, ঘটভরা, কারকালী, সরস্বতী, বিরূপা, কাবেরী, ভালুকা, নরসিংহী, বিরজা, বিকটাননা, মহালক্ষ্মী, কুমারী, মহামায়া, রতি, কার্করী, সর্পস্বা, যক্ষিণী, বিনায়কি, বিন্ধ্যবালিনী, বীরকুমারী, মহেশ্বরী, অম্বিকা, কামায়নী, ঘটবরী, স্তুতি, কালী, উমা, নারায়ণী, সমুদ্রা, ব্রাহ্মনী, জ্বালামুখী, অদিতি, চন্দ্রকান্তি, বায়ুবেগা, চামুণ্ডা, মূরতি, গংগা, ধুমাবতী, গান্ধারী, সর্বমংগলা, অজিতা, সূর্যপুত্রী, বায়ুবীণা, অঘোরা, ভদ্রকালী ও অগ্নেয়া। স্মৃতি থেকে বললাম, ত্রুটি হতে পারে। লক্ষ্য কর এই অষ্টমাতৃকা আবার অষ্টযোগিনীও বটে।

ওই চক্রচিহ্ন ঘিরে আটটি মূর্তি আছে। প্রথমে ব্রহ্মানী, করণ্ডমুক্তাশোভিত কিরীটধারী এই মূর্তি চতুর্ভুজা, সালঙ্কারা, হংসবাহিনী। পীতবসনা দেবীমুর্তির হস্তে জপমালা, পদ্ম, কমণ্ডলু, ও ঘন্টা। ইনি শক্তি ও ব্রহ্মার সৃষ্টিকারিনী । দ্বিতীয়মুর্তি গরুড়বাহনা বৈষ্ণবীর। চতুর্ভুজার চার হাতে শঙ্খ, চক্র, পদ্ম ও তরবারি। কিরীটমুকুটধারিনী এই দেবী বিষ্ণুর স্রষ্টা। শীর্ষমুর্তিটি মহাশ্বরীর। তিনিই সকল শক্তির উদ্গাতা, শিবানী। জটামুকুটধারিনী এই দেবীর হস্তে ত্রিশূল, ডম্বরু, অক্ষমালা এবং পানপাত্র। বৃষারুঢ়া এই দেবী চন্দ্রচূড়। দুপাশে আরও দুটি করে মোট চারটি মুর্তি আছে দেবী ইন্দ্রাণী, কুমারী, বরাহী ও নরসিংহীর। একেবারে নীচে রয়েছেন দেবী চামুণ্ডা। কৃষ্ণবর্ণা, করালদংষ্ট্রা এই দেবী মহামায়ার বিশেষ রূপ। দেবী শৃগালবাহিনী, মুন্ডমালিনী ও ভীষণা!’ স্তব্ধ হলেন অনঙ্গ। তার শরীর শিহরিত হোল। স্থানুবৎ রঙ্গবতী শুনছে এই বর্ণনা, বাক্যহীনা।

পাটলীপুত্রে একটি শক্তিপীঠ আছে, কিন্তু বর্তমানে সেটি ক্রিয়াহীন। নাগগণরাজ্যের সিদ্ধান্ত, সেটিকে পুনরায় সক্রিয় করা। তন্ত্রশক্তিকে পুনরায় জাগরূক করা। সেই কাজের ভার বিন্ধ্যের শক্তিপীঠকে দেওয়া হয়েছে। তুমি জান, মগধনরেশের প্রধানা মহিষী এই নাগবংশীয়া হওয়া সত্বেও, মহারাজ সমুদ্রগুপ্ত তার পররাজ্যগ্রাসের হাত এই নাগযৌধেয়দের দিকে বাড়িয়েছেন। আমাদের গুপ্তপুরুষ সে খবর এনেছে। আমরা নাগবংশীয়রা তাতে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে পারি না। আত্মরক্ষার সমস্ত উপায় আমরা করছি। সেকাজে আমরা সফল হব, সংশয় নেই। কিন্তু সমুদ্রগুপ্তকে তার এই পাপের মুল্য দিতে হবে। পাটলীপুত্রের শক্তিপীঠে মারণ উচাটনের ভয়ঙ্কর শক্তিকে জাগ্রত করতে হবে। লক্ষ্য পরম ভট্টারক মগধ সম্রাটের বিনাশ!’ অনঙ্গনাগকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন কর রঙ্গবতী, ‘সে কাজে আমার কি প্রয়োজন?’ ‘আছে!’ দৃঢ়স্বরে বললেন অনঙ্গ। ‘সেই তন্ত্রমন্ডলে অষ্টমাতৃকার মনুষ্যরুপী আটজন যুবতীর প্রয়োজন। সাতজন সর্বগুণসম্পন্নার খোঁজ মিলেছে। কিন্তু মূল মাতৃকা এখনও অপ্রাপ্ত। তুমি সেই মাতৃকা পার্বতী! গুরু বৃহস্পতি তোমায় চৌষট্টি কলাবিদ্যা শিখিয়েছেন। বাকি বিন্ধ্যপীঠের পীঠাধীশ গুরু মঙ্গলনাথ শিখিয়ে দেবেন। এই হচ্ছে নাগগণের ইচ্ছা। কিন্তু আমরা কাউকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারি না, বিশেষত কোনও নারীকে। রাজি হওয়া না হওয়া একান্তই তোমার ইচ্ছাধীন, রঙ্গবতী!’ অনঙ্গ থামলেন। ‘পরিবর্তে আমি কি পাব?’ তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করল রঙ্গবতী। স্মিতহাস্যে অনঙ্গ বললেন, ‘আমাকে!’

পাটলীপুরের সুদীর্ঘ ইতিহাস। কথিত আছে একদা হর্যাঙ্করাজ অজাতশত্রু অশ্বপৃষ্ঠে বসে সুরোধনির এই ত্রিবেণীসঙ্গম পর্যবেক্ষণ করছেন। তার মনোগত অভিপ্রায়,রাজধানী রাজগৃহ হতে এখানে স্থানান্তর করবেন। একটি সুরক্ষিত রাজধানী। ইদানীং লিচ্ছবীগণ বড়ই শিরঃপীড়ার কারণ হয়েছে,মধ্যে মধ্যে আকস্মিক আক্রমণে হর্যাঙ্ক রাজশক্তিকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। যদিও তার পিতা মহারাজ বিম্বিসার লিচ্ছবী রাজকন্যা চেল্লানাকে বিবাহ করেছিলেন এই লিচ্ছবীর হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্যে। অজাতশত্রুর নিজের মাতাও কাশীরাজ দুহিতা কোশলাদেবী। অপর বিমাতা মদ্রনরেশ কন্যা ক্ষেমা ।

নৃপতি বিম্বিসার ইদানীং রাজকার্যে মন দেন না,পুরোপুরি বৌদ্ধ হয়ে গেছেন। রাজপ্রাসাদ বৌদ্ধবিহারে রূপান্তরিত হয়েছে। বিম্বিসার সম্রাট হলেও,আসলে অজাতশত্রুই রাজকার্য দেখাশোনা পরিচালনা করেন। কিন্তু এভাবে কতদিন চলে! কেবল নূতন রাজধানীটি গড়ে ওঠার পালা। এই ত্রিবেণী সঙ্গম শুধু নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে তাই নয়, নদী বাণিজ্যেরও বিপুল সম্ভাবনা। গণ্ডকী ও সোন নদী তাদের জলভার নিয়ে গঙ্গার ধারা সমৃদ্ধ করেছে। কিছু পশ্চিমে ঘর্ঘরা নদীও গঙ্গায় মিলেছে। গোটা দোয়াবের উর্বরতম অঞ্চল এই ভূমিখণ্ড।

অতিকায় শাল কাণ্ড জমা হচ্ছে, তাই দিয়ে নগরপ্রাকার নির্মাণ চলছে। দেড় ক্রোশ তার দৈর্ঘ্য এক ক্রোশ প্রস্থ। কিছুটা দূর দূর প্রবেশ নির্গমের গোপন দ্বার। তার মধ্যে দ্বিতীয় প্রাকার। প্রাকার ঘিরে সেনানিবাস। নগরীর কেন্দ্রে রাজ অবরোধ, দেবমন্দির। পিতা বিম্বিসার বৌদ্ধ হলেও অজাতশত্রু ব্রাহ্মণ্যবাদী। তবে তিনি পিতার মিত্রসম জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর ও বৈদ্যশ্রেষ্ঠ জীবকের গুণগ্রাহী। দীর্ঘদিনের সহস্র সহস্র শ্রমিকের পরিশ্রমে পাটলীপুত্রে রাজধানী নির্মাণ সমাপ্ত হল। অজাতশত্রু সৈন্যদের ধীরে ধীরে পাটলিপুত্রে বাসস্থ করালেন,নগরী সেজে উঠল। তারপর একদিন তিনি বিম্বিসারকে বন্দী করে নিজে রাজা হলেন। বন্দী বিম্বিসার বুদ্ধের শরণে রাজগৃহে রইলেন। অজাতশত্রুর রাজত্বকালে হর্য়াঙ্ক সাম্রাজ্য প্রসারিত ও দৃঢ়প্রোথিত হল। কালের গতিতে আরও চার পুরুষ রাজত্ব করলেন, উদবভদ্র, শিসুঙ্গ, কেকাবর্ণ, মহানন্দীন। তারপর গঙ্গার ধারার সাথে মিলিয়ে গেল হর্য়াঙ্কদের পরাক্রম।

পুরাণে কথিত আছে মহারাজ পুত্রক তার রানী দেবী পাটলীকে তৃপ্ত করতে মায়াবলে এক নগরী নির্মাণ করলেন। পসেই রানীর পুত্রকে এই নগরী উৎসর্গ করেন,তাই এর নাম হল পাটলীপুত্র। কেউ বলে পাটলীগ্রাম। কেউ বা কুসুমপুর। আবার কেউ বলে পাটলি নামের এক বৃক্ষের বিপুল উদ্ভব হতো এখানে,তাই পাটলিগ্রাম। পুণ্যতোয়া গঙ্গা এর কোন উত্তর দেয় না। সে বয়ে যায় আপন ছন্দে!

রাত্রির দ্বিতীয় যাম । কুলুকুলু স্বরে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। নদীতটে দুই ছায়াময় বৃদ্ধ নীচস্বরে কথা কইছেন। একজন মহারাজ ধর্ম নন্দের মহামন্ত্রী রাক্ষস,অপরজন তক্ষশীলা থেকে আগত মহামতি চাণক্য। তিনি রাক্ষসকে বললেন, ‘মহামন্ত্রী! আপনি বিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান এবং বিগতস্পৃহ। কিন্তু আপনার আনুগত্য কার প্রতি? রাজার না রাজ্যের প্রতি? রাজার পরিবর্তন হয়, তথাপি রাজ্যের পরিবর্তন হয় না। রাজ্য স্থির অথচ রাজা পরিবর্তনশীল!’ এই বলে চাণক্য থামলেন। মহামন্ত্রী রাক্ষস সপ্রশ্ন উত্তর করলেন, ‘কিন্তু মহারাজের প্রতি বিশ্বাসঘাত করব কেন? মহারাজ তো আমার কোনও ক্ষতি করেন নি। তিনি আমার প্রতি শ্রদ্ধাশীল!’ ‘মহামন্ত্রী রাক্ষস! যদি মহারাজ রাজ্যের প্রতি, প্রজাদের প্রতি অন্যায় করেন, সেক্ষেত্রে আপনার করনীয় কি কিছুই নেই? আপনার গুপ্তপুরুষগণ নিশ্চয় খবর এনেছেন, যে রাজ্যে বিদ্রোহ সমাগত।মহারাজের অনুগতও আছেন অনেক সংখ্যায়। তার ফল এই যে, , মগধ এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দ্বারে উপনীত। এখন স্থির করুন, আপনি মগধকে এই পরিণাম থেকে রক্ষা করবেন কিনা!’ ‘কি উপায়ে, মহামতি চাণক্য?’ তীব্রস্বরে চাণক্য উচ্চারণ করলেন, ‘মহারাজকে অপসারণ করে !’

‘রাজরক্তে আমার হস্ত রঞ্জিত করব? এ সম্ভব নয়, ব্রাহ্মণ!’ ‘মহারাজের কোনও ক্ষতি হবে না, শুধু তিনি নির্বাসিত হবেন। তার পরিবর্তে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবেন চন্দ্রগুপ্ত। এ আমার অঙ্গীকার! এর অন্যথা করার সাহস চন্দ্রগুপ্তেরও হবে না! এখন আপনার বিবেচনা!’ ‘বেশ, আমাকে একটু ভাবতে দিন, চানক্য!’ তারপর দুজনে দুপথে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন । এই সাক্ষাৎকারের অব্যবহিত পরে চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসনে বসলেন । মগধে নন্দ বংশের রাজত্ব শেষ হল।

আলেকজান্ডারের পারস্যে প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে সেই ভূমিখণ্ডের দখল নিলেন চন্দ্রগুপ্ত। মগধ রাজ্যের সীমা বিপুলভাবে প্রসারিত হল। সমগ্র দোয়াব তার আধিপত্যে এলো। চন্দ্রগুপ্তের নিরাপত্তা এখন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। পাছে সম্রাটকে কেউ বিষ প্রয়োগ করেন, এই আশঙ্কায় চাণক্য তাকে প্রতিদিন অল্পমাত্রায় বিষ গ্রহণ করতে উপদেশ দেন। এবং সকলের অগোচরে। কিন্তু একদিন এক অঘটন ঘটলো। মহারানী রাজার ভোজ্য পরীক্ষা করবেন বলে সেই ভোজ্যের অংশ মুখে দিলেন এবং তৎক্ষণাৎ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হলেন। দূত মুখে সেই কথা শুনে দ্রুত চাণক্য এলেন এবং পূর্ণগর্ভা রানীর চিকিৎসা শুরু করলেন। কিন্তু বিফল হয়ে রানীর উদরে অস্ত্রোপচার করে নবজাতকে ভূমিষ্ঠ করলেন। মহারানীর মৃত্যু হল। বিষ নবজাতকের কপাল স্পর্শ করায়, কপালে একটি কৃষ্ণবিন্দুচিহ্ন দেখা গেলো। শোকবিদ্ধ মহারাজা পুত্রের নাম দিলেন বিন্দুসার।

সেই বিন্দুসারের পুত্র অশোক মৌর্য বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা বলে পরিগণিত হলেন। তার রাজত্বকালে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সেই সময়কালে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছিল। অশোক বুদ্ধিমান, নৃশংস ও সাহসী ছিলেন। তার বীরগাথার অন্তরালে চাপা পরে গেছে লক্ষাধিক আদিবাসী কলিঙ্গের রক্তধারা। তিনি ধর্মাশোক হয়েছিলেন, কিন্তু কলিঙ্গের আদিবাসীদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেননি। তখন বৌদ্ধ ধর্মের বাড়বাড়ন্ত। সেই সুযোগে তিনি বৌদ্ধ হলেন, কিন্তু বুদ্ধের ক্ষমার বাণী তিনি ভুলে গেলেন। মৌর্যবংশের পর পাটলীপুত্র মহামেঘবর্ণ বংশের শাসনাধীন হয়। তার কলিঙ্গের নৃপতি ছিলেন। তারপর অধিষ্টিত হন সুঙ্গ, কাণ্ব,কুশান, ভরশিবগণ। কাণ্বগণ জৈন ছিলেন আর কুশানগণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। ইরানীয় কুষানগণকে পরাস্ত করে তারপরে প্রতিষ্ঠা হয় নাগগণসঙ্ঘের। তাদের রাজধানী মথুরা এবং পরে পদ্মাবতী হলেও, পাটলীপুত্রেও একটি রাজধানী স্থাপন করেন। প্রত্যেক গণেরই আলাদা রাজধানী ছিল। যেমন বেশনগর, উজ্জয়িনী, প্রতিষ্ঠান, অগ্রোদকা, অহিচ্ছত্র, মথুরা, পাটলীপুত্র প্রমুখ। মুখ্য গণসংস্থাগার পদ্মাবতীতে অবস্থিত ছিল। নাগগণ শৈব ছিলেন। ভরশিবদের অধীনে প্রয়াগের শাসন ছিল বৈশ্যগণের হাতে। এই বৈশ্যগণের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে পেতে, তারা একসময়ে প্রায় সমগ্র উত্তরাপথ অধিকার করে। এই হোল গুপ্ত সাম্রাজ্যের সুত্রপাত। নাগগণরাজ্য থেকেই চিরাচরিত বর্ণপ্রথা ভেঙ্গে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণের পরিবর্তে রাজকীয় ক্ষমতা অন্য বর্ণের হাতে যায়, গুপ্তবংশ তারই পরিণাম।

এও শোনা যায়, দক্ষযজ্ঞের অন্তে, সতীর দেহত্যাগে শোকগ্রস্ত মহাদেব তার দেহ নিয়ে পরিক্রমা করেছিলেন, তখন বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সে দেহ খণ্ড খণ্ড করেছিলেন। দেবীর দক্ষিণ হস্ত নাকি পতিত হয়েছিল এই পাটলীপুত্র নগরীতে। সেই থেকে, জনশ্রুতি, এই নগরী সতীর একান্ন পীঠের অন্যতম। গংগা ও হিরণ্যবাহী (সোন) নদীর সঙ্গমে প্রাচীন পাটলীপুত্র নগরী কাঠের প্রাচীর ঘেরা এক দুর্ভেদ্য দুর্গ বিশেষ। দুই দিকে দুই নদী থাকায় এই নগরীকে জলদুর্গ বলা হয়। প্রশস্ত সরণী, বীথি, পথ, হর্ম্যে সুসজ্জিত এই নগরীর কেন্দ্রে বিপুলাকার রাজ অবরোধ। রাজাবাসটি স্বতন্ত্র প্রস্তর প্রাচীরে ঘেরা। মধ্যে রাজদরবার, মন্ত্রণাগার, মন্ত্রী ও মহাকরণিকদিগের, বলাধিপতি ( সেনাপতি ), সন্ধি- বিগ্রহিক ( যুদ্ধ পরিচালক ) দিগের বাস, মন্দির, বেশ কয়েকটি রনিবাস ( রানিদের মহল), দাস দাসীদের বাসস্থান, ভিষগগৃহ এবং মহারাজের বাসস্থান ও অস্ত্রাগার। তাছাড়া আছে সুবিশাল অতিথিনিবাস। দেবী পাটনেশ্বরী (পাটলীশ্বরী সম্ভবত) নগরীর প্রধান আরাধ্যা। অবশ্য তার অপর একটি মন্দির এই রাজ অবরোধেও বর্তমান। আর আছে মহাকাল শিবের মন্দির, আর রুদ্রবিনায়কের মন্দির। কথিত আছে গুপ্তবংশীয়গণ শ্রেষ্ঠীবৃত্তি গ্রহণ করার পুর্বে বনজ ছিলেন। তাদের কৌমপ্রতীক ছিল হস্তি। সেইজন্য গুপ্তরাজবংশের প্রতিষ্টাতা শিবনন্দন গনেশের মস্তকটি হস্তির রূপ দেন এবং বিধান দেন, গুপ্তসাম্রাজ্যে বিনায়ক হবেন অগ্রপুজ্য। সব মিলিয়ে সম্রাটের রাজাবাসটি নগরী মধ্যে একটি নগরী বিশেষ।

রাজাধিরাজ পরমভট্টারক একরত পরক্রমাঙ্ক সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত এখন পাটলীপুত্রের সিংহাসনে বিরাজমান। তিনি শালপ্রাংশু, উজ্জ্বলবর্ণ এবং যুদ্ধপ্রিয়। শত অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন তিনি সগর্বে ধারণ করেন। যদিও তার প্রধানা মহিষী নাগবংশীয়, তথাপি তার উপপত্নীর সংখ্যা সহস্রাধিক। লিচ্ছবী, কোশল, মাগধী, বাকটক, কাঞ্চী, কলিঙ্গ, শক, বাহ্লিক, যবন, এমন কোনও জাতি নাই যে তিনি পরিহার করেছেন। কুড়িটি রাজ্য জয় করেছেন তিনি। একটি অশ্বমেধ যজ্ঞও করেছেন। কিন্তু একটি অপ্রাপ্তির কাঁটা তাকে সতত বিদ্ধ করে, তা হোল নাগগণরাজ্য। প্রাসাদসংলগ্ন প্রশস্ত সুরম্য বাগিচায় ভ্রমণ করতে করতে তিনি ভাবেন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। একটিই বাধা, তার পট্টমহিষী দত্তাদেবী। তিনি নাগবংশীয়া। সমস্ত মগধ সাম্রাজ্যে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়া। সমুদ্রগুপ্ত একমাত্র তাকেই সমীহ করেন। সম্রাটের পট্টমহিষীর গর্ভে দুই সন্তান, রাম এবং চন্দ্র। একই পিতার সন্তান হওয়া সত্বেও রাম ও চন্দ্রের চরিত্রে পার্থক্য আকাশ পাতাল। রাম ধীর স্থির কিন্তু চন্দ্র উগ্র অবিনয়ী। মহারাজ সমুদ্রগুপ্তকে রাজি করিয়ে তিনি রামের বিবাহ দিয়েছেন মালববংশীয়া রাজনন্দিনী ধ্রুবকুমারীর সাথে। কিন্তু দেবর চন্দ্রের দৃষ্টি ভাতৃজায়ার প্রতি, এ ঘটনা পট্টমহিষীর চোখ এড়ায় নি। তার নির্দেশ চন্দ্রগুপ্ত মহারাজের প্রতিনিধি হিসাবে লিচ্ছবীদেশেই থাকেন আজকাল।

পাটলীপুত্র নগরীর প্রান্তদেশে আর একখানি মন্দির আছে। সেটি দেবী শীতলার। দেবী শীতলার দয়ার বিভিন্ন রোগের উপশম হয়, এ কথায় প্রজাদের বিশ্বাস। সাধারণ প্রজার ভিড় হয় সে মন্দিরে। মানতের জন্য। তারই পরিসরে অপর একটি মন্দির আছে, কিন্তু তা প্রায়ই জনশূন্য। সে মন্দির নাকি তন্ত্রসাধনার পীঠ, অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুণ্ডা। মানুষ ভয়ের, সম্ভ্রমের চোখে তাকে দেখে। সেখানে একটি চামুণ্ডার বিগ্রহ আছে। প্রায়ান্ধকার সেই মন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণের নাম সুবর্ণনন্দী। দিনান্তে একবার তার দর্শন পাওয়া যায়, যখন তিনি বাহিরে আসেন, অগমকূপে অঞ্জলী দিতে। মন্দির সংলগ্ন এই কূপটি নাকি তলহীন, জনশ্রুতি, এই কূপটি সময়ে সময়ে অগ্নি উদ্গীরণ করে। তখন এই কূপে মাতৃকারা পিণ্ড গ্রহণ করেন। অনেক নীচে কালো জলে শুধু কুপের পাশের অশ্বত্থের ছায়া শুধু কাঁপে নিরন্তর।

গুঢ়পুরুষেরা খবর এনেছে, নাগগণরাজ্যে সেরকম কোন বিশেষ সেনাবাহিনী নেই। যেহেতু তারা গুপ্তবংশের সাথে বৈবাহিক সূত্রে সম্পর্কিত, তাই প্রতিরক্ষার বিশেষ ব্যবস্থাও নেই। গণরাষ্ট্র বলে তাদের বিশেষ কোন কেন্দ্রীয় সেনাপতি বা সন্ধি-বিগ্রহিকও নেই। প্রমোদ কক্ষে বীণা বাজাচ্ছিলেন সম্রাট, নিপুণবাদ্যকর তিনি, সংবাদে তার মন প্রসন্ন হোল। তথাপি তিনি লক্ষ্য করলেন, অকারণে স্বেদসিক্ত হচ্ছেন তিনি। স্কন্ধ একটা ব্যাথা অনুভব করলেন। তারপর রনিবাসের দিকে গমন করলেন। একটি নূতন যবনী রমণীর আগমন ঘটেছে। তার দিকে দৃষ্টি দেওয়াও প্রয়োজন। কিন্তু এ সময় তার জন্য প্রশস্ত নয়। বাগিচা দিয়ে যেতে যেতে চিন্তা করলেন, কিভাবে পট্টমহিষীকে নাগগণরাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনাটি ব্যক্ত করবেন!

শীতলামন্দিরে সেদিন সন্ধ্যায় এক সন্যাসী এলেন। দেবী শীতলাকে প্রণাম করে তিনি পার্শ্ববর্তী তন্ত্রপীঠে গেলেন। দেবী চামুণ্ডাকে ভক্তিভরে প্রণাম করে, মন্দিরের প্রণামীতে আটটি ষোল রতির কার্ষাপণ দান করে সেই সন্যাসী বিদায় নিলেন। সন্ধ্যায় সুবর্ণনন্দী সেই কার্ষাপণগুলি পরীক্ষা করে দেখলেন, প্রতিটি কার্ষাপণে পদ্মহস্তা নারীর মূর্তি, আর মূর্তির পায়ের তলায় সর্পিল নাগচিহ্ন। সুবর্ণনন্দীর মুখ উজ্জ্বল হোল।

পদ্মাবতী নগরীতে ব্যস্ততা। মহাগণমুখ্যসংস্থাগারে মন্ত্রণা চলছে। নাগগণরাজ্যের যাবতীয় গণপতিগণকে আহ্বান করেছেন প্রধানগণপতি দেবনাগ। অহিছত্র, কুরু, অগ্রোদকা, মথুরা, ছিন্নকূট, বেশনগর, প্রতিষ্ঠানপুর, উজ্জয়িনী ইত্যাদি সমস্ত গণরাজ্য থেকে, কুণিন্দ, আর্জনেয়, মল্ল প্রভৃতি নাগগণ এসেছেন। গণরাজ্যের গুঢ়পুরুষেরা সংবাদ এনেছে, মহারাজ সমুদ্রগুপ্ত নাগগণসঙ্ঘ গ্রাসের পরিকল্পনা করছেন। সংবাদ শুধু পাটলীপুত্র থেকেই আসেনি, কপিলাবস্তু, বৈশালি, কাশী, ভগদত্তপুর থেকেও এসেছে। এই সমস্ত করদরাজ্যের সেনা মিলিত হবে মগধসেনার সাথে একযোগে বর্ষাঋতুর পরে যে কোনও সময়ে আক্রমণ করবে, শরৎকালে। তবে একটা কথা, এইসব রাজ্যের সৈন্যরা কৃষিজীবী, তাই ফসল কাটার পর তারা যুদ্ধযাত্রা করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে শরতের প্রবারণে (শরৎ পুর্ণিমায়) অভিযান সুচিত হবে।

দুইদিন ধরে সমস্ত পর্যালোচনা করে রণকৌশল স্থির হোল। আক্রমণ প্রতিহত করবার বিশেষ পরিকল্পনা করা হল। স্থির হোল, সম্মুখসংগ্রামে নাগগণ মগধবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করবে না, যুদ্ধ হবে অপ্রত্যক্ষ, জঙ্গলে, পল্লীতে, পাহাড়ের সঙ্কীর্ণ গিরিবর্ত্মে, নদীর খাতে – সর্বত্র। আর এই প্রতিরোধে নাগবংশীয় সমস্ত সমর্থ নারী পুরুষ অংশগ্রহণ করবে। যুদ্ধের সেনাপত্য থাকবে গণসংস্থার হাতে, বিবিধ রণাঙ্গনে আঞ্চলিক গণপতি ও পুরস্কর্তাগণ নেতৃত্ব দেবেন। যুদ্ধ হবে নাগগণের শর্তে, মগধের নিয়মে নয়। এই সংগ্রামে প্রমাণিত হবে নাগগণ সত্যকারের যৌধেয় কিনা।.

দুইদিন পরে অনঙ্গ এলেন রঙ্গবতীর আলয়ে। রঙ্গবতী যেন অপেক্ষা করছিল অনঙ্গের আগমনের। তার পরিবর্তন হয়েছে এ কয়দিনেই। সে আর নগরনটী নয়, বহুবল্লভা নয়। মনে মনে এক প্রেমিকা তপস্বিনী। রেশমবস্ত্র পরিহার করে সে আশ্রয় করেছে কাষায় বস্ত্র। সকল আভরণ ত্যাগ করে কন্ঠে একটি ফুলের মালা। প্রসাধনহীনা। কেশদাম বেনীবন্ধ নয়, চূড়াকৃত। অনঙ্গকে সে আপ্যায়ন করল মধুর হাস্যে। বিস্মিত অনঙ্গকে সে শুধু বলল, ‘আমি প্রস্তুত!’ অনঙ্গ মৃদু হেসে বললেন, ‘কাল প্রভাতে তোমার যাত্রার আয়োজন করা হয়েছে।‘

দুটি গো-শকট ও চারজন অশ্বারোহী রক্ষী। রঙ্গবতী যাত্রা করল নূতন জীবনের উদ্দেশ্যে। এই প্রথম সে চলেছে বেশনগরের সীমানার বাইরে। বালিকাবেলায় তাকে পিতামাতাসহ ধরে আনা হয়েছিল সুদূর অরণ্যপ্রদেশ থেকে। তারপর তার মাতাপিতাকে ক্রীতদাস করে প্রেরণ করা হয়েছিল অন্যখানে। তাদের কথা আবছা মনে পড়ে। ছিন্নকূটের সংলগ্ন অরণ্যানীতে ছিল তাদের বাস। বন কেটে চাষাবাদ করার জন্য তাদের বাস্তুচ্যুত করা হয়। এই মুহুর্তে তার মাতাপিতার কথা মনে পড়ছিল খুব। এ কেমন গণব্যবস্থা? সাম্যব্যবস্থায় ক্রীতদাসপ্রথা অব্যাহত? গণরাজ্যে নগরনটীর প্রয়োজন হয় কেন? নারীর অধিকারের কথা বলা হয়, অথচ নারীকে পণ্যের তুল্য ব্যবহার করা হয়! নাগব্যতীত সমস্ত মানুষই কি শত্রু? ঘৃণ্য? রঙ্গবতীর মনে ভিড় করে আসে অভিমান। সুযোগ হলে অনঙ্গনাগকে প্রশ্ন করবে সে। এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দরকার রঙ্গবতীর।

বেত্রবতীর পাশ দিয়ে চলছিল তাদের গো-শকট। ধু ধু বালুকার মাঝে একটি শীর্ণধারা। সারি সারি নাগকন্যা চলেছে জলের ঘট মাথায় নিয়ে। রঙ্গবতী অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখল, একটু পানীয় জল পেতে মানুষকে কি কষ্ট করতে হয়। অথচ বেশনগরে জলের কি অপচয়। নগরনটী বলে সে নিজেও করেছে কত অপচয়। আত্মধিক্কারে তার মন ভরে গেল। কিন্তু এই নদীতো অতীতে প্রভূত জলভার বহন করতো! আজ এই দশা কেন? মহারাজ অনঙ্গকে দেখা হলে জিগেস করবে রঙ্গবতী। দূরে পাহাড় শ্রেণী দৃশ্যমান হয়। যেন পটে আঁকা চিত্রের মত, আকাশের কোলে ঘননীল রঙের। রক্ষীরা শকট থামাতে অনুরোধ করল। খাবার সময় হয়েছে। ঘোড়াগুলিকেও বিশ্রাম দেওয়া দরকার, বলদগুলিকেও। এইখানে বেত্রবতীর তীর ত্যাগ করে তারা যাবে পূর্বে আর বেত্রবতী পশ্চিমে। গো-শকটের চালকদ্বয় আর একজন রক্ষী মশক নিয়ে গেল নদী থেকে জল আনতে। আহার বিশ্রামান্তে তারা চলল পুবের অরণ্যে প্রান্তে। চলতে চলতে এক জায়গায় পথ শেষ, অরণ্য ঘন হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একদল নিষাদ আবির্ভূত হোল। রক্ষীরা বলল, ‘দেবী! এখান থেকে নিষাদরা আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। আর আপনাকে পদব্রজেই যেতে হবে। আজ্ঞা করুন, আমরা বিদায় নিই!’ রঙ্গবতী তার পুঁটলি থেকে একটা নিষ্কের মালা বা’র করে রক্ষীর হাতে দিয়ে বলল, ‘এই মালা মহারাজ অনঙ্গনাগকে দেবে!’

পাহাড়ের উপর ঘন জঙ্গলে একটি মন্দির। বাইরের মানুষ বড় একটা আসে না। মন্দির প্রায়ান্ধকার, একটি দীপ জ্বলছে। মন্দিরের বিগ্রহ দেবী চামুণ্ডা। করালদ্রংষ্ট্রা লোলজিহ্বা ভয়ংকরী। দেবীর পাদদেশে নরকরোটি, সম্মুখে কুমকুম লাঞ্ছিত যোনিপট্ট। রঙ্গবতী এসে দাঁড়াল মন্দিরের সামনে। নিষাদরা অন্তর্হিত হোল। পীঠাধীশ মঙ্গলনাথ এসে দাঁড়ালেন। সৌম্য মুখমণ্ডল, কপালে রক্তটিকা, পরিধানে রক্তবস্ত্র। শান্ত কন্ঠে বললেন, ‘এসো মা!’

মন্ত্রনাকক্ষের সুবৃহৎ পরিসরে চক্রাকারে দশটি আসন। তার মধ্যে একটি বিশিষ্ট। সেই আসনে উপবিষ্ট পরমভট্টারক মহারাজ সমুদ্রগুপ্ত। অন্যান্য যারা উপস্থিত, তারা হলেন মহামন্ত্রী বসুগুপ্ত, মহাবলাধিকৃত সুষেণ, সান্ধিবিগ্রহিক সিংহবর্মা, গুঢ়পুরুষপ্রধান ধনঞ্জয়। এছাড়া সম্রাটের দেহরক্ষীবলের প্রধান জয়রথ। মগধনরেশের সৈন্যবাহিনী বিশাল। পাঁচ লক্ষ পদাতিক, পাঁচ লক্ষ অশ্বারোহী, পাঁচ হাজার রণতরী ও কুড়িহাজার রণহস্তী। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন সৈন্যাবাসে তারা বিন্যস্ত। পাটলীপুত্রে মূল সেনাবাস স্বতন্ত্র একটি নগরীবিশেষ। জয়রথ নাগগণরাজ্যের যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পর্কে বিবরণ দিচ্ছিলেন। ‘মহারাজ! অহিচ্ছত্র (বেরেলি), অগ্রোদকা (আগ্রা), প্রতিষ্ঠান(ঝাঁসি), মথুরা প্রভৃতি নাগগণরাজ্যে কোনও যুদ্ধপ্রস্তুতি চোখে পড়েনি। এইস্থান গুলিতে যৌধেয় নাগগণ অধুনা শ্রেষ্ঠীবৃত্তির দিকে ঝুঁকেছে। তারা মগধের দিক হতে কোনও ক্ষতি আশা করে না। পট্টমহিষী স্বয়ং অগ্রোদকার কন্যা হওয়ার কারণে তারা নিশ্চিত, মগধ তাদের প্রতি স্নেহদৃষ্টিতেই দেখে। উত্তর পাঞ্চালের রাজধানী অহিচ্ছত্রে নাগগণ যুদ্ধ নিয়ে বিশেষ ভাবিত নয়। মথুরাও। প্রতিষ্ঠানে কোনও প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যায়নি। নাগগণরাজ্যের মুখ্য নগরী পদ্মাবতী (পাওয়া), বেশনগর, ছিন্নকূট (ছিন্দওয়ারা), ইত্যাদি নগরীগুলি জঙ্গলাকীর্ণ, প্রস্তরসঙ্কূল। ব্যতিক্রম উজ্জয়িনী, বৌদ্ধভিক্ষুগণ ওই নগরীতে অধিক এবং ওই নগরীতে শ্রেষ্ঠীদের প্রাধান্য। গণরাজ্য বলে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিশেষ কোনও কেন্দ্রীভূত সেনাবল নেই!’ মহাবলাধিকৃত সুষেণ নীরবতা ভাঙলেন। ‘পরমভট্টারক! আমার বিবেচনায় অধিক যুদ্ধের আবশ্যকতা নেই। স্বল্পপ্রয়াসেই সমগ্র নাগগণব্যবস্থা সম্রাটের করতলগত হতে পারে। শুধু মহারাজাধিরাজের আদেশের অপেক্ষা!’ ক্ষণিক নীরবতা নেমে এল মন্ত্রণাগারে।

‘পরন্তু মগধ কেন আক্রমন করবে নাগগণরাস্ট্রের উপর? তারা তো গুপ্তসম্রাটকে কে কর দেয়। হতে পারে মহারাজ তার চতুর্গুণ ফিরিয়ে দেন উপহার হিসাবে। তবু তারা কর দেয়। তারা পরমভট্টারকের শ্রেষ্ঠত্য স্বীকার করে। হতে পারে তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে ঘৃণা করে। তারও কারণ আছে। জামদগ্নি রাম তাদের পুর্বজ কার্ত্যবীর্য্য অর্জুনকে নিহত করেছিলেন। কাশীনরেশ প্রদুম্ন্য তাদের পরাজিত করেছিল। সাম্প্রতিক অতীতে বাকোটক রাজারা তাদের আক্রমন করে তাদের ভূমি গ্রাস করেছিল। এরা সকলেই কিন্তু ব্রাহ্মন্যরাজবংশ। কিন্তু এই নাগগণ শৈব। সম্রাট সকল ধর্মের সমান প্রতিপালক। তাই আমার মনে দ্বিধা জাগছে। নাগরাজদুহিতা স্বয়ং আমাদের পট্টমহিষী। আর তা ছাড়া, এই মুহুর্তে ক্ষত্রপদের তারা প্রতিহত করছে। এটাও আমাদের স্মরণ রাখার প্রয়োজন, কুষানদের সাথে যুদ্ধে তারা জয়ী হয়েছিল। আর্যাবর্তে কুষান শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল তারাই। সুপ্ত নাগগণকে জাগ্রত করা ভীতিজনক!’ বসুগুপ্ত বললেন।

‘মহামন্ত্রী, মহাবলাধিকৃত, সান্ধিবিগ্রহিক, ধনঞ্জয়, জয়রথ! আপনারা কেউই আমার রাজনৈতিক লক্ষ্যটা ধরতে পারছেন না। কেবল অনাবশ্যক কার্য্যকারণের চারদিকে পরিক্রমা করছেন। আমার বিবেচনার নাগগন করপ্রদানকারী, আমার বিবাহসম্পর্ক, তারা শৈব ইত্যাদি সমস্ত কিছুই সত্য। কিন্তু সর্বাপ্রক্ষা গুঢ় কারণটি আপনারা অনুধাবন করেন নি। আমি গুপ্তসাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা করেছি। আমি জানি গুপ্তবংশীয় সম্রাটগণের কীর্তি ইতিহাসের কালখণ্ডে স্থান গ্রহণ করবে। তাই আমার নির্দেশে সমস্ত পুরাণ, ধর্মগ্রন্থ পুনর্লিখিত হচ্ছে। প্রত্যেক নগরীতে ভাস্কর্য্যময় মন্দির স্থাপিত হচ্ছে। সাহিত্য, শিল্পে একটি নূতন যাত্রার শুরু হচ্ছে। কিন্তু আপনারা ভেবে দেখেন কি, সাম্রাজ্যেও সবথেকে বড় শত্রু কে? নাগগণ? নাগগণ কি ক্ষত্রপদের থেকে অধিক বলশালী? উত্তরাপথের রাজাদের থেকে অধিক যুদ্ধপ্রিয়? উত্তর হোল, না। তা হলে তাদের আমি পরাজিত করতে চাইছি কেন? কারণ, ব্যবস্থা! শাসনব্যবস্থা। এটা অনুধাবন করতে পারেন না যে গণশাসনব্যবস্থা রাজতন্ত্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী? গণব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত শাসনকে অস্বীকার করে! তারচেয়েও বড় কথা, রাজার পুত্র বংশানুক্রমে রাজা হয়, আর গণব্যবস্থায় প্রজাদের মধ্যে থেকে গণপতি নির্বাচিত হয়। রাজতন্ত্রের ব্যবস্থার আপনাদের থেকে সাধারণ সৈন্য, সাধারণ কর্মচারি সকলেই রাজার বৃত্তিভোগী। কিন্তু গণব্যস্থায় তারা গণের অধীন। আপনাদের স্মরণে আছে অতীতে ব্রাহ্মণগণ রাজাকে দেবতার অংশ মনে করেছেন। জনগণের মনে রাজা যদি দেবতা অংশ হয়, তাহলে রাজার প্রতি তাদের ভক্তি বাড়ে। আর রাজারা ব্রাহ্মণদের পালন করেন, তাদের সমস্ত যজন, যাজন, ঐহিক সুখের ব্যবস্থা করেন। এর বাইরেও আরও একটা গভীর কারণ আছে। সমস্ত শাসন ব্যবস্থার মধ্যে গণব্যবস্থা সর্বাপেক্ষা সুলভ। তার ফলে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয় না। তাদের বহুস্তরীয় মন্ত্রী পরিষদ, যুদ্ধসজ্জা, সেনাবল, ভাট, দৌবারিক, পুরোহিত লাগে না। তাদের সৈন্যবল মুলত স্বেচ্ছাসৈনিক। কিন্তু সম্রাটের প্রয়োজন হয় সবকিছুর। কারণ এক বিরাট ব্যবস্থার শীর্ষে সম্রাট অবস্থান করেন।

তাই রাজতন্ত্রে গণরাজ্য একটি পৃষ্ঠব্রণ মাত্র। সে যতই ক্ষুদ্র অথবা শক্তিহীন হোক। আপনারা অবগত আছেন, যে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকা সত্বেও আমি লিচ্ছবী গণরাজ্যকে চুর্ণ করেছি। লিচ্ছবীগণ এখন আমার করদমাত্র। সেই কারণে আমি নাগগণকে অধিকার করতে চাই, গণরাজ্যকে ধ্বংস করতে চাই!’ মহারাজের মুখমণ্ডল আরক্ত, বাকি সকলে নীরব রইলেন।

অনতিপরে মহামন্ত্রী বসুগুপ্ত নীরবতা ভাঙ্গলেন, বললেন,’ সম্রাট! একটি নূতন ক্রীড়ার সাথে পরিচিত হয়েছি। সেটি যুদ্ধক্রীড়া । এখন পরমভট্টারক যদি অনুমতি করেন তো তাহলে সেইটি আনয়ন করতে বলি!’ মহারাজ সম্মতি দিলে পরিচারকগণ একটি চতুষ্কোণ বিশাল কাষ্ঠখণ্ড আনল। সেই কাষ্ঠখণ্ডটি চৌষট্টিটি সমান বর্গক্ষেত্রে বিভক্ত। তাহার মধ্যে বত্রিশটি বর্গক্ষেত্র লোহিতবর্ণের বাকি ক্ষেত্রগুলি শুভ্রবর্ণের। দুইপ্রান্তে ষোলটি করে মোট বত্রিশটি ক্রীড়নক, অর্ধেক লোহিত অর্ধেক শুভ্র। বসুগুপ্ত ব্যাখ্যা করলেন, ‘সম্রাট! এই ক্রীড়নকগুলি রাজা, মন্ত্রী, ও তার চারিটি বলের প্রতীক। পদাতিক, অশ্ব, গজ ও রণতরীর। দুই যুযুধান বলের সম্মুখের সারিতে পদাতিকগণ। তাহারা এক একবারে একটি ক্ষেত্র অতিক্রম করতে পারে, কিন্তু পশ্চাদোপসারণ করতে পারে না। অশ্বারোহীর চলন বিচিত্র। তারা দুইটিক্ষেত্র গমনপুর্বক দান অথবা বামদিকে একটি ক্ষেত্রে গমন করতে পারে। গজের কৌণিক গতি ও রণতরীর সরলগতি। মন্ত্রী এখানে মহারথ, সরল অথবা কৌণিক, সকল পথেই যেতে পারে!’ ‘আর রাজার গতি?’ সমুদ্রগুপ্ত প্রশ্ন করলেন। বসুগুপ্ত স্মিত হেসে বললেন, ‘সকল বলই রাজার অধীন, তাই এই ক্রীড়ায় রাজার গতি সীমিত, চতুর্দিকে একক্ষেত্র মাত্র!’ মহারাজ তরলকন্ঠে কহিলেন, ‘এ ভারী অন্যায়!’

‘আচার্য! শুদ্ধমনে যদি আমি দেবীকে আহ্বান করি, তাকে প্রসন্ন করি, তবে কি তিনি সাড়া দেবেন না? মন্ত্রের প্রয়োজন হয় কেন?’ রঙ্গবতী আচার্য মঙ্গলনাথকে প্রশ্ন করলো। মংগলনাথ মৃদু হেসে বললেন, ‘শুদ্ধাচারে, সর্বান্তকরণে দেবী চণ্ডিকাকে ডাকতেই হবে। সেটি প্রথম শর্ত। কিন্তু মন্ত্রোচ্চারণও করতে হবে!’ রঙ্গবতী চুপ করে জিজ্ঞাসু হয়ে রইল। মঙ্গলনাথ বলতে শুরু করলেন, ‘দেবভাষায় সকলবর্ণ দুই প্রকার, স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ। দেবী পার্বতী স্বরবর্ণস্বরুপা। ব্যাঞ্জনবর্ণগুলি সাতটি বর্গে বিভক্ত, ক চ ট ত প য ক্ষ এই সাতটি। ব্যঞ্জনধ্বনির সাথে স্বরধ্বনি যুক্ত হলে, তার মলদোষ নিবারিত হয়। চোদ্দটি স্বরবর্ণ এবং অনুস্বার ও বিসর্গ, এই ষোলটি বর্ণই শক্তির প্রতীক। শক্তির দ্বারা শুদ্ধ হলে ওই সাতটি বর্গ সপ্তমাতৃকার গুণ লাভ করে, তাই স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ মিলিতভাবে অষ্টমাতৃকা। এই মোট একান্নটি বর্ণকে মাতৃকাকলস বলা হয়। তারা হলেন, শক্তি, নিবৃত্তি, প্রতিষ্ঠা, বিদ্যা, শান্তি, ইন্ধিকা, দীপিকা, মোচিকা, পরা, সুক্ষ্ম, সুক্ষ্মামৃত, জ্ঞানামৃত, অপ্যপ্যানী, ব্যাপিনী, ব্যোমরূপা, অনন্ত, সৃষ্টি, রিদ্ধি, স্মৃতি, মেধা, কান্তি, লক্ষ্মী, দ্যুতি, স্থিরা, স্থিতি, সিদ্ধি, যদা, পালিনী, ঐশ্বর্য, রতি, কামিকা, বরদা, আহ্লাদিনী, পৃথ্বী, দীর্ঘা, তৃষ্ণা, রৌদ্রি, ভয়, নিদ্রা, তন্দ্রা, ক্ষুধা, ক্রোধিনী, ক্রিয়া, উৎকারী, মৃত্যুরূপা, পীতা, শ্বেতা, অসিতা, ও অনন্ত। প্রত্যেক বর্ণে মাতৃকা অলক্ষ্যে থাকেন। অক্ষর যুক্ত হয়ে পদ সৃষ্টি হয়, পদ থেকে বাক্য। বিশেষ রূপে যখন বাক্য গঠিত হয়, তখন মাতৃকাগণ তাতে পুর্ণরূপে প্রকাশিত হন। তাকেই মন্ত্র বলে!’ রঙ্গবতী চোখ বুজে শুনতে থাকে আচার্য মঙ্গলনাথের কথা। তার শরীর শিহিরিত হয়। হঠাট মনে হয় গ্রীষ্ম অতি প্রকট হয়েছে। উষ্ণতা বেশি অনুভব হচ্ছে। ঠান্ডা হাওয়ার জন্য রঙ্গবটী মন্দিরের প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াল। সেই সময়ে হঠাৎ ঈশানকোণে একটুকরো মেঘ ধেয়ে আস্তে লাগলো মত্ত হাতীর মত। বিকটভাবে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগলো, বজ্রের গম্ভীর শব্দে চারিদিক প্রকম্পিত হতে লাগল। তারপর শুরু হোল ধারাবর্ষন। রঙ্গবতীর পূর্বজীবন যেন ধুয়ে যেতে লাগলো। সিক্ত রঙ্গবতী নতুন জন্মে পদার্পণ করলো। তারপর এসে দাঁড়াল দেবীর সম্মুখে। তার দৃষ্টি শান্ত কিন্তু উজ্জ্বল।

অনঙ্গনাগ এসেছেন কাকোনাদবোটে, বেত্রবতীর অপরপারে বৌদ্ধসঙ্ঘে। মহাসঙ্ঘারাম এটি। পাঁচশত ভিক্ষু নিবাস করেন এখানে। এই সঙ্ঘারামের প্রধান ভিক্ষু মিলিন্দ। সংঘারামের তোরণটি অপুর্ব। তার প্রাচীর ভিতরের প্রাচীরগাত্রে বহুসংখ্যক ভাস্কর্য। কিন্তু অধিকানশই নারী মূর্তি। সকলই বোধ করি স্থানীয় শিল্পীদের সৃষ্টি। ভিক্ষুগণ যতই জাগতিক সুখ সম্পর্কে উদাসীন, সংঘারামে উৎকীর্ণ মূর্তিগুলি ততই আকর্ষক। এমনটা সম্ভব যে শিল্পীদের জীবনদর্শন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তুলনায় ভিন্ন। নারীমূর্তিগুলি পীনোন্নত পয়ধরা, মুখমণ্ডলে কেমন যেন উদ্ধত ভাব। হাতে অসংখ্য বলয়, কন্ঠে মালা ও হারের প্রাচুর্য। কর্ণাভরণগুলিও বিশেষ বিস্তৃত। বেশনগরের নারীরা অধুনা এত অলঙ্কার পরিধান করে না। কঙ্কণ, নূপুর, স্বর্ণমালা আর পাছড়াই অধিক। তবে রোহিলাখণ্ডের নারীরা এখনও এমনটাই সাজেন বটে। এই নারীদের মূর্তিতে জীবন যেন সকল আনন্দ নিয়ে উপস্থিত রয়েছে, অনঙ্গনাগ ভাবেন।

একটু অপেক্ষা করতেই ভিক্ষু মিলিন্দ দেখা দিলেন। অনঙ্গনাগ প্রনাম করলেন। ভিক্ষু আশীর্বাণী করলেন। ‘কিচ্ছো মনুসসপটিলাভো কিচ্ছং মচ্চান জীবিতং। কিচ্ছং সদ্ধম্মসবণং কিচ্ছো বুদ্ধানাং উপ্পাদো!’ অর্থাৎ মানবরূপে জন্ম নেওয়া অতি দুর্লভ, তবে মনুষ্যজীবনে থাকাও মুশকিল। মৃত্যু নিশ্চিত। সদ্ধর্ম শোনা দুর্লভ, বুদ্ধগণের উৎপন্ন হওয়াও দুর্লভ!’ অনঙ্গ বললেন, ‘ভন্তে! আমি আপনার সাথে একান্তে কিছু বলতে চাই!’ প্রধান ভিক্ষু মিলিন্দ বললেন, ‘আসুন, আমরা আমার কক্ষে যাই!’ ভিক্ষু মিলিন্দের নিজকক্ষটি প্রশস্ত, কক্ষের বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে পুঁথি ও শিক্ষাদানের সামগ্রী। একপাশে একটি চীবর, ভিক্ষাপাত্র ও জলের পাত্র। অন্যদিকে একটি পাথরের বেদীকা, তার উপর দুটি কম্বল সযত্নে রক্ষিত। আর একটি কাষ্ঠের ক্ষুদ্র বেদীকা। অনঙ্গ কাষ্ঠবেদীকায় বসলেন, ভিক্ষু নিজের শয়নাসনের উপরে। তারপর বললেন, ‘বলুন মহারাজ অনঙ্গনাগ!’

‘ভন্তে! আপনি নিশ্চই অবগত আছেন যে, নাগগণরাজ্যের উপরে যুদ্ধের কালো ছায়া ঘনিয়ে আসছে। এবং আশঙ্কা গুপ্তসাম্রাজ্যের দিক থেকেই। এই ব্যাপারে সঙ্ঘের ভূমিকা কি, তাই আমি অবগত হতে এসেছি!’ অনঙ্গ বললেন। কিছুক্ষণ নীরব রইলেন ভিক্ষু মিলিন্দ। তারপর শুরু করলেন, ‘গণপতি অনঙ্গ! আপনি নিশ্চই অবগত আছেন, ভগবান বুদ্ধ লিচ্ছবীর এক গণপতির গৃহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। গণরাজ্য নিয়ে তার ধারণা কি ছিল, তা আশাকরি আপনাকে বিশেষ বলতে হবে না। ভগবান তথাগত সমস্তপ্রকার কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন। হয়ত তার গৃহত্যাগের অপর একটি কারণও তাই। তাছাড়া তথাগত তার মহাপরিনির্বানের পূর্বে কোনও একজনকে তার উত্তরাধিকারী চিহ্নিত করে যান নি। তিনি ধম্ম, ও সঙ্ঘের উপর সকল আস্থা রেখেছিলেন। সঙ্ঘ কয়েকসময়ে রাজানুগ্রহ পেয়েছিল, কিন্তু সাম্রাজ্যের ব্যবস্থায় বিলয় হয়ে যায় নি। বরং রাজাকেই বুদ্ধের পথে টেনে এনেছিল, যেমনটা সম্রাট অশোকের কালে হয়েছিল। কিন্তু ভগবান বুদ্ধ তার জীবদ্দশার শেষভাগে ভিক্ষুণীদের বিহারে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন। আমাদের ধর্ম চিরকালই শ্রেষ্ঠীদের সমর্থন লাভ করেছে। ব্রাহ্মন্যপ্রথায় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় ব্যাতিরেকে আর সকলই ছিল অপাংক্তেয়। কৃষিজীবি ‘বিশ’ শব্দটি থেকেই বৈশ্য কথাটি সেছে। বৌদ্ধধর্ম সচেতনভাবে বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে থেকেছে। সদাচরণ ও শিক্ষাই আমাদের সঙ্ঘের শ্রেষ্ঠত্ব লাভের উপায়। অবশ্য শ্রেষ্ঠীদের ধনসাহায্য আমাদের প্রয়োজন। তাই তাদের কিছু শর্ত আমাদের মেনে নিতে হয়েছে। আমরা সৈনিক, ঋণগ্রস্ত ও ক্রীতদাসদের সঙ্ঘে ভিক্ষু হতে দিই না। এটা আমাদের যথেষ্ট পীড়া দেয়, কিন্তু তা মেনে নিতে হয়েছে। ভগবান বুদ্ধ তার শেষদিকে বলে গেছে, ‘এহিপশ্যতে’ অর্থাৎ এইজন্মেই পাপ পুণ্যের ফলাফল দৃষ্ট হবে। মনুষ্যকে তার মুল্য দিতে হবে। অতএব সদাচরণই সঠিক মুক্তির উপায়!’

অনঙ্গনাগ স্বল্প অধৈর্য হয়ে বললেন, ‘আমরা জানতে চাই ভন্তে, বৌদ্ধগণ আসন্ন যুদ্ধে কোন পক্ষে?’ ভিক্ষু মিলিন্দ বললেন, ‘শ্রেষ্ঠীগণ সর্বত্রগামী, তারা মগধরাজ্যেও বিশেষ সুবিধা ভোগ করে, আবার নাগগণরাজ্যেও। সম্রাট তাদের থেকে কর, শুল্ক নেন, গণরাজ্যও নেয়। প্রয়োজনে তারা ব্যাজের বিনিময়ে রাজাকে ঋণও দেয়। হয়ত দূর ভবিষ্যতে আসল রাষ্ট্রক্ষমতা শ্রেষ্ঠীদের হাতেই গচ্ছিত হবে, গণপতিরা বা রাজাগণ তাদের প্রতিনিধি হবেন। ব্রাহ্মণদের চিন্তা এটাই। ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের মুষ্ঠি ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসবে। হয়ত তারাও শ্রেষ্ঠীদের গুণগানে মুখর হবেন ভবিষ্যতে। আপনি জানেন গণপতি অনঙ্গনাগ, ভগবান তথাগত লিচ্ছবী গণসঙ্ঘের আদলে বৌদ্ধপন্থার সৃষ্টি করেছিলেন। এখানে কারও ব্যক্তিগত সম্পদ থাকবে না। এই বিহারসমূহ, ধনরাশি, ভূমিসম্পদ সকলই বিহারের। কিন্তু এই সময়কালে আমরা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করবো, যদিও আমাদের নৈতিক সমর্থন নাগগণসঙ্ঘের দিকেই থাকবে!’ ভিক্ষু মিলিন্দকে প্রণাম করে অনঙ্গনাগ বিদায় নিলেন।

পথে, অশ্বারোহে, অনঙ্গ চিন্তা করেন, ক্ষমতার কীট বড় নিষ্ঠুর। নীতিবোধও তার সাথে আপোষ করে, হয়তো পরাজয় মানে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বর্ষাঋতু সমাসন্ন। দ্রুত অশ্বচালনা করেন অনঙ্গ। তার স্ত্রীদের রেখে আসতে হবে পদ্মাবতীতে, জেষ্ঠা স্ত্রীর পিত্রালয়ে। অবশ্য কনিষ্ঠা স্ত্রী সাকেতে যেতে চায়, তার পিতৃগৃহে। দুই সন্তানদের অদর্শনের কথা ভেবে বিমর্ষ হন অনঙ্গনাগ। তিনি আকাশের দিকে তাকান। মহাকাল তার কাছে কি পরীক্ষা প্রত্যাশা করছেন?

বর্ষাঋতু শেষ হয়ে আসছে। আকাশ নির্মল, সুনীল। গ্রামগুলিতে দ্রুত ফসল কাটা চলছে। মগধসম্রাটের অধীন নগরীগুলিতে সাজ সাজ রব। যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সেনানী হতে ইচ্ছুক কৃষকদিগের বিশেষ করমুক্তি ঘোষনা করা হয়েছে। বিভিন্ন সৈন্যাবাসে কুচ কাওয়াজ শুরু হয়ে। নাগগণরাজ্যেও প্রস্তুতি চলছে অত্যন্ত গোপনে। অকস্মাৎ সেখানে একটি উৎসব শুরু হয়েছে। নারী পুরুষ সব একজায়গায় মিলিত হয়ে মদিরা পান করছে, নাচ, গান করছে। বয়োজ্যেষ্ঠ নাগগণ এ জিনিষ ভালো চোখে দেখছেন না। এ যেন বল্গাহীন, লজ্জাহীন যৌনতার উৎসব। মহাগণসংস্থাগারে এই নিয়ে গুঞ্জন উটেছে। আর এর উদ্যোক্তা হলেন গণপতি অনঙ্গ। এক সন্ধ্যায় মহাগণপতিকে অনঙ্গ আহ্বান করলেন, একটি উৎসব প্রাঙ্গণে। অগ্নিশলাকার আলোয় কাঁপছে শরীরগুলি। তাদের নৃত্য চলছে। মদিরা পানও চলছে। আর নাগ না হলে, তদুপরি পরিচিত না হলে, এই উৎসবে অংশগ্রহণ করা নিষিদ্ধ। তবুও নাগবয়োবৃদ্ধগণ এই উৎসব নিয়ে অসন্তুষ্ট। অনঙ্গনাগ ও মহাগণপতি উৎসব প্রাঙ্গণে এলেন। মদিরামত্ত যুবক যুবতীর মদিরার নেশায় তাদের শ্লেষজ্ঞাপক কথা ছুঁড়ে দিল। ‘বৃদ্ধকে একপাত্র মদিরা দাও, ওনার যৌবনে মরিচা পড়ে গেছে!’ অনঙ্গ মিটিমিটি হাসছিলেন। মহাগণপতি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট। তবু অনঙ্গের জোরাজুরিতে একপাত্র মদিরা গ্রহণ করতেই হোল। ‘শিব শিব! এতো জল, মদিরার গন্ধ আছে বটে!’ হতভম্ব হয়ে গেলেন মহাগণপতি। হো হো করে হেসে উঠল যতেক নাগ যুবক যুবতী। তারপর যথেষ্ট ক্ষমা প্রার্থনা করল মহাগণপতিকে ওরকম ব্যঙ্গ করার জন্য। মুহুর্তে বদলে গেল নাচের অভিনয়, ঝলসে উঠল অসি, লুকোন ভল্ল, নারাচ। লঘুপদে অস্ত্রচালনা করতে লাগল নাগযোদ্ধাগণ। অনঙ্গ জানালেন, প্রস্তুতির গোপনীয়তা রাখতেই এই অভিনয়। মহাগণপতি প্রসন্ন হলেন। মগধসম্রাটের নৌবহরকে নদীপথে কিভাবে গতিরোধ করা যায়, কিভাবে রণমাতঙ্গদের প্রতিহত করা যায়, এ সমস্ত পরিকল্পনা চলতে লাগল। সর্বত্র একইভাবে প্রস্তুতি থাকবে না, থাকা সম্ভবও নয়। কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত যাতে আমৃত্যু স্মরণ রাখেন এই যুদ্ধকে, তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। গণপতি অনঙ্গনাগ বললেন।

পট্টমহিষী দত্তাদেবীর কক্ষে পরমভট্টারক বীণা বাজাচ্ছেন। সমুদ্রগুপ্ত বীণাবাদনে অত্যন্ত দক্ষ। মৃদঙ্গ বাজাচ্ছে এক দাসী। বাদ্যবাদনে সে পটু। বাজাতে বাজাতে অকস্মাৎ বীণার তন্ত্রী ছিন্ন হোল, সুরচ্যুতি হল। বিরক্ত হলেন সম্রাট। অন্তরে কি কোথাও ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে? মুখ আরক্ত হোল মহারাজের, স্কন্ধের পিছনে ব্যথা অনুভব করলেন। সেইসময় এলেন পট্টমহিষী। বিষন্নপ্রতিমা। সম্রাটের বড় প্রিয় এই পট্টমহিষী। প্রায় কিশোরবেলায় বিবাহ করে এনেছিলেন তাকে। সমগ্র সাম্রাজ্যে কেউ যদি সম্রাটের মুখের উপর কথা বলার স্পর্ধা রাখেন তো তিনি দত্তাদেবী। ‘সম্রাট কি নাগগণরাজ্যের উপর আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছেন?’ ‘হ্যাঁ মহিষী!’ সম্রাট উত্তর করলেন। ‘নাগগণ তো আপনার প্রশংসক, পরমভট্টারক। আর তা ছাড়া, তারা তো কোনভাবেই গুপ্তরাজবংশের শত্রু নয়। তবু কেন এই যুদ্ধ সম্রাট?’ দত্তাদেবীর কন্ঠে হতাশা ঝরে পরে। সমুদ্রগুপ্ত নিরুত্তর থাকেন। তারপর আদেশ করেন, ‘একান্ত!’ ত্রস্তে দাসীগণ প্রস্থান করেন। মহারাজ পদচারণা করতে থাকেন। মহাদেবী পাথরের মত দণ্ডায়মান।

‘আকাশ উড্ডীয়মান পরিযায়ী পাখিদের দেখেছ, দেবী? এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে? লক্ষ্য করে দেখবে, কৌণিক আকৃতিতে তারা ওড়ে। দলের মধ্যে একটি পাখী সবার আগে চলে, বাকিরা পিছনে। বাতাসের বাধা কাটাতেই এই অবস্থান। পশ্চাদগামী পাখিরা কিছু কম ক্লান্ত হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে, অন্য একটি পাখি অগ্রবর্তী স্থান নেয়। এমনি করেই তারা বহুদূর যায়। গণব্যবস্থা এরকমই। গণপতির পুত্র জন্মসূত্রেই গণপতি হয় না। কিন্তু রাজার পুত্র রাজাই হয়। এই দুটি ধারা কখনও মিলিত হতে পারে না। একে অপরকে ছেদ করে, শাসিত প্রজাদের মনে। এই যে সৈন্যদল, বিলাসব্যসন, নামাঙ্কিত মুদ্রা, ঐশর্য্য, মহিমা, তা কি কোনও গণপতির সাধ্য? কিন্তু সম্রাটের করায়ত্ত। অতীতে সকল রাজ্যই গণরাজ্য ছিল। কেবল কোনও কোনও গণপতি রাজা হতে চেয়েছে। কেউ পেরেছে, কেউ পারেনি। কিন্তু গণব্যবস্থার পাশাপাশি রাজতন্ত্র থাকতে পারে না। স্থিতাবস্থা রাজতন্ত্রের বিষ। হয় রাজা ক্রমশ দেশের পর দেশ জয় করবেন, অথবা রাজ্য হারাবেন। স্থিতাবস্থার অর্থ দৌর্বল্য। গণরাজ্য আগ্রাসী নয়, তার বাসনাও নেই। অপরপক্ষে, যুদ্ধ না করলে, পররাজ্য গ্রাস না করলে সম্রাটের ধনভাণ্ডার প্রসারিত হতে পারে না, ক্রীতদাসের মিছিল আছরে পড়ে না রাজধানীতে। বিনামূল্যে শ্রম মানেই সম্পদ। ঐশর্য্য থাকলেই স্তাবককূল পালন করা সম্ভব, সে কবিই হোক বা ব্রাহ্মণ! স্তুতি আর যৌক্তিকতা দিয়ে তারা প্রজাকে ভুলিয়ে রাখবে সম্রাটের হৃদয়হীনতা। সম্রাটের লোভ, লালসাকে তারা মহানুভবতার প্রলেপ দেবে। তাই আমি গণব্যবস্থার ধ্বংস চাই। নাগগণের উপর আমার বিরাগ নেই, আমার শত্রু তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা। গণরাজ্য!’

‘পরন্তু আচার্য, এতো ছলনা।মানুষের বিশ্বাসের অবগুন্ঠনে মানুষকে প্রতারিত করা!” রঙ্গবতী প্রশ্ন করেছেল আচার্য মঙ্গলনাথকে। মঙ্গলনাথে বলেছিলেন, ‘মাতা, যুদ্ধ অনেক স্তরে হয়। সৈন্যগণ যেমন যুদ্ধ করে, তেমনি ধার্মিকগণও সমর করেন। কোনপক্ষেই ঈশ্বর বা অন্যকোনও দৈবশক্তি অবতীর্ণ হন না। তাদের ভক্তরা, স্বীয় দেবদেবীর নামে যুদ্ধ করে। কিসের জন্য? স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার জন্য। অর্থের জন্য, রাজানুগ্রহের জন্য। সেই হিসাবে আমাদের যুদ্ধ অত্যন্ত সরল। আমরা যুদ্ধ করবো মাতৃকাতন্ত্রকে রক্ষা করতে। একমাত্র গণব্যবস্থাই মাতৃকাতন্ত্রের রক্ষা করতে পারে। নচেৎ ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে আমাদের সমূল বিনাশ!’ রঙ্গবতী চুপ করে শুনল। তর্ক করার ইচ্ছা তার নেই। তবে কোথাও যেন তার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাচ্ছে। তবু সে এর অন্তিম দেখতে চায়। দেবী চন্ডিকার মনে কি আছে, কে জানে?

সেই রাত্রে রঙ্গবতী স্বপ্ন দেখে। সে এক প্রান্তরে একাকী। চারদিক আধো অন্ধকার, আর মাথার উপরে পুর্ণিমার কাকজ্যোৎস্না। সে বিভর হয়ে থাকে চরাচরের এই মায়াবী আলোয়। হঠাৎ সে দেখে তিনদিক থেকে ছায়ামূর্তিরা এগিয়ে আসছে। তাদের সাথে বাজনা বাজছে। ক্রমে তারা নিকটবর্তী হয়। ভয়ানক তাদের চেহারা। একদিকে ব্যাঘ্রচর্ম পরা ত্রিশুলধারী। তার দেহ বেয়ে অজস্র নাগ। তার সাথে কিম্ভুত সব মানুষ, কিন্তু তারা প্রেতের মত। পুরুষটির হাতে ডমরু বাজছে। তার পদসঞ্চার নৃত্যের মত। অন্যদিকে শ্বেতবর্ণের দৈত্যাকার মানুষ। তারা কেউ কেউ অশ্বারোহী। তাদের হাতে চক্র, পাশ, চাবুক। তাদের মধ্যে একজন অদ্ভুত মাদকীয় সুরে বাঁশি বাজাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে গম্ভীর ধ্বনিতে বেজে উঠছে অসংখ্য জলশংখ। মাঝখানে একদল নারী। উলঙ্গ, করালবদনী, লোলজিহ্বা। তাদের হাতে মানুষের ছিন্নমুন্ড। কারও হাহে ভল্ল, কার হাতে খড়গ। তাদের সাথে ছুটে আসছে শৃগাল, মুখে রক্তের দাগ। রঙ্গবতী সভয়ে পিছু হটতে থাকে। তার গলা শুকিয়ে আসছে, পদদ্বয় স্খলিত। সাড়া শরীর থরথর করে কাঁপছে রঙ্গবতীর। সে পিছনপানে ছুটে চলে যেতে থাকে। ছুটতে ছুটতে সে পৌছতে চায় এক জঙ্গলের কাছে। অরণ্য যত এগিয়ে আসে, সেই ছায়াময় অবয়বগুলিও নিকটে আসে, প্রায় তাকে গ্রাস করে। অকস্মায় সে অন্ধকারে ডুবে যায়। একটার পর একটা গাঢ় সবুজ পাতা তাকে ঢেকে দেয়। ঢাকতে ঢাকতে তাকে অন্ধকারের জঠরে নিয়ে যায়। রঙ্গবতী পরম নিশ্চিন্তে সেখানে ঘুমিয়ে পরে। অনেকক্ষন পরে সে জেগে ওঠে। চারদিক শীতল, অদ্ভুত গন্ধময়। গন্ধটা চেনা, অথচ অচেনা। সে চোখ খুলে দেখে তার যোনিপথ দিয়ে এক বৃক্ষ শিকড় মেলেছে। কোথাও জলপ্রপাতের শব্দ। বৃক্ষ বেড়েই চলেছে। সে চীৎকার করে ওঠে। গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বাহির হয় না। চোখ মেলে রঙ্গবতী দেখে, সে মন্দিরের চাতালে শুয়ে আছে। তখন ব্রাহ্ম মুহূর্ত। রঙ্গবতী নির্বাক হয়ে শুয়ে থাকে।

গুপ্তসাম্রাজ্য ছাব্বিশটি ভাগে বিভক্ত, সেগুলির নাম ভুক্তি। প্রত্যেক ভুক্তি আবার অনেকগুলি ‘বিষয়’এ ভাগ করা। প্রত্যেক বিষয় শাসন করেন একজন বিষয়পতি। বিষয়পতির একটি ‘অধিকরণী’ থাকে, তার সদস্য চার। তারা হলেন নগরশ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, প্রথম কুলিক, প্রথম কায়স্থ। সম্রাট সমুদ্রগুপ্তা পাটলীপুত্র সন্নিহিত সকল ভুক্তিকে তার রাজসভায় উপস্থিত থাকতে আদেশ করেছেন। মন্ত্রী বসুগুপ্ত প্রথমে এই আকস্মিক সভার উদ্দেশ্য বললেন। কিভাবে সকল সকল ভুক্তি রাজাদেশ পালন করবে, তাও বিবৃত করলেন। শ্রেষ্ঠীগণ প্রশ্ন করলেন, ‘বর্তমানে বানিজ্য সুস্থিরভাবেই চলছে, তা হলে নাগগণরাজ্য আক্রমণের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি?’ এবার সম্রাট নিজে সম্বোধন করলেন। ‘উদ্দেশ্য পশ্চিম উপকূল থেকে পুর্ব উপকূল, সর্বত্র এক অভিন্ন বানিজ্য শৃঙ্খলা রচনা করা। আপনারা এখন মগধ ও অন্যান্য রাজত্বকে শুল্ক দিয়ে থাকেন। পরবর্তীকালে কেবলমাত্র মগধকে শুল্ক দেবেন। আপনাদের শুল্কের পরিমাণ কম হবে। তবে আসন্ন যুদ্ধের জন্য যে ব্যয় হবে, তার একটি অংশ আপনাদের বহন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সর্বত্র এক অভিন্ন মুদ্রা প্রচলিত হলে, আপনাদের বিনিময়ের শ্রম ও খরচ লাঘব হবে। তাই আমার ইচ্ছা, আপনারা দ্বিধাহীন হয়ে সাহায্য করুন!’ সম্রাটের এই আদেশের পর সভা ভঙ্গ হয়ে গেল। সম্রাট একাকী মন্ত্রণাগৃহে যান, বিশেষ দাস চষকে মদিরা পূর্ণ করে দেয়। মদিরা আস্বাদন করতে করতে মহারাজ বিভিন্ন চিন্তায় ডুবে যান। এই মদিরাটি রোমক দেশীয়, এক শ্রেষ্ঠী সম্রাটের জন্য নিবেদন করেছিলেন। উত্তম স্বাদের, সমুদ্রগুপ্ত মনে করেন। তার রাজত্বে সকল ধর্মাচরণকারীদের অবাধ স্বাধীনতা। কিন্তু রাজধর্ম কি হবে, তা কি রূপে ঠিক হবে? মগধে শৈবগণ, শাক্তগণ, বৈষ্ণব, বৌদ্ধরা, জৈনরা সকলেই সুখে নিজধর্ম পালন করে। বৌদ্ধ ও জৈনরা শ্রেষ্ঠীদের বদান্যতা প্রাপ্ত। তাই তাদের বিরুদ্ধাচারণ করা অসঙ্গত। শৈবরা কাশী ইত্যাদি রাজ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী, কিন্তু তারা রাজশক্তিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে না। সেই হিসাবে বৈষ্ণবগণ নৃপব্যবস্থায় আস্থা রাখেন। আর্যাবর্তে অধিকাংশ ব্রাহ্মনগণ শৈববিরোধী এবং রাজতন্ত্রের সমর্থক। সম্রাট ইদানীং ভগবান বিষ্ণুর দিকে ঝুঁকেছেন। তিনি মনস্থ করেছেন সাম্রাজ্যব্যাপী বিষ্ণু মন্দির স্থাপনায়। সেই লক্ষ্যে দেবগৃহে (দেওঘর) একটি সুরম্য ‘দশাবতার’ মন্দির রচনার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা করবেন, সকল ধর্মের প্রতি সমান দৃষ্টি থাকলেও, তিনি রাজধর্ম হিসাবে বিষ্ণুভক্ত। সামনে যুদ্ধ। সে যুদ্ধ গণরাজ্য ব্যবস্থাকে চুর্ণ করার, আবার অলক্ষ্যে বৈষ্ণব ধর্মকে বলশালী করার। যাতে বৌদ্ধগণ ও জৈনগণ কিঞ্চিৎ চাপে থাকে। শাক্তদের নিয়ে মহারাজের চিন্তা। শাক্তগণ নিশ্চুপ থাকে, কিন্তু ধর্মটি লোকায়ত, এবং গ্রামীকদের মধ্যে অখণ্ড প্রভাব।

পাটলীপুত্রের সেনাবাসের পার্শ্বে অস্থায়ী সেনাবাস তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন ভুক্তি থেকে আগত সেনাও কৃষকদের স্থান সেখানে হয়েছে। রণহস্তীরা থাকার জন্য বৃহদাকার হাতিশালা ও অশ্বের জন্য অশ্বশালার নির্মাণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে উভয়পক্ষের গুপ্তচর প্রবেশ করেছে। প্রতিদিন খাদ্য যোগানের জন্য হাজার রন্ধনশালা নির্মিত হয়েছে। মোট লক্ষাধিক বল সমবেত হয়েছে। মহাবলাধিকৃত সুষেণ এই সমস্ত ব্যবস্থার দায়িত্বে আছেন। এমনকি মনোরঞ্জনের জন্য শত শত নগরবনিতা, বহুরুপী, সঙ্গীতশিল্পী ভিড় জমিয়েছে।

শীতলামন্দিরে অধুনা ভক্তসমাগম বেড়ে গিয়েছে। দেবী চণ্ডিকার মন্দিরেও। পুজারী সুবর্ণনন্দী দুজন পূজারিণী নিযুক্ত করেছেন। তারা সকলেই গ্রামিক, পাটলীপুত্র নগরীর নয়। দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে দীপের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। দীপালোকে চণ্ডিকার দৃষ্টি যেন প্রখরতর। সকলেই অগমকূপটি সম্ভ্রমের সাথে দর্শন করে। এই আকস্মিক পরিবর্তন গুঢ়পুরুষদের দৃষ্টি এড়ায় না। এমনই এক সন্ধ্যায় এক যোগিনীর আগমন হল মন্দিরে। শোনা গেল কুরুবর্ষের যোগিনীপুর (দিল্লী) থেকে তিনি এসেছেন, চণ্ডিকার একান্ন পীঠ পরিভ্রমন করছেন তিনি। অন্তিমে প্রাগজ্যোতিষপুরের কামাখ্যায় যাবেন তিনি। এই যোগিনী উদ্ভিন্নযৌবনা, দীপ্তিময়ী। প্রায়ান্ধকারে তার উজ্জ্বল চোখ দেখা যায়। প্রসাধনহীনা এই যোগিনীর কেশ চূড়াকৃত, ললাটে রক্তটিকা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। দেবী একাহারী। সাধারণত বাক্যালাপ করেন না। এ রকম বহু কথা প্রচার হতে লাগল।

এক সন্যাসী গণপতি অনঙ্গনাগের দর্শনপ্রাথী হলেন। অনঙ্গনাগ তাকে সাদরে বিশেষকক্ষে নিয়ে গেলেন। সন্যাসী তাকে একটি রক্তবস্ত্রের পুঁটুলি দিলেন, তার মধ্যে একটি রৌপ্যমুদ্রার সাথে একটি কার্ষাপণ বাঁধা। অনঙ্গ স্মিত হাসলেন। সন্যাসী বিদায় নিলেন। বর্ষাঋতু প্রায় বিদায় নিচ্ছে। শরৎ সমাসন্ন। আকাশে তবু মেঘ আর নীলাকাশ, এক অদ্ভুত চিত্র তৈরি করেছে। অনঙ্গ রঙ্গবতীর কথা চিন্তা করেন। তার ললাটে চিন্তার রেখা গভীর হয়ে আসে।

সম্রাটের বিশেষ দূত এসেছেন চণ্ডিকা মন্দিরে, সসৈন্যে। তিনি জানালেন, পরমভট্টারক নবাগতা যোগিনীর দর্শনপ্রার্থী। প্রাসাদের তাকে আমন্ত্রণ করেছেন। সুবর্ণনন্দী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাকে থামিয়ে দিয়ে যোগিনী বলল, ‘সম্রাট আমায় আমন্ত্রণ করেছেন। তিনি সর্বশক্তিমান। আমাকে যেতেই হবে। তবে মান্যবরের কাছে অনুরোধ, আমি যোগিনী, দেবী চণ্ডিকার সাধিকা। তাই নগ্নপদে পদব্রজেই যাবো নৃপসন্দর্শনে। আমি সম্রাটের প্রেরিত শিবিকায় যাবো না!’ রাজদূত আর জোর করলেন না, একেই মন্দিরে সৈন্য নিয়ে প্রবেশ করাতে তার নিজেরই অস্বস্তি হচ্ছিল। বললেন, ‘মাতা, আপনার ইচ্ছাই শিরোধার্য!’ যোগিনী চললেন সম্রাটের প্রাসাদের নগ্নপদে, সৈন্যদল ও শিবিকা তার পিছনে পিছনে চলল। প্রাসাদের দুয়ারে দাসীগণ এসে তার পদপ্রক্ষালন করে দিল। সম্রাট বিশেষ কক্ষে অবস্থান করছেন। প্রহরী তাকে সেইদিকেই যাবার ইংগিত করল।

উপবিষ্ট সম্রাটকে নমস্কার করল সাধিকা। ‘পরমভট্টারক সম্রাটকে যোগিনীর প্রনাম!’ সমুদ্রগুপ্ত যোগিনীকে সহাস্যে পর্যবেক্ষণ করলেন। তীক্ষ্ণ নাসা, মরালগ্রীবা, স্তনভারনম্র, ক্ষীণকটি, গুরুনিতম্বিনী, দীর্ঘাঙ্গী কিন্তু শ্যামা। ‘সাধিকা বা যোগিনীর নাম?’ সম্রাট প্রশ্ন করলেন। ‘একান্ত সম্রাট। আমার প্রার্থনা!’ যোগিনী অনুনয় করলো। মৃদু হাস্যে সম্রাট অনুমোদন করলেন। প্রহরীগণ নিঃশব্দে অন্তর্হিত হোল। ‘আমার পুর্বাশ্রমের নাম, রঙ্গবতী।

কুরুবর্ষের যোগিনীপীঠের অদূরে আমার বাস ছিল। মাতাপিতা ক্রীতদাস হয়ে যাবার পর এক শ্রেষ্ঠী আমার গৃহে স্থান দিয়েছিলেন, দাসী হিসাবে। বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তিনি আমাকে এক গণিকার কাছে বিক্রয় করে দেন। সেই গণিকা আমায় আশ্রয় দেয়। আমি ক্রমে নগরনটীতে পরিণত হই। পরে আমি মাতা চণ্ডিকার শরণে আসি। সেই থেকে আমি মাতা চণ্ডিকার সাধিকা, যোগিনী, মহারাজ!’ অম্লানবদনে এইরূপ অর্ধসত্য বলাতে নিজেই নিজের উপর বিস্মিত হোল রঙ্গবতী। সাধিকার বয়ানে কোনও খুঁত দেখলেন না সমুদ্রগুপ্ত। ‘দেবী অত্যন্ত আকর্ষনীয়া। দেবীর আর কোনও বিশেষ গুণ?’ সম্রাট প্রশ্ন করলেন। ‘মাতা চণ্ডিকার প্রসাদে, আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। তবে প্রকাশ করা নিষেধ, সম্রাট!’ ‘সম্রাট আদেশ করলেও?’ ‘তবে একান্তে, গোপনে একবারে একটিমাত্র প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি!’ রঙ্গবতী মৃদুস্বরে বলল। ‘গুপ্তরাজবংশের ভবিষ্যৎ কি, দেবী? রাজন তীক্ষ্ণকন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন। রঙ্গবতী খানিকক্ষণ নীরব রইল। তারপর চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবল। তারপরে ধীরে ধীরে বলল, ‘অদূর ভবিষ্যতে কিঞ্চিৎ মেঘাচ্ছন্ন, পরমভট্টারক!’ নিঃশব্দে শুনলেন সম্রাট। গঙ্গার একঝলক বাতাস এসে লাগল রঙ্গবতীর শরীরে। পরিধেয় বস্ত্রটি স্থানচ্যুত হোল ক্ষণিকের জন্য। তার বিল্বফলসম স্তনদ্বয় দৃশ্যমান হোল। সম্রাট লক্ষ্য করলেন, উপভোগও করলেন। রঙ্গবতী দেখলো সম্রাটের দৃষ্টিতে বাসনার ছায়া। রঙ্গবতী বিব্রত সলজ্জ হাসি হাসল। ‘মেঘাছন্ন কোন দিক থেকে? সমুদ্রগুপ্ত প্রশ্ন করলেন। ‘এই মুহুর্তে তা বলা সম্ভব নয়, মহারাজ। দেবীর কাছে নিবেদন করতে হবে। তার প্রত্যাদেশ পাবার আশায় বসে থাকতে হবে!’ ‘বেশ। তবে দেবী চণ্ডিকার প্রত্যাদেশ না পাওয়া অবধি, আমার অনুমতি ছাড়া পাটলীপুত্র ত্যাগ করবেন না, দেবী। এই আমার আদেশ! ‘আমার স্মরণে থাকবে, পরমভট্টারক!’ আর একবার মহারাজকে প্রণাম জানিয়ে রঙ্গবতী মন্দিরে ফিরে গেলেন পদব্রজে। নগরে সকলের সাথে ব্রাহ্মণেরা দেখল, মাতৃকাতান্ত্রিক সাধিকার রাজগৃহে গমন।

সমুদ্রগুপ্ত মদিরার আদেশ করে ভাবতে লাগলেন রঙ্গবতীর কথা । গুপ্তরাজবংশের ভাগ্যাকাশ মেঘাচ্ছন্ন? এত আকর্ষনীয়া রমণী সাধিকা হোল কেন? আর এইসময়ে পাটলীপুত্রে তার আগমন হোল কেন? চষক হেকে মদিরাপান করেন সম্রাট। তার রনিবাসে সহস্র রমণী আছে, বিভিন্ন দেশীয়। কিন্তু এই রমণী আলাদা। মহারাজ যৌন আকর্ষন অনুভব করলেন, কিন্তু সেটি গোপন রাখতে হবে। বিশেষ করে যুদ্ধের প্রাক্কালে। নারীর চিন্তা মনকে বিক্ষিপ্ত করে, যা যুদ্ধ পরিকল্পনার পক্ষে মঙ্গল নয়। প্রবারণ আসন্ন। কিন্তু সম্রাটের চিন্তায় চকিতে রঙ্গবতীর মুখ ভেসে ওঠে। মদিরাপান কি অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। কপালের শিরা দপ দপ করছে কেন? মহারাজ ভিষগাচার্য্য সুশ্রুতকে স্মরণ করলেন।

ভিষগাচার্য্য সুশ্রুতের ভ্রুকুঞ্চিত হোল। তিনি সম্রাটের নাড়ি বারংবার পরীক্ষা করছেন। সম্রাটের স্কন্ধের ব্যথাটিও তাকে চিন্তিত করেছে। অবশেষে তিনি নিবেদন করলেন, ‘পরমভট্টারক! আপনার রক্তচাপের আধিক্য ঘটেছে। মানসিক উত্তেজনার প্রশমন ঘটানো প্রয়োজন। আর প্রয়োজন বিশ্রাম। মহারাজকে বাধ্য করি, এমন দুঃসাহস আমার নেই। মহামন্ত্রী বসুগুপ্ত, মহাদেবীকে জানানো দরকার। একমাত্র তিনিই পারেন সম্রাটকে আমার নিদান মান্য করাতে!’ আর সেইসময়ে পট্টরাণি দত্তাদেবী প্রবেশ করলেন। এবং মহারাজ কিছু বলার আগেই দৃরস্বরে বললেন, ‘মহারাজ, এই ক্ষণে আপনি আমার নিবাসে পদার্পণ করুন। এই আমার ইচ্ছা!’ মহারাজ সকলের দিকে তাকালেন। মহাদেবীর বাক্যে সকলেই মৌনসম্মতি দিলেন। সমুদ্রগুপ্ত চিন্তা করলেন, বিশ্রামের সাথে সাথে দ্রুত দূর হয়ে যাবে এই অস্বস্তি। ধীর পদক্ষেপে তিনি চললেন মহারাণীর রনিবাসে। সাথে ভিষগাচার্য্য, মহামন্ত্রী এবং দাসীপরিবৃত পট্টমহিষী দেবী দত্তাদেবী।

মন্দিরে ফিরে এসে আচার্য্য সুবর্ণনন্দীকে সকলকথার বিবরণ দিল রঙ্গবতী। তিনি শুধু বললেন, ‘এবার দেবী চণ্ডিকার ইচ্ছা!’ ‘কিন্তু আমার মনে কিছু প্রশ্নের উদয় হয়েছে, আচার্য্য!’ রঙ্গবতী আচার্য্য সুবর্ণনন্দীর দিকে তাকায়। সুবর্ণনদী বিস্মিত হয়ে বলেন, কি প্রশ্ন, মাতা?’ ‘আচার্য্য! যে মাতা পার্বতী আমাদের সকলের সৃষ্টিকর্ত্রী, সকল পৃথিবীর পালনকারী, তিনি দেবী চণ্ডিকার রূপ ধারণ করেন কেন? কেন তার লোল জিহ্বা, কেন তিনি করালদ্রংষ্ট্রা?’ আচার্য্য সুবর্ণনন্দী স্তম্ভিত হয়ে যান। ‘এ প্রশ্নের উত্তর তুমি পাবে মাতা, একটু ধৈর্য ধারণ করো!’

শরৎ পূর্ণিমার প্রভাতে কাড়া নাকাড়া, তুর্য, শিঙ্গা বেজে উঠল পাটলীপুত্রে। অগ্রে মহাবলাধিকৃত সুষেণ সুসজ্জিত রণহস্তীর উপর আসীন। তার পার্শ্বে সান্ধিবিগ্রহিক সিংহবর্মা অশ্বপৃষ্টে। গঙ্গাবক্ষে রণতরীর সারি। সুমুখে মকরমুখী রণপোতে নৌবলাধিপতি ছন্দকসেন। তীরন্দাজ সৈন্যগণের হাতে বিশেষ ধনু, লৌহ আবৃত বাঁশের। অন্যান্যদের হাতে ঢাল ও তরবারি। কারও হাতে ভল্ল। অশ্বারোহী সৈন্যরা ভল্লই ব্যবহার করে, তীর ধনুক তারা ব্যবহার করে না। বল্গা ছেড়ে দিয়ে তীর ছোঁড়ায় তারা অভ্যস্ত নয়। বিপুল সেনার সাথে চলেছে অতিরিক্ত অস্ত্রসম্ভার, রসদ, চিকিৎসকগণ। স্থির হয়েছে তারা প্রয়াগ অতিক্রম করে যমুনাতীরের পথ ধরবেন। প্রথম লক্ষ্য অগ্রোদকা। অগ্রোদকা নাগদিগের অত্যন্ত বর্ধিষ্ণু নগরী। এককালে নাগগণরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বড়শিবদের শাসনাধীন ছিল অগ্রোদকা। এখন মথুরার নাগগণসঙ্ঘের নগরী অগ্রোদকা।

শত্রু বিশেষ বলশালী নয়, তাছাড়া সম্রাটের শরীরও দীর্ঘ যুদ্ধযাত্রার জন্য প্রস্তুত নয়। তাই তিনি পাটলীপুত্র থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। প্রতিদিন দুবার ঘোড়সওয়ার বার্তাবাহক আসবে সর্বশেষ পরিস্থিতি জ্ঞাত করাতে। অন্য ঘোড়সওয়ার নিয়ে যাবে সম্রাটের বার্তা। তাছাড়া মহাবলাধিকৃত সুষেণ অসংখ্য যুদ্ধের অভিজ্ঞ সেনানায়ক। ধীর ধীরে সৈন্যবল প্রয়াগ অতিক্রম করল। কৌশাম্বীর অন্তর্গত এই যুক্তবেণী মহাতীর্থ বলে কথিত। গঙ্গার ও যমুনার ধারা স্পষ্ট হলেও সরস্বতী অদৃশ্য। ইতোমধ্যে গুঢ়পুরুষগণ খবর এনেছে, অগ্রোদকায় কোনও যুদ্ধপ্রস্তুতির লক্ষণ চোখে পড়ে নি। সুষেণ চিন্তা করলেন, নাগগণের নিশ্চিত কোনও বিশেষ পরিকল্পনা আছে। সাবধানের মার নেই। তিনি অধীনস্থ বলাধ্যক্ষদের আদেশ করলেন, যাত্রার গতি দ্বিগুন করতে। ঝঞ্ঝার গতিতে আছড়ে পড়তে হবে অগ্রোদকায়। নাগগণ যেন কোনও প্রকার প্রস্তুতির সুযোগ না পায়। প্রয়াগ থেকে অগ্রদকা সাধারণত এক মাসের পথ, এখন চৌদ্দ দিনে এই পথ অতিক্রম করতে হবে। প্রভাত থেকে সায়ংকাল পর্যন্ত বিনা বিশ্রামে যাত্রা। সায়ংকালে শুধু বিরতি হবে আহার ও বিশ্রামের। প্রয়াগ থেকে অগ্রোদকা প্রায় সত্তর যোজন পথ। একপক্ষকালের মধ্যে এই পথ অতিক্রম করতে হবে। আগামি পূর্ণিমায় অগ্রোদকা অধিকার করা চাই।

পক্ষকাল বিশ্রামের ফলে মহারাজাধিরাজ সমুদ্রগুপ্ত সুস্থ হয়েছেন। নবোদ্যমে তিনি সৈন্যবলের অনুপুঙ্খ সংবাদ নিচ্ছেন, নির্দেশ পাঠাচ্ছেন মহাবলাধিকৃতকে। মহাদেবী পদ্মাবতী চিন্তিত। শুধু মহারাজের শরীর নিয়ে নয়, নাগগণরাজ্যে দুর্ভাগ্য নিয়েও। মাতা শীতলার ভক্তবৃন্দের ছদ্মবেশে আসা বার্তাবহদের কাছ থেকে সংবাদ পাচ্ছেন সুবর্ণনন্দীও। প্রতিটি তুচ্ছ সংবাদও প্রেরিত হচ্ছে পদ্মাবতী নগরীতেও, নাগদের মহাগণসংস্থাগারে। সম্ভাব্য রণাঙ্গনকে মূলত তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে। এবং শক্তি অনুযায়ী মগধসেনাকে প্রতিস্পর্ধা দর্শন করা হবে, এই স্থির আছে। শত্রুসেনাকে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়াই প্রাথমিক লক্ষ্য। প্রত্যেক রণাঙ্গনের জন্য ভিন্ন রনকৌশল। সমুদ্রগুপ্তের আদেশে রণপোতগুলি যমুনা ত্যাগ করে বেত্রবতীতে প্রবেশ করল। সে সংবাদ পৌছল নাগমহাগণসংস্থাগারে।

চাঁদের আলোয় চরাচর ধুয়ে যাচ্ছে। ফসলের ক্ষেতগুলি শষ্যহীন, চন্দ্রবিভায় অপার্থীব দেখাচ্ছে। দূরে দূরে গ্রামগুলি নিদ্রায় বিভোর। পথক্লান্ত মগধসেনা অগ্রোদকার উপান্তে পৌঁছল। অল্প বিশ্রাম। প্রত্যুষের আলো ফোটার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে অগ্রোদকার উপর। এমনই বহাবলাধিকৃত সুষেণের নির্দেশ। কিন্তু কোনও প্রতিরোধের চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না। সুষেণ আশ্চর্য হয়ে গেলেন। প্রভাতে মগধসৈন্য ব্যুহ রচনা করে আক্রমণ করতে যাবে, এমন সময় দুজন মানুষকে দেখা গেল, তারা এদিকেই আসছেন। সৈন্যদের অস্ত্রচালনা করতে বারণ করা হোল। চারজন অশ্বারোহী তাদের নিকটবর্তী হতে, তারা বলল, গণপতি দেবনাগের বিশেষ বার্তা তারা মহাবলাধিকৃতকে দিতে চান। তাদের নিয়ে আশা হোল ব্যুহের মধ্যস্থলে, সুষেণের সম্মুখে। তারা প্রনাম করে বলল, ‘মহারাজাধিরাজ মগধসম্রাটকে প্রনাম! প্রনাম মহাবলাধিকৃত সুষেণকে। অগ্রোদকার গণপতি দেবনাগ আপনাদের সকলকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, অগ্রোদকায় আতিথ্য গ্রহণ করার জন্য। মগধসেনার সাথে যুদ্ধ করি, এমন সাধ অথবা অভিপ্রায় নাগগণের নেই। আমাদের নিবেদন, আপনারা অস্ত্র সংবরণ করতঃ অতিথির মত অগ্রোদকায় পদার্পণ করুন!’ ‘আপনারা কে? পরিচয় দিন!’ সান্ধিবিগ্রহিক সিংহবর্মা কর্কষস্বরে বলে উঠলেন। ‘সান্ধিবিগ্রহিক সিংহবর্মা! ইনি নাগগণপতি দেবনাগ আর আমি অগ্রোদকার মহাকাল মন্দিরের পুরোহিত শার্ঙ্গদেব! আমাদের আপনারা পণবন্দী রাখতে পারেন। অবশ্য নাগগণ ছলের আশয় নেয় না!’

লজ্জিত সুষেণ হস্তীপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করলেন। দেবনাগের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। তারপরে বললেন, ‘চলুন গণপতি দেবনাগ। আমরা অতিথির মতই অগ্রোদকায় যাবো!’ সংবাদবাহী অশ্বারোহী ছুটল পাটলীপুত্রের দিকে। মহাবলাধিপতি সুষেণের নির্দেশে মগধসেনা ব্যুহভঙ্গ করল। তারপর তারা চলল অগ্রোদকা নগরীতে। পুরনারীগণ তাদের উপর পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগল। পাটলীপুত্র থেকে যাত্রা করে একমাসের পথ অগ্রোদকায় তারা পৌছেছে। এখন বিশ্রাম দরকার। তা ছাড়া যুদ্ধ যখন হচ্ছে না, বাহিনীর মধ্যে বেশ স্বস্তির ভাব। সাতদিন বিশ্রাম নিয়ে মগধবাহিনী রওয়ানা হল মথুরার দিকে। মথুরাকে নাগগণরাজ্যের পুর্বদিকের রাজধানী বলা যেতে পারে। অত্যন্ত প্রাচীন নগরী। অত্যন্ত সুরম্যও বটে। শ্রীকৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত নগরী এই মথুরা। এই নগরীর প্রতিটি ধূলিকণায় আছে ইতিবৃত্ত। আছে বাঁশরীর সুরমুর্ছনা। প্রতিটি তমালতরুমূলে আছে প্রেমঘন নিবদন। অগ্রোদকায় যা ঘটেছিল, মথুরাতে তার অন্যথা হোল না। বরং আতিথেয়তা চতুর্গুন হোল। মগধপট্টমহিষীর পিত্রালয় বলে কথা। সৈন্যগণের মধ্যে যুদ্ধ উন্মাদনা হ্রাস হয়ে গেল। এত প্রায় দেশভ্রমণের মত। এই যুদ্ধাযাত্রার কি প্রয়োজন ছিল, তা নিয়ে সেনানায়কদের মধ্যে সন্দেহ হতে লাগল। কেউ কেউ ভাবল, একটু আমোদ করা যাক। মাসাধিককাল বড় পরিশ্রম হয়েছে। সেনাদের মধ্যে যারা নিয়মিত নয়, শৃঙ্খলা তাদের স্বভাবতই কম। তাদের নিয়েই চিন্তা। সিংহবর্মা অশ্বারোহণে নগরী পরিভ্রমণ করছেন, লক্ষ্য করলেন, এক মগধসৈনিক এক নাগরমনীকে বলপুর্বক ধরে নিয়ে যাচ্ছে অস্থায়ী সেনাবাসের দিকে। তা হাতের চাবুক ঝলসে উঠল। মথুরার বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণের বার্তা মগধে সমুদ্রগুপ্তের নিকট প্রেরিত হোল।

পরমভট্টারক মন্ত্রণাগারে আসীন। মহামন্ত্রী সহ আরও অনেক অনেক মন্ত্রীগণ আছেন। উপস্থিত আছেন বসুসেন। অগ্রোদকা ও মথুরার আত্মসমর্পণের বার্তা এসে পৌঁছেছে। স্বস্তিদায়ক সংবাদ, কিন্তু পরক্রমাঙ্ক সমুদ্রগুপ্ত চিন্তাকূল। তারপর বহু মত বিনিময় হবার পর মহারাজ আদেশ দিলেন, ‘সৈন্যবাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত হোক। এক অংশ আরও উত্তরে গমন করুক। তাদের প্রথম লক্ষ্য হবে অহিচ্ছত্র। সন্ধিবিগ্রহিক সিংহবর্মা তার নেতৃত্ব দেবেন। তার সাথে মগধের সুশিক্ষিত অশ্বারোহী বল থাকবে। আর মহাবলাধিকৃত যাবেন মধ্যদেশে, নাগগণের রাজধানী পদ্মাবতীতে। আর যে সমস্ত যুদ্ধপোত যমুনায় আছে, তারা যমুনা থেকে দুইভাগে ভাগ হয়ে বেত্রবতী ও কালীসিন্ধ নদীতে প্রবেশ করবে!’ সম্রাটের নির্দেশ নিয়ে দ্রুতগামী দূতগণ রওয়ানা হোল মথুরার উদ্দেশ্যে।

মথুরাতে পক্ষকাল অতিবাহিত হোল মগধসেনার। সম্রাটের নির্দেশ পৌঁছল, এবার বাহিনী দ্বিধাবিভক্ত হয়ে, এক অংশ যাবে উত্তরাভিমুখে আর অপর অংশ অভিযান করবে দক্ষিণে। উত্তরে লক্ষ্য অহিচ্ছত্র সমেত সমগ্র উত্তরাপথ, তার দক্ষিণে মধ্যদেশে অবশিষ্ট নাগগণসঙ্ঘ। স্থির হোল মহাবলাধিকৃত সুষেণ যাবেন দক্ষিণে আর সান্ধিবিগ্রহিক সিংহবর্মা নেতৃত্ব দেবেন উত্তরমুখী বাহিনীর। সিংহবর্মার অভিযান শেষ হবে পুরুষপুরে(পেশোয়ার) আর সুষেণ যাবেন, সমগ্র নাগগণরাজ্যগুলি বিজয় করে, উজ্জয়িনীতে। মথুরাতে কিছু সৈন্য থাকবে। বেত্রবতী ও কালীসিন্ধ নদীতে রণপোতগুলি মহাবলাধিকৃত সুষেণের সাথে একযোগে মধ্যদেশ বিজয়ে অংশগ্রহণ করবে। এরই মধ্যে ওই সেনা কতৃক নাগরমনীর উপর অত্যাচারের ঘটনাটি সিংহবর্মা বিস্মৃত হলেন নূতন যুদ্ধোদ্দ্যমের ব্যস্ততায়। ত্রিশ সহস্র বল নিয়ে সিংহবর্মা উত্তরাপথের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পঞ্চাশ সহস্র বল নিয়ে সুষেন মধ্যদেশের প্রতি ধাবিত হলেন। তার প্রথম লক্ষ্যস্থল গোপাচল (গোয়ালিয়র)। সুষেণ মনে করেছিলেন অগ্রোদকা, মথুরার ন্যায় মধ্যদেশে কোনও বাধা আসবে না। তিনি যে ভুল করেছিলেন, তা অচিরেই প্রমাণিত হোল।

মধ্যদেশ জংগলাকীর্ণ। বিশাল বাহিনী অনায়াসে যেতে পারে না। তার উপরান্তে পর্বতসঙ্কুল। গোপাচল ও অগ্রোদকার মধ্যে গভীর অরণ্য। অরণ্যের প্রান্তে পর্বতশ্রেণী। অকস্মাৎ অরণ্যে প্রতি আক্রমণ হোল নাগসেনাদের দ্বারা। গাছের উপর থেকে অলক্ষিতে বিষাক্ত শর ছুটে আসে। প্রচুর হতাহত হোল মগধসেনা। মথুরার বিপরীত অভিজ্ঞতা। কোনরকমে অরণ্যের দক্ষিণে এলেন সুষেণ তার বাহিনী নিয়ে। সামনে পাহাড়, কিন্তু অরণ্য বিরল। রণহস্তীরা সংগঠিত হোল। পাহাড়ের শীর্ষে গোপাচল নগরী। তবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবু সেই নগরীতে যেতেই হবে। নগরী অতিক্রম করে তার দক্ষিণে সুউচ্চ পর্বতমালা অতিক্রম করলেই বিস্তীর্ণ সমভুমি। সেই সমভুমির অন্তে কালীসিন্ধ নদীর তীরে পদ্মাবতী। উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে পর্বতমালা ঘেরা, সুরক্ষিত। মহাবলাধিকৃত সুষেণ গণনা করে দেখলেন হতাহতের পরিমান পাঁচ সহস্র। পশ্চাদপসরণের কথা চিন্তাও করতে পারেন না। সুমুখে গিরিবর্ত্মের ক্ষীণ পথ। যে কোনও সেনাধ্যক্ষের পক্ষে দুশ্চিন্তার কথা। পুর্বদিকে একটি প্রশস্ত উপত্যকা আছে বটে, তবে তা অরণ্যবেষ্ঠিত। তিনি গভীর চিন্তা করেন। আহতদের চিকিৎসা প্রয়োজন, নিহতদের যথাসম্ভব খুঁজে বের করে সৎকার করাও কর্তব্য। তাই গোপাচলের নীচে, পাহাড়ের সানুদেশে অস্থায়ী শিবির রচনার নির্দেশ দিলেন।

মগধবাহিনীর শিবিররচনার সংবাদ পৌঁছল নাগগণসঙ্ঘে। তারা উপলব্ধি করলেন, এখন মগধসেনার লক্ষ্য পদ্মাবতী। বিস্তারিত রণকৌশল স্থিরিকৃত হোল। তিনদিন পর ভোরের আলো ফুটতেই রওয়ানা হোল মগধসেনা। অগ্রে অশ্বারোহীগণ, তৎপশ্চাতে রণহস্তীর দল। তার পিছনে পদাতিক। পরিকল্পনা অনুযায়ী যমুনা থেকে সিন্ধ নদীপথে কিছু রণপোত পদ্মাবতীর পথে। সুষেণ কিছুটা প্রসন্ন হলেন। একবার পদ্মাবতী পৌছলে বলের জন্য খাদ্যের কোনও অভাব হবে না। রণপোতগুলির আশ্রয়ে বহু শষ্যবাহী পোতও আছে, তিনি জানেন। কিন্তু সামনের গিরিবর্ত্ম তাকে চিন্তামুক্ত থাকতে দিচ্ছেন না। নাগগণ ন্যায়যুদ্ধের নিয়ম মানে না। তবে যুদ্ধ কোনকালেই বা ন্যায় মেনে হয়েছে। অদ্ভুত রহস্যময় হাসি খেলে যায় মহাবলাধিকৃত সুষেণের মুখে।

অশ্বারোহীগণ যখন গিরিবর্ত্ম প্রায় অতিক্রম করেছে, রণহস্তীরা গিরিবর্ত্মের মাঝখানে, তখনই ঘটল দুর্ঘটনা। পাথরের বড় বড় অংশ গড়িয়ে পড়তে লাগল নীচে। অর্ধেক অশ্বারোহী পিষ্ট হোল। হস্তীরা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পশ্চাদপসারণ করতে শুরু করল। তাদের পায়ের তলায় চাপা পড়ে মারা গেল আরও সহস্রাধিক পদাতিক। এমতবস্থায় পশ্চাদপসারণ ছাড়া পথ নেই। অবশিষ্ট সেনা প্রাণ বাঁচাতে পশ্চাদপসারণ করল। অশ্বারোহী বার্তাবগণ গেল মথুরার দিকে। পথে নাগসৈন্যদের বিষাক্ত শর তাদের নিহত করলো। সুষেণ স্থির করলেন, পুবের পথে অগ্রসর হবেন। সেইমত প্রস্তুতি শুরু হোল।

সিন্ধ নদীর খাত যেখানে সঙ্কীর্ণ, পোতগুলি সেখানে এসে পৌঁছল। একতীর থেকে অন্য তীরের দূরত্ব দুই শত হস্তের অধিক নয়। চারপাশের গাছগুলি নদীর জলে ঝুঁকে পড়েছে। দুপাশে ঘন অরণ্য। আশেপাশে কোনও মনুষ্য বসতি নেই বলে মনে হয়। তখন সুর্যপ্রায় অস্তাচলে। নদী নিস্তরঙ্গ। নাবিকগণ নৌচালনা ছেড়ে রন্ধনের আয়োজন শুরু করছে। কাল উষাকাল পর্যন্ত যাত্রার বিরতি। এই সঙ্কীর্ণ নদীতে রাত্রিকালে নৌ চালনা ঝুঁকিপূর্ণ। হেমন্তের সন্ধ্যা। নদীর বুক থেকে পাতলা কুয়াশা উঠছে। এমন সময়ে দুই তীর বরাবর, গাছের আড়াল থেকে ছুটে এলো আগুনের তির। কিছু বোঝার আগেই দাউদাউ জ্বলে উঠলো নৌকার পাল। তারপর মাস্তুল, গলুই, এক এক করে সমস্ত নৌকা অগ্নিময় হয়ে উঠল। রণপোতের যোদ্ধারা শর নিক্ষেপ করতে লাগলেন বটে, তবে সমস্ত শরই অরণ্যের অন্ধকারে হারিয়ে গেল। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে কেউ কেউ পরিত্রাণ পেতে চাইল, কিন্তু তীর সংলগ্ন হওয়ামাত্র অন্ধকার থেকে ছুটে আসা শর তাদের বিদ্ধ করল।

মথুরা ও অগ্রোদকায় তখন অন্য অশান্তি। মগধসৈন্যদের অত্যাচার ক্রমাগত অসহ্য হয়ে উঠেছে। বিশেষতঃ নগরী সন্নিহিত গ্রামগুলিতে। অবাধ লুন্ঠন আর রমণীদের উপর বলাৎকার যেন মগধসেনার কর্তব্য হয়ে উঠল। দুই নগরের গণপতিগণ ক্রোধে কম্পিত হয়ে উঠলেন। মহাগণসংস্থায় বার্তা প্রেরিত হোল। কিন্তু মহাগণসংস্থার নির্দেশ, কোনপ্রকার বিদ্রোহ করা যাবে না। অল্পদিন ধৈর্য্য ধরার আবেদন করা হয়েছে। প্রতিদিন ক্রন্দনরত নাগরমনী ও গ্রামিকদের ভিড় আছড়ে পড়ল গণপতিদের গৃহে, গণসংস্থাগারে। পদ্মাবতীতে তখন ক্রোধের আগুন জ্বলছে। তারা প্রতিজ্ঞা করেছে, সমুদ্রগুপ্তকে এর মাশুল কড়ায় গণ্ডায় শোধ করতে হবে। দুই সেনাধক্ষ্যের অনুপস্থিতে অধস্তন বলাধিপতিরাও অসহায়। তদুপরি এই দুই নগরীতে সেইসব সেনা উপস্থিত, যারা নিয়মিত সৈন্য নয়, কৃষকমাত্র।

মহাবলাধিকৃত সুষেণ পরিকল্পনা করেছেন, পূর্বদিকের অরণ্যপথে, যেখানে পর্বতশ্রেণী শেষ হয়েছে, সেই সমভূমি দিয়ে অগ্রসর হবেন। তারপর নৌবাহিনীর সাথে মিলিতভাবে পদ্মাবতী আক্রমণ করবেন। সেইমত সৈন্যসজ্জা করলেন, শুধু দুই সহস্র নির্বাচিত অশ্বারোহী পশ্চাতে থাকবে। তারা বহু যুদ্ধের পরীক্ষিত সেনানী। মূল বাহিনী পদ্মাবতীতে প্রবেশ করলে, তারা তাদের সাথে যুক্ত হবে। প্রথমে পদ্মাবতীর চতুর্দিকে অবরোধ সৃষ্টি করা হবে। তারপর ধীরে ধীরে নাগগণকে অবরোধের সর্পবেষ্ঠনীতে শ্বাসরুদ্ধ করা হবে। তাদের শিক্ষা দিতে হবে, এখনও মগধবাহিনীর নিকট কিছু সমরকৌশল শিক্ষার অবশিষ্ট আছে। বাহিনী পায় একদিন ধরে পূর্বদিকে অবস্থান করল। পরদিন প্রভাতে অরণ্যে প্রবেশ। সম্মুখে রণহস্তীগণ, পশ্চাতে দীর্ঘ ভল্লধারীরা। কিছু পশ্চাতে ধনুর্ধারীরা। ধীরে ধীরে সৈন্যগণ অরণ্যে প্রবেশ করল। গহন অরণ্য, স্থানে স্থানে দুর্ভেদ্য। সূর্যালোক প্রায় প্রবেশ করে না। সেনাদলটি বহুক্ষণ হোল অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করেছে। এমন সময়ে তারা তাপ অনুভব করলো। তাদের পশ্চাতে সেই তাপ ক্রমশঃ নিকটবর্তী হতে লাগল। ক্রমে দেখা গেল দাবানলের লেলিহান শিখা। রণহস্তীরা উন্মাদের মত সম্মুখে ধাবমান হোল। ক্রমশঃ অগ্নিবলয় চারপাশে ঘিরে আসে। সুষেণ বুঝলেন, তিনি নাগগণের ফাঁদে পা দিয়েছেন। তিনি যাত্রার গতি বৃদ্ধি করতে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সে বার্তা সমস্ত সেনাদলের কাছে পৌঁছল না। আগুনের গ্রাসে, মত্ত হস্তীর পায়ের তলায় অধিকাংশ সেনা বিনষ্ট হোল। অল্পকিছু সেনা নিয়ে পদ্মাবতীতে প্রবেশ করলেন মহাবলাধিকৃত সুষেণ। রণপোতগুলির কোনও সংবাদ নেই। একমাত্র আশা দুই সহস্র অবশিষ্ট অশ্বারোহী। অরণ্যেও বাইরে, পদ্মাবতীর নগরীর প্রান্তে সুষেন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সুষেনের এই সিদ্ধান্তে নাগগণ বিহ্বল হয়ে গেল। তাহলে কি সমস্ত বল নিয়ে মগধসেনাপতি পদ্মাবতী আক্রমণ করেন নি? আরও সেনা অবশিষ্ট আছে। দুই পক্ষই অপেক্ষার নীতি গ্রহণ করল। নাগগণ এই প্রথম ভুল করল। শত্রুর দুর্বল সময়ে, তাকে সময় দিয়ে সুবিধা প্রদান করল।

দুই দিবস পরে দুইসহস্র অশ্বারোহী ভিন্ন ভিন্ন পথে অরণ্যে প্রবেশ করল। অরণ্যে জ্বলন্ত অঙ্গার ততক্ষণে স্তিমিত হয়েছে। তারা নিঃশব্দে দ্রুত অরণ্য পার হয়ে এল। তাদের দর্শনে সুষেণ খুশী হলেন। গণনা করে দেখলেন, সর্বসমেত দুইসহস্র অশ্বারোহী, তিনশত হস্তী, দুই সহস্রের অধিক ধনুর্ধর ও দুই সহস্রপ্রায় অসি ও ভল্লধারী পদাতিক অবশিষ্ট। ক্ষুদ্র পদ্মাবতী নগরীকে দলিত করে মৃত্তিকায় মিশিয়ে দিতে যথেষ্ট। তিনি মনস্থ করলেন, এমন শিক্ষা তিনি নাগগণকে দেবেন যে, বহু প্রজন্ম তারা যেন বিস্মৃত না হয়। সম্মুখে কোনও পাহাড় নেই, গিরিকন্দর নেই। শুধু কৃষিক্ষেত্র, গ্রাম আর তারপর নগরীর হর্ম্যশ্রেণী! অনন্তনাগের নেতৃত্বে নাগযোদ্ধারা নিঃশব্দে পদ্মাবতী ত্যাগ করলেন। নগরীতে কেবল বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা পড়ে রইলেন। নারীদের মধ্যে যারা যোদ্ধা, তারাও পুরুষযোদ্ধাদের সাথে নগরী ত্যাগ করল। পরদিন প্রভাতে শুরু হোল মগধসেনার পদ্মাবতী আক্রমণ।

প্রথমে রণহস্তী। ক্ষুদ্র গৃহ আর ত্রস্ত বৃদ্ধ, নারী ও শিশু তাদের পায়ের তলায় দলিত হোল। তারপর অশ্বারোহীরা তাড়া করে অবশিষ্ট শিশুদের তাদের ভল্লে বিদ্ধ করে নারকীয় উল্লাসে প্রতিশোধ নিতে লাগল। তখন পদাতিক সেনারা প্রতিটি গৃহ, হর্ম্য, মন্দির তল্লাশ করে প্রতি মানুষকে হত্যা করল। পদ্মাবতী তখন মৃতের নগরী। মৃত্যুযন্ত্রণার সুতীব্র শব্দে আকাশ বাতাস মথিত। সৈন্যরা প্রতিটি নারীকে মারবার আগে বলাৎকার করতে ভোলেনি। ধীরে সন্ধ্যা হয়ে আসে। নগরী ঘিরে নীরবতা অসহ্য হয়। অবশ্য সহ্য করার জন্য কেউ আর বেঁচে নেই। গণপতির পরিবারের সাথে অনঙ্গনাগের তিন পত্নীও ধর্ষিত হয়। তাদের ছিন্ন দেহ মহাকালের মন্দিরের সোপানে ছুঁড়ে ফেলে দেয় মগধসেনা। রাতের অন্ধকারে, অনঙ্গনাগের নেতৃত্বে পঞ্চাশজন অসীমসাহসী নাগযোদ্ধা অতর্কিতে আক্রমণ করে মহাবলাধিপতি সুষেণের শিবির। মগধসৈন্যগণ কিছু বুঝে ওঠবার আগেই অপহৃত হলেন মগধমহাবলাধিকৃত সুষেণ।

সমস্ত সংবাদ পাটলীপুত্রে এসে পৌঁছচ্ছে, শুধু দক্ষিণের কোনও সংবাদ নেই। পরমভট্টারক সমুদ্রগুপ্তের ভ্রূ কুঞ্চিত হোল। ক্রমে হেমন্তকাল শেষ হয়ে আসছে, শিশির ঋতু সমাসন্ন। মহামন্ত্রী বসুগুপ্ত, গুঢ়পুরুষবাহিনীর প্রধান ধনঞ্জয় এবং মহারাজাধিরাজের দেহরক্ষীবলের প্রধান জয়রথ মন্ত্রণায় সমবেত। সকলেই সবিশেষ চিন্তিত। তারপর ক্রমে ক্রমে সংবাদ আসতে লাগলো। এবং সমস্তই দুসংবাদ! তারপর প্রায় এক সপ্তাহ পরে নাগগণসঙ্ঘের বিশেষ দূত পদার্পণ করল পাটলীপুত্রে। পরমভট্টারককে যথোচিত শ্রদ্ধা নিবেদন করে, সে নাগগণসঙ্ঘের বার্তা মহারাজাধিরাজকে জ্ঞাপন করল। ‘সম্রাট! মগধবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে নাগগণসঙ্ঘ বিশেষ ব্যাথিত ও আহত। আমরা মগধের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলাম ও আছি। কিন্তু সম্পুর্ণ অকারণে নাগগণসঙ্ঘের উপর আক্রমণ, মগধের প্রতি আমাদের বিশ্বাসকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। মগধ সাম্রাজ্যের এই যুদ্ধযাত্রা সম্পুর্ণরূপে আমাদের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। আমরা তথাপি অগ্রোদকা, মথুরা, প্রতিষ্ঠানে ও অন্যান্য নগরীতে মগধসেনাকে সাদরে আমন্ত্রণ করেছি। আমাদের যথাসাধ্য আতিথেয়তা নিবেদন করেছি। বিনিময়ে মগধসেনা আমাদের নগরী ও গ্রামগুলিকে যথেচ্ছ লুন্ঠন করেছে। নাগ গ্রামিক ও নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। এবং সর্বাপেক্ষা জঘন্ন ও নারকীয় কর্ম – নারীদের বলাৎকার করেছে। কি অপরাধে নাগদের এই শাস্তি, তা গণসঙ্ঘ বুঝতে পারছে না। আমাদের সমস্ত আবেদন, নিবেদন ব্যর্থ হবার পরও যখন মগধবাহিনীর নৃশংসতা বিন্দুমাত্র হ্রাস পেলনা, তখন নাগগণসঙ্ঘ নিজেদের পরিত্রাণের হেতু অস্ত্র গ্রহণ করে। মধ্যদেশে মগধের নৌ ও পদাতিক বাহিনীকে পরাজিত করে। তৎপরেও যখন মগধসেনা পদ্মাবতী নগরীতে অকথ্য ধ্বংসলীলা অব্যাহত রাখে এবং নগরীর সমুদ্রগুপ্ত স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। এ দায় একান্ত তার। সমস্ত বিপরীত মন্ত্রনাকে অগ্রাহ্য করে তিনি এই যুদ্ধ ঘোষনা করেছেন। এবং মগধের এই অবমাননা ডেকে এনেছেন। এ যেন বিনাশকালে বিপরীত বুদ্ধি! তিনিই নীরবতা ভাঙ্গলেন। ‘হে মান্য দূত! আপনি অতিথিশালায় মগধের আতিথ্য গ্রহণ করুন। কাল প্রভাতে আমার উত্তর প্রাপ্ত হবেন!’ নাগগণসঙ্ঘের দূত বিদায় নিলে, সমুদ্রগুপ্ত মহামন্ত্রী বসুগুপ্তকে বললেন, মহামন্ত্রী! আর রাত্রে মন্ত্রণাগৃহে উপস্থিত থাকবেন, আপনি একা!’ এই বলে মহারাজাধিরাজ নিষ্ক্রান্ত হলেন। যেতে যেতে তার অকস্মাৎ রঙ্গবতীর কথা স্মরণে এল। ক্লান্ত পদসঞ্চারে সমুদ্রগুপ্ত রনিবাসের দিকে গেলেন। মহারাণী দত্তাদেবীর সাথে পরামর্শ করা প্রয়োজন। এই অবমাননা থেকে দত্তাদেবীই পারবেন তাকে মুক্ত করতে। মহাদেবী দত্তাদেবী সব শুনলেন। শুনে বিতৃষ্ণায় তিক্ত হলেন। বিশেষ করে নারীদের উপর অত্যাচারের বিবরণে। পরমভট্টারক নিশ্চুপ। তারপর মহাদেবী সম্রাটকে বললেন, ‘মহারাজ! এই দুর্দশার একমাত্র প্রতিকার, ক্ষমাভিক্ষা। তাহলেই পাপস্খালন হবে। নাগগণ উদারহৃদয়। তাছাড়া তারা আপনার সম্পর্কিত, বিবাহসূত্রে। কিন্তু আপনাকে যেতে হবে ক্ষমাপ্রার্থীর মত। যদি প্রয়োজন হয় আমি যাত্রা করবো আপনার সহধর্মিনীরূপে!’

মহামন্ত্রী বসুগুপ্তের সাথে বিশেষ মন্ত্রণা করলেন সম্রাট। পরদিন প্রভাতে সম্রাটের আদেশ নাগদূত উপস্থিত হোল। সম্রাট তাকে বললেন, ‘আমি ও মহাদেবী মথুরায় গমন করবো শীঘ্রই। আশাকরি নাগভাতৃগণের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবো না। আমার সাথে অনুগমন করবেন শুধুমাত্র আমার নিরাপত্তা রক্ষীগণ। এ কথা আপনি নাগগণমহাসঙ্ঘকে জানাবেন। আর জানাবেন, মগধসম্রাট সমস্ত কিছুর জন্য লজ্জিত ও ক্ষমাপ্রার্থী!’

দূত বিদায় নিলে, রঙ্গবতী মহারাজের সাক্ষাৎপ্রার্থী হোল। তার নিবেদন এই যে, সে কামাক্ষ্যায় যাত্রা করতে চায়। পরমভট্টারক যদি দয়া করে সে অনুমতি দেন। মহারাজ বললেন, ‘রঙ্গবতী! আমার কিছু প্রশ্ন এখনও বাকি। আমি মথুরা যাত্রা করবো। প্রত্যাবর্তন করে সেই প্রশ্নের উত্তর চাই তোমার কাছে। তার পশ্চাতে তুমি যেতে পারবে!’

মহারাজাধিরাজ পরমভট্টারক সমুদ্রগুপ্ত মথুরায় আগমন করলেন। তার নিরাপত্তাবাহিনীকে নগরীর উপকন্ঠে অবস্থান করবার আদেশ দিয়ে, সম্রাট কেবল আটজন প্রতিহার সাথে করে মথুরা নগরীতে প্রবেশ করলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, নাগরিকগণ ত্রস্ত তার আগমনবার্তায়। ঘৃণার নীরবতা সম্রাটকে বিদ্ধ করল। মথুরা গণসংস্থাগারে তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন বিভিন্ন নাগনগরী থেকে আগত গণপতিগণ। তার মধ্যে নাগগণের বিভিন্ন শাখার গণপতিগণ উপস্থিত। কুণিন্দ, আর্জুনেয়, মল্ল প্রভৃতি। সকলেই বিষন্ন, গম্ভীর। মগধের অত্যাচারের ক্ষত এখনও তরুণ। মহারাজের সাথে এসেছেন শ্রেষ্ঠীপ্রধান ধনদত্ত। তিনি নাগগণসঙ্ঘেও পরিচিত। আর এসেছেন মহারাজের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীবলের প্রধান জয়রথ।

শ্রেষ্ঠী ধনদত্ত সাম্প্রতিক ঘটনায় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। শ্রেষ্ঠীগণের বানিজ্য বিভিন্ন রাজ্যে অবাধ। রাজ্যে শাসনব্যবস্থা যাই হোক না কেন। কিন্তু যুদ্ধোত্তর ঘৃণা ও ক্রোধের পরিবেশ তাদের স্বার্থের পক্ষে একান্ত হানিকর। পশ্চিমমুখী বানিজ্য পথ, নাগগণরাজ্যের অন্তর্বর্তি। বিভিন্ন স্বার্থবাহের দল যে সংবাদ এনেছে, সেই সংবাদ ভয়ঙ্কর। সমস্ত নদীপথে অপেক্ষা করছে আগ্নেয় শর। পূর্বদিক থেকে আশা সমস্ত পোত তাদের লক্ষ্য। স্থলপথেও উত্তরাপথ ও মধ্যদেশ বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠেছে। মহারাজ সমুদ্রগুপ্তের মথুরা আগমনের একটি কারণ হোল, শ্রেষ্ঠীদের আবেদন ও উপদেশ। শুল্ক ছাড়া রাজত্ব চলে না। সম্রাটের যুদ্ধ ও বৈভবের অর্থ যোগায় শুল্ক ও কর। সকল রাজ্যই কমবেশি শ্রেষ্ঠিদের উপর নির্ভরশীল। অবশ্য আর একটি পথ হোল পররাজ্য লুন্ঠন ও ক্রীতদাস। কিন্তু সেই পথ সাময়িক। শুল্ক ও কর চিরস্থায়ী।

মহাদেবী দত্তাদেবী সরাসরি অগ্রোদকায় নিজের পিত্রালয়ে গমন করেছে। তার সাথে মাত্র দুইজন দাসী। পিত্রালয়ে আজ্জুকার (মাতা) কাছে শুনছেন, মগধসেনার অত্যাচারের বিবরণ। দেবী দত্তাদেবী নীরবে অশ্রুপাত করছেন। পিত্রালয়ে অন্য সকলে তাকে সমীহ করছে, সন্দেহ করছে। কিন্তু আপন করে নিতে সংশয়। নাগবংশীয়গণ জাতিভেদ মানে না। তারা সকলেই ভাতৃপ্রতীম। একের রন্ধনশালায় অন্যের অবাধ যাতায়াত। এক গৃহে মহোৎসব, অন্য গৃহে অরন্ধন, এমনটা নাগসমাজে বিরলতম ঘটনা। বিশেষ করে নাগসমাজে নারীর স্থান অত্যন্ত সম্মাননার। প্রয়োজনে তারাও যৌধেরবৃত্তি গ্রহণ করে, অস্ত্রধারণ করে। যেমনটা সদ্য ঘটেছে মধ্যদেশে। সবই জানেন দত্তাদেবী। গুপ্তবনশের সম্রাজ্ঞী হিসেবে আজ তিনি লজ্জিত, ব্যথিত। তবু তিনি ছুটে এসেছেন নাগগণের মধ্যে। তাদের শোকে সমব্যাথী হতে চেয়েছেন। যদি এতে ক্ষতের কিছু উপশম হয়।

গণসংস্থাগারে পবেশ করে, সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত তার রাজমুকুট গণমুখ্যদের সামনের বেদীকায় রাখলেন। চমকিত গণমুখ্যদের সম্ভাষণ করে বললেন, ‘মগধসৈন্যরা যে অত্যাচার আর লাঞ্ছনার দ্বারা নাগজনপদের শোক ও যন্ত্রণার কারণ হয়েছে, তার জন্য আমি দায়ী। আমার রাজমুকুট আমি আপনাদের পদতলে অর্পণ করেছি। আপনাদের যে শাস্তি আমার প্রাপ্য, তা আমি মাথা পেতে নিতে এসেছি। দুরাত্মা পীড়ক সৈন্যদের যথোচিত শাস্তিও হবে, আপনারা নিশ্চিত থাকুন। আমি মথুরায় আগমনের সময় লক্ষ্য করেছি, নাগগণের অপরিসীম ঘৃণা ও ক্রোধ। সে সকলের দায় আমার। আজ আমি আপনাদের কাছে সমস্ত কিছুর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী!’ সমুদ্রগুপ্তের এ হেন কথায় নাগগণপতিগণের হৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠল। মহাগণপতি দেবনাগ সম্রাটের হাত ধরে বললেন, ‘মহারাজাধিরাজ! আপনার বাক্যে আমাদের সকল ক্রোধ, দুঃখ, ক্ষোভ নিবারিত হোল। ক্ষমাপ্রার্থনার চেয়ে বড় কিছু হয় না। আপনি ভারতসম্রাট। আমাদেরও রাজা। কিন্তু ভবিষ্যতে আবার কি এইপ্রকার নিপীড়ন আমরা আশা করবো?’ সমুদ্রগুপ্ত একটু নীরব হলেন, তারপর বললেন, ‘আমার জীবদ্দশায় এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না, এ আমার রাজকীয় আশ্বাস! আমার আশ্বাসে বিশ্বাস করা বা না করা, আপনাদের ইচ্ছাধীন। আপনাদের যা অভিরুচি, সেইরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। তবে কালই আমার অবশিষ্ট সৈন্য মগধে ফিরে যাবে, আমি এ আদেশ করলাম। শুধু আমার একটি অনুরোধ! অতীতে বিদেশী আক্রমক শক্তির বিরুদ্ধে নাগ যৌধেয়রা যেমন মগধবাহিনীর সাথে একসাথে সংগ্রাম করেছিল, যবন ও অন্যান্য শক্তিকে প্রতিহত করেছিল, ভবিষ্যতেও তা করবে, এই আশা রাখি। আর আপনাদের যে সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে, মগধ তার ক্ষতিপূরণ করবে। তবে আমার আর একটি অনুরোধ আপনারা বিবেচনা করবেন। বৈদেশিক শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধপরিচালনার জন্য উত্তরাপথে আমাদের বিশেষ ব্যবস্থা প্রয়োজন। তার জন্য কিছু অর্থ পরবর্তীকালে আপনারা মগধকে দান করবেন!’

শ্রেষ্ঠী ধনদত্ত এতক্ষণ নীরব ছিলেন। তিনি সম্রাট ও গণপতিদের যথোচিত অভিবাদন করে বললেন, মগধ ও নাগগণরাজ্যে আভ্যন্তরীণ বিবাদ আমাদের দুপক্ষকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সম্রাট আক্রমণ ও ক্ষয়ক্ষতির জন্য মার্জনাভিক্ষা করেছেন। এ তার ঔদার্য্য। আমি বিনীতভাবে নিবেদন করছি, সকলের স্বার্থে এই চরম তিক্ততার পরিসমাপ্তি হোক। আবার পুনর্গঠনের কর্ম শুরু হোক। আবার শান্তি আসুক!’ গণপতিগণ প্রায় সকলেই সম্মতি দিলেন, দেবনাগ নিজের হাতে সম্রাটের শিরে রাজমুকুট পরিয়ে দিলেন। তারপর দেবনাগের নির্দেশে সুষেণকে নিয়ে আসা হোল। গণপতি দেবনাগ বললেন, ‘মগধমহাবলাদিকৃত সুষেণ, আপনি মুক্ত!’ সকলেই সন্তুষ্ট হলেন। চন্দ্রগুপ্তের মুখে তৃপ্তি আভাষ। উঠে দাঁড়ালেন বেশনগরের গণপতি অনঙ্গনাগ। তিনি দেবনাগের সম্মতিক্রমে বললেন, ‘কিন্তু পরমভট্টারক! একটি প্রশ্নের তো নিবৃত্তি হোল না। মগধসম্রাটের নাগগণসঙ্ঘে আক্রমণের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি ছিল? পরাজিত হয়ে সম্রাটের আত্মবীক্ষা শুরু হোল, নাকি চতুর পশ্চাদোপসারণ? আমি নিশ্চিত, সম্রাট এই প্রশের উত্তর দেবেন না। কিন্তু আমি জানি এর উত্তর!’ অগ্রোদকার গণপতি শিশুনাগ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এখন যখন সমস্ত কিছু সৌহার্দ্যের বাতাবরণে সমাপ্ত হয়েছে, তখন অনঙ্গনাগের এই প্রশ্ন অভব্যোচিত!’ ‘আপনি যথার্থ বলেছেন গণপতি শিশুনাগ। এ স্থলে আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, এবং সম্পর্কে সম্রাটের শশ্রুপিতা! তাই মাননীয়ও বটেন! কিন্তু এই অনুত্তোরিত প্রশ্নটা আমাদের পশ্চাৎধাবন করবেই। আমি বলি, সম্রাটের আসল উদ্দেশ্য কি ছিল? রাজত্ববৃদ্ধি? না! সম্পদ আকাঙ্খ্যা? না! আসল উদ্দেশ্য ছিল, এবং এখনও আছে, তা হোল আমাদের এই গণব্যবস্থাকে ধ্বংস করা। রাজতন্ত্রে প্রতিষ্ঠা করা। এবং কটূ হলেও এ কথা সত্য যে, আমাদের অনেক গণপতিদের মধ্যেই এই সুপ্ত বাসনা অঙ্কুরিত হয়েছে। আমরা নাগগণ ধীরে ধীরে শ্রেষ্ঠীবৃত্তি গ্রহণ করেছি। আমাদের নিজদের সম্পদ আর সমষ্টির সম্পদ মনে করি না। ব্যাক্তিগত ধনসঞ্চয় অনৈতিক প্রমোদবাসনাকে প্রশয় দেয়, এ কথা স্মরণ রাখবেন। এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমরা নাগেরা স্বাধীন থাকবো না কি রাজতন্ত্রের ছত্রছায়ার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপরিচর হয়ে থাকবো?’

শিশির ঋতুর প্রাবল্যে পাটলীপুত্র কম্পমান। মহারাজাধিরাজ পরমক্রমাঙ্ক সমুদ্রগুপ্ত রাজসভায় আসীন। মহাদন্ডনায়ক (প্রধানবিচারপতি) হরিসেনকে আজ্ঞা করলেন, ‘মিত্র হরিসেন! সমগ্র রাজতন্ত্র, শাসনতন্ত্র, দন্ডসংহিতা, জন্ম মৃত্যু বিবাহ বিষয় নির্দেশাবলী একটি অভিন্ন শাসন সংহিতায় গ্রথিত করার সময় এসেছে। আপনি এ বিষয়ে যথাকর্তব্য করুন!’ হরিসেন বললেন, ‘রাজন, মনুগোষ্ঠির ঋষি কাত্যায়ন এই ব্যাপারে প্রাজ্ঞ। আপনার সম্মতি পেলে, আমি তাকে অনুরোধ করতে পারি!’ ‘বেশ, তবে তাই করুন, সাথে নারদগোষ্ঠির ঋষিদেরও রাখবেন। আর দেবগৃহে দশাবতার মন্দিরের কাজ সম্পন্ন করুন। প্রয়াগে সম্রাট অশোক স্থাপিত স্তম্ভে গুপ্তসাম্রাজ্যের ইতিকথা লিপিবদ্ধ করান, মিত্র হরিসেন!’

চণ্ডীকা মন্দিরে রঙ্গবতী উতলা হয়ে উঠেছে। সে এখন পাটলীপুত্র থেকে যেতে পারলে বাঁচে। কিন্তু অনঙ্গের নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তার যাবার উপায় নেই। সম্রাট পাটলীপুত্রে ফিরে এসেছেন। অথচ এখনও তার ডাক পড়ল না। তার শরীরটাও ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। রঙ্গবতী যুদ্ধের ফলাফল সবিস্তার শুনেছে। শুনেছে পদ্মাবতীরে মগধসেনার নির্মম অত্যাচার আর ধ্বংসের কাহিনী। অনঙ্গনাগের তিন স্ত্রীর মৃত্যুর কথা। ঘৃণায় তার মন ভরে গেছে। সে অহোরাত্র সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যু কামনা করে। আচার্য সুবর্ণনন্দী তাকে সাবধানে থাকতে বলেছেন। সন্ধ্যে হয়ে আসে। শীতের সন্ধ্যা দ্রুত ন্ধকার নিয়ে আসে। কুয়াশার আবরণে ঢেকে দেয় চরাচর। ঠিক সেই সময় এক ভক্তের উদয় হয় চণ্ডীকা মন্দিরে। সে প্রনামির থালায় প্রণামী অর্পণ করে বিদায় নেয়। সুবর্ণনন্দী দেখেন, একটি স্বর্ণমুদ্রা। তাতে মহাপরাক্রমাঙ্ক সমুদ্রগুপ্ত দণ্ডায়মান, গরুড়স্তম্ভের পাশে, হাতে ধনু। সম্রাটের মুখে ক্রূর হাসি। কিন্তু মুদ্রাটির ওপরে কে যেন কাজল লেপে দিয়েছে। সুবর্ণনন্দী কেঁপে উঠলেন। এ নির্দেশ এসেছে বেশনগর থেকে। সুবর্ণনন্দী রঙ্গবতীতে বলে, ‘মা, আচার্য মঙ্গলনাথের নির্দেশ এসেছে। সম্রাটের নির্দেশে মগধসৈন্য নাগনারীদের উপর যে জঘন্য অত্যাচার করেছে, বলাৎকার করেছে, শিশুদের শূলবিদ্ধ করে নির্মম হত্যা করেছে, তা মাতা শক্তির অপমান। দেবী চণ্ডিকার ইচ্ছা, এর প্রতিশোধ। অর্থাৎ পরমভট্টারকের মৃত্যু! আমাদের যা অধীত বিদ্যা, শিক্ষা, জ্ঞান, সাধনা, তার সমস্ত কিছু প্রয়োগ করতে হবে। দেবী চণ্ডিকা আমাদের সহায় হবেন। এই কার্যে যদি আত্মাহূতিও দিতে হয়, আমাদের তাই দিতে হবে। কজ্জললেপিত এই সুবর্ণমুদ্রা সেই আদেশ বহন করে এনেছে।

রঙ্গবতী ভাবে, কি তার সাধনা? কতটুকু সে নিষ্ঠাভরে, ভক্তিভরে দেবীকে ডেকেছে? সেতো ছিল এক ক্রীতদাসের মেয়ে, তাকে গণিকাবৃত্তির নিমিত্ত শিক্ষা দিয়েছিলেন গুরু বৃহস্পতি। সে তো শুধু চৌষট্টিকলাবিদ্যায় শিক্ষা লাভ করেছে। নাগগণপতি অনঙ্গনাগের বাল্যে পরিচিত হবার সুবাদে সে এই বৃহত রাজনৈতিক ক্রীড়ায় ক্রীড়নক হয়েছে। সে শুধু অনঙ্গকে চেয়েছিল বলে, এই পরিকল্পনার অঙ্গ হতে রাজি হয়েছিল। নিজের অকালমৃত্যুর জন্য নয়। সে তো গীত, বাদ্য, নৃত্য, আলেখ্য, বিশেষকচ্ছেদ্য, তন্ডুলকুসুমলিবিকার,পুস্পাস্তরণ, দশন, বসন, অঙ্গরাগ, মণিভূমিকাকর্স্মু, শয়নরচন, উদকবাদ্য, উদকাঘাত, চিত্রযোগ, মাল্যগ্রথনপ্রকার, শেখরকাপীড়যোজন, নেপথ্যপ্রয়োগ, কর্ণপত্রভঙ্গ, গন্ধযুক্তি, ভূষণযোজন, ইন্দ্রজাল, কৌচুমারযোগ, হস্তলাঘব, বিচিত্রশাকযুভক্ষ্যবিকারক্রিয়া, পানকরস, রসাসবযোজন,সুচীবাণকর্ম, সূত্রক্রীড়া, বীণাডমরুবাদ্য, প্রহেলিকা, প্রতিমালা, দুর্বাচকযোগ, পুস্তকবাচন, নাটকাখ্যায়িকাদর্শন, কাব্যসমস্যাপূরণ, পট্টিকাবেত্রবাণবিকল্প, তক্ষকর্ম, তক্ষণ, বাস্তুবিদ্যা, রৌপ্যরত্নপরীক্ষা, ধাতুবাদ, মণিরাগাকরজ্ঞান, বৃক্ষায়ুর্বেদযোগ, মেষশাবকযুদ্ধবিধি-কুক্কুট-শুকসারিকাআলাপন, উৎসাদন সম্বাহন ও কেশমর্দন কৌশল, অক্ষমুস্টিকাকত্থন, ম্লেচ্ছিতকবিকল্প, দেশভাষাবিজ্ঞান, পুস্পশকটিকা, নিমিত্তজ্ঞান,যন্ত্রমাতৃকা, সংপাঠ্য, মানসী, কাব্যক্রিয়া, অভিধাকোষ, ছন্দোজ্ঞান, ক্রিয়াকল্প, ছলিতযোগ, বস্ত্রগোপন, দ্যুতিবিশেষ, আকর্ষক্রিয়া, বালক্রীড়নক, বৈনয়িকী, বিদ্যাবিজ্ঞান, এই চৌষট্টিকলা শিখেছিল বাঁচার জন্য, মৃত্যুর জন্য নয়! রঙ্গবতী ভাবে, তার চিন্তার কোনও কূলকিনারা পায় না।

অনঙ্গনাগ বহুদিন পড়ে বেশনগরে প্রত্যাবর্তন করেছেন। কিন্তু তার মনে ক্রোধের ছায়া। পদ্মাবতীর ধ্বংসলীলা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। সমস্ত যুক্তি, বোধ, দীক্ষা তার অসার হয়ে গেছে। এক চিন্তার শূন্যতা তাকে গ্রাস করেছে। সেইসময়ে তার রঙ্গবতীর কথা মনে পড়ে। অনঙ্গ ভাবেন, কবে তার সাথে দেখা হবে। আবার অন্য চিন্তায় ডুবে যান। এর পর কি? আবার সেই গণপতির দায়িত্ব বহন করবেন? না কি অন্য জীবন। একা বিষণ্ণপুরীতে তিনি মদিরায় ডুবে যান। চিন্তায় পত্নীদের ছিন্নদেহ, সন্তানদের নিষ্প্রাণ শরীর তাকে ক্রোধে উন্মাদ করে তোলে। তিনি চেতনা হারান। পরদিন প্রভাতের রশ্মি এসে পড়ে তার মুখে। তিনি চোখ মেলেন। তার সুমুখে ভবিষ্যৎ কর্তব্য উন্মুক্ত হয়।

‘মাননীয় গণমুখ্যবৃন্দ! আজ আমি আপনাদেও আহ্বান করেছি, কিছু জরুরী বিষয় বলবার জন্য। আমরা নাগগন সদ্য মদধের আক্রমণ প্রতিহত করে বিজয়ী হয়েছি। অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয় সন্দেহ নেই। কিন্তু এর জন্যে আমাদের চরম মুল্য দিতে হয়েছে। পদ্মাবতী, প্রতিষ্ঠান সহ অন্যান্য নগরীতে আমাদের শত শত নাগরমনী লাঞ্ছিত ও নিহত হয়েছে। শুধু তাই নয়, আমাদের সখ্যের ঔদার্যকে অপমান করে গুপ্তসম্রাটের সৈন্যবল অগ্রোদক, মথুরা প্রভৃতি নগরীতে একই অত্যাচার করেছে। তবুও আমরা মগধের মহাবলাধিকৃত সুষেণকে মুক্তি দিয়েছি। তার কারণ আমাদের গণসংস্থা সেরকমই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। গণসংস্থার সদস্য হিসাবে আমি তা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস, যুদ্ধের, বৈরিতার এখানেই ইতি হবে না। আবার যদি যুদ্ধ হয়, তাহলে আমি অস্ত্র ধরবো, কিন্তু এই যুদ্ধ আমার চোখ খুলে দিয়েছে।

আমাদের গর্ব এই গণব্যবস্থা। প্রত্যেকের সমান অধিকার। আমাদের কেউ বংশানুক্রমে গণের প্রধান হতে পারেন না। নিজ যোগ্যতাবলে গণমুক্যদের দ্বারা আমরা গণপতিরা নির্বাচিত হই। গনপতিগণ গণমুখ্যদের সাহায্যে গণব্যবস্থা সক্রিয় রাখেন। গণের অন্তর্গত সকল মানুষের, স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে, শুভ অশুভের দায়িত্ব গণপতিদের। একের রন্ধনশালায় অন্যের অবাধ যাতায়াত। আমাদের নাগগণ কোনও জাতিভেদ, বর্ণভেদ মান্য করি না। এই ভূমি, নদী, অরণ্য আমাদের সকলের, কার ব্যক্তিগত বা কোনও পরিবারের নয়। পরন্তু আমি গণপতি হয়েছিলাম, আমার পিতা গণপতি ছিলেন বলে। সে তো অন্যায়, গণব্যবস্থার বিরুদ্ধাচারণ। তাই আমি গণপতির পদ হতে অব্যাহতি চাই। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, নুতন গণপতি নির্বাচন করুন। গণপতি হবার যোগ্যতা আপনাদের সকলেরই আছে, এ কথা আমি সর্বান্তকরণে স্বীকার করি। দ্বিতীয়ত, গনপতিকে যেন রাজা সম্বোধন করা না হয়। একজন সাধারণ নাগ হিসাবে এই আমার অনুরোধ। রাজা কি প্রকার হতে পারে, তা আমরা মগধ সম্রাটকে দেখে শিখেছি। রাজার অর্থ তিনি প্রভু, আর সকলে প্রজা, তার অধিকৃত দাস। কিন্তু গণব্যবস্থা তো এই প্রকরণের বিপরীত। গণপতি গণের মুখ্য, সম্মাননীয় হবেন, কিন্তু কখনই প্রভু হবেন না। এই ভুল আমার পিতা করেছিলেন, আমিও করেছিলাম। আপনারা বেশনগরের নাগগণকে এর থেকে মুক্ত করুন। এখনই প্রকৃষ্ট সময়।

আর একটি প্রসঙ্গ। গণব্যবস্থা ব্যক্তিগত সম্পদের সৃষ্টির বিরুদ্ধে, গণের সম্পদের পক্ষে। গণের অধীন প্রত্যেক পুরুষ, নারী ও শিশুর সমান অধিকারে এই সম্পদের অধিকারী। গণব্যবস্থা বানিজ্য করবে, সেটা প্রয়োজনীয়, কিন্তু তা হওয়া উচিত গণব্যবস্থার অধীনে। যে সকল শ্রেষ্ঠীরা, সার্থবাহগণ এই বানিজ্য করেন, তারা লাভ বা ক্ষতির একটি অংশ লাভ করতে পারেন। কিন্তু সমগ্র ব্যবস্থা তাদের হাতে অর্পণ করার অর্থ, ব্যক্তিগত সম্পদের সৃষ্টি। ইদানীং আমাদের মধ্যে অনেকেই শ্রেষ্ঠীবৃত্তি গ্রহণ করেছেন। তারা ধীরে ধীরে সম্পদশালীও হচ্ছেন। এটি গণব্যবস্থার পক্ষে দুর্লক্ষণ। আমার আশা, বিষয়টি নিয়ে গণসভা চিন্তা করবেন।

আর আমি গণসঙ্ঘের কাছে একটি মিনতি করবো। আমাদের বেশনগরের গণের অধীনে যে সমস্ত ক্রীতদাস আছে, অবিলম্বে তাদের যেন মুক্তি দেওয়া হয়। ক্রীতদাস, গণব্যবস্থার বিপরীত ধারণা। শৃঙ্খলিত মানুষ কখনও গণব্যবস্থার আদর্শ হতে পারে না। অনুগ্রহ করে তাদের মুক্তি দিয়ে, স্বাধীন ঘোষনা করে, তাদের গণের অন্তর্ভুক্ত করুন। তাতে গণব্যবস্থা শক্তিশালী হবে। আমাকে স্নেহের চক্ষে এতদিন দেখার জন্য উপস্থিত সকল গণমুখ্যের কাছে আমি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ। আপনাদের সকলকে আমার প্রণাম!’ এই কথা বলে অনঙ্গনাগ উপবেশন করলেন। তার কথাগুলি একটু একটু করে গণমুখ্যগণ আত্মস্থ করতে লাগলেন। সভায় গুঞ্জন। প্রবীণ গণমুখ্য শিবনাগ উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, ‘অনঙ্গনাগের কথা আমরা শুনলাম। আমি তার প্রতিটি বাক্যই সমর্থন করি। কেবল তার গণপতি পদ ত্যাগ ছাড়া। তবু তার ইচ্ছাকে আমাদের মেনে নিতেই হবে। আমি এক নূতন একজন গণমুখ্যকে গণপতি নির্বাচন করতে এই গণসভাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি!’ ‘কিন্তু কিভাবে আমরা মনোনয়ন করবো?’ প্রশ্ন করলেন রুদ্রনাগ নামে একজন গণমুখ্য। শিবনাগ বললেন, ‘আমাদের প্রথা আছে, রুদ্রনাগ। যদি একাধিক ব্যক্তি ইচ্ছুক হন অথবা মনোনয়ন পান, তবে এই সভা বৃক্ষশাখার দ্বারা যোগ্যতম ব্যক্তিকে নির্বাচিত করবেন। প্রত্যেক প্রার্থীর জন্য একটি পেটিকা রাখা হবে। প্রত্যেক গণমুখ্য একটি বৃক্ষশাখা, তাদের পছন্দ অনুসারে প্রার্থীর পেটিকায় রাখবেন। অন্তিমে যে প্রার্থীর পেটিকায় অধিকতম শাখা পাওয়া যাবে, তিনিই নব গণপতি নির্বাচিত হবেন!’ উপস্থিত গণমুখ্যগণ শিবনাগকেই নব গণপতি নির্বাচিত করলেন। বিষন্ন কিন্তু তৃপ্ত অনঙ্গনাগ চললেন নূতন জীবনান্বেষনে।

পরমভট্টারক ডেকে পাঠালেন রঙ্গবতীকে। বিশেষ মন্ত্রনাকক্ষে রঙ্গবতী এসে সমুদ্রগুপ্তকে প্রণাম করল। মহারাজাধিরাজ তাকে উপবেশন করতে বললেন। সমুদ্রগুপ্ত বললেন, ‘রঙ্গবতী! তোমায় কেন স্মরণ করেছি, জানো?’ রঙ্গবতী মাথা নাড়ল। মহারাজাধিরাজ বললেন, ‘তোমার নিশ্চয় স্মরনে আছে, তুমি এর আগে ভবিষৎবাণী করেছিলে। এবং তা অক্ষরে অক্ষরে ফলবতী হয়েছে। আমি আরও গভীর প্রশ্ন করতে চাই, তোমাকে তার উত্তর দিতে হবে!’ রঙ্গবতী কিচ্ছুক্ষণ নীরব রইল, তারপর বলল, ‘ হে পরক্রমাঙ্ক! একটি বিশেষ সময়ে মাতা চণ্ডিকা তার উপাসিকার মাধ্যমে কিছু বলেন। সেই সময় নির্ধারণ উপাসিকার হাতে থাকে না। অতএব যখন মাতা ইচ্ছা করবেন, তখনই কিচ্ছু উচ্চারিত হবে!’ সম্রাট অধৈর্য হয়ে বললেন, মাতা চন্ডির জাগরণ আয়োজন করো। নিবেদন করো যে এ সম্রাটের আজ্ঞা!’ রঙ্গবতী উত্তর করল, ‘বেশ, আগামি কৃষ্ণা চতুর্দশীতে মাতার বিশেষ পূজা। সম্রাট উপস্থিত থাকলে সম্রাটের কথা মাতাকে নিবেদন করবো!’ সমুদ্রগুপ্ত বললেন, ‘উত্তম, আগামী কৃষ্ণা চতুর্দশীতে আমি মন্দিরে উপস্থিত থাকবো!’ মহারাজকে প্রণাম জানিয়ে রঙ্গবতী বিদায় নিল।

নাগগণসংস্থাকে বিদায় জানিয়ে অনঙ্গনাগ গোপনে যাত্রা করলেন পাটিলীপুত্রের উদ্দেশ্যে। বেশনগর হতে পূর্বে অশ্বারোহণে দুই প্রহরের পথ অতিক্রম করলেই শুক্তিমতি নগরী (সগর)। সেখানে থেকে গহন অরণ্য ভেদ করে বাণসাগর। অমরকণ্টক থেকে হিরণ্যবাহ এসে মিশেছে এই বিপুল জলাশয়ে, সেই হিরণ্যবাহ (সোন) এখান থেকে পূর্ব উত্তর-পূর্ববাহী হয়ে গংগায় মিশেছে পাটলীপুত্র নগরীতে। পাটলীপুত্র যাওয়ার এই পথটি অরণ্যসঙ্কুল কিন্তু সময় বাঁচে। অনঙ্গনাগের হাতে সময় কম। দশদিনে পাটলীপুত্র পৌঁছতেই হবে তাকে। শুক্তিমতি নগরীতে তার পরিচিত একজন নাগবংশীয় গণমুখ্য বাস করেন। তার সাহায্য প্রয়োজন। শুক্তিমতী থেকে বাণসাগরের দিকে যাত্রা করলেন অনঙ্গনাগ। এই পথটি বড়ই কষ্টকর। তারপর বাণসাগরের তীরে পরিচিত এক নাগবংশীয় মৎস্যজীবী গণমুখ্যের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তার নিকট থেকে দশটি স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে একটি নাতিদীর্ঘ নৌকা ক্রয় করলেন। তার সাথে দুজন স্বেচ্ছা নাবিক, অবশ্যই পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। বাণসাগর পেড়িয়ে হিরণ্যবাহ নদীপথে অনঙ্গ চললেন পাটলীপুত্রের উদ্দেশ্যে। নৌকার পাটাতনের নীচে লুকিয়ে রাখলেন তার অস্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী। বৈশাখী কৃষ্ণা নবমীতে দীর্ঘ যাত্রার উপরান্তে অনঙ্গনাগ পৌছলেন পাটলীপুত্রে। নগরীর অদূরে নাবিকদের নৌকাটি দান করলেন। খুশি হয়ে তারা বাণসাগরের দিকে রওয়ানা হোল।

এক তীর্থযাত্রীর নিকট সুবর্ণনন্দী অনঙ্গনাথের আগমনবার্তা পেলেন। স্থির হোল, দেবী পাটনেশ্বরী মন্দিরে দেখা হবে দুজনের। সেখানের পরিকল্পনা হবে। সুবর্ণনন্দী রঙ্গবতীকে অনঙ্গনাগের আগমনবার্তা জ্ঞাপন করলেন। আনন্দবিভায় ভরে গেল রঙ্গবতীর মুখ। দীর্ঘ অদর্শনের পর অনঙ্গের সাথে মিলনের কথা ভেবে রঙ্গবতী বিভোর হোল। কিন্তু পরমুহুর্তেই তার চোখে আষাঢ়ের মেঘের ছায়া। সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত তার ব্যক্তিগত শত্রু নন। অথচ তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে রঙ্গবতীর প্রধান ভূমিকা! নাগগণ তার মাতাপিতাকে ক্রীতদাস করেছে, তার শৈশব কেড়ে নিয়ে তাকে নগরবনিতা করেছে, অথচ সেই নাগবংশের গণপতিকে সে কামনা করে। সত্যি জীবনের গতি বড় প্রহেলিকাময়, রঙ্গবতী ভাবে।

বৈশাখী কৃষ্ণা চতুর্দশীর রাত্রে মহারাজ সমুদ্রগুপ্ত এলেন চণ্ডিকা মন্দিরে। পরনে রেশমের রক্তাম্বর, অঙ্গে উত্তরীয়। বাহুতে অঙ্গদ, গলায় পদ্মরাগমণিখচিত রত্নমালা, শিরে বৈদুর্য্যমণিখচিত স্বর্ণমুকুট। চারিদিকে জমাট অন্ধকার। ইতস্তত দীপের আলোক সেই অমানিশাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। সঙ্গে দেহরক্ষীবলের প্রধান জয়রথ ও একশত সেনা। সমস্ত মন্দির প্রাঙ্গণ সৈন্যে ভরে গেল। মহারাজ মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। জয়রথ ও অন্যান্য সৈন্যবলকে মন্দিরের বাইরে অপেক্ষা করতে আদেশ দিলেন। মন্দিরের ভিতর প্রায়ান্ধকার। দুটি দীপ জ্বলছে। সেই স্বল্প আলোকে দেবী চণ্ডিকার মুখমণ্ডল আরও ভয়ানক লাগছে। দেবীর লোলজিহ্বা করালদংস্ট্রা যেন সর্বস্ব গ্রাস করতে উদ্দ্যত। দেবীর সম্মুখের যোনিপট্ট উজ্জ্বল স্বর্ণবর্ণ, তাতে সিন্দুর লেপ। সম্মুখে তাম্রপত্রে দগ্ধ মৎস্য ও মাংস। তাম্রকোষে কিছু তরল, একটি তাম্রপাত্রে জপপুস্প। যোনিপট্ট ও দেবীর মাঝে একটি আসন, করোটিশোভিত। যোনিপট্টের বিপরীত দিকে মহারাজের আসন পাতা। অদূরে বামদিকে একটি আসন সুবর্ণনন্দীর। মহারাজ প্রবেশ করলে মন্দিরের দ্বার বন্ধ হোল। সুবর্ণনন্দী সম্রাটকে আসনশুদ্ধি করালেন। তারপর শুরু করলেন মন্ত্রোচ্চারণ। তারপর সুবর্ণনন্দী কারণবশত মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে চকিতে রঙ্গবতী প্রবেশ করে মহারাজের সন্মুখের তরলপূর্ণ তাম্রপাত্রটি পরিবর্তন করে দিল। সম্রাট বিস্ময়ে সেটি লক্ষ্য করলেন। একটু পরে ধূপ জালানো হোল। সুবর্ণনন্দী মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে যন্ত্রস্থাপনা করলেন। তখন রঙ্গবতী এসে দেবীর সামনে নিজের আসনে বসল। সমুদ্রগুপ্ত পরম বিস্ময়ে দেখলেন, রঙ্গবতী সম্পুর্ণ নগ্ন। মহারাজ বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখলেন যোগিনীর দেহ। সম্পুর্ণ অনাবৃত রঙ্গবতী। তার কেশ উন্মুক্ত, চক্ষু নিমিলিত। তার বিল্বফলদ্বয় প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল। তার বাহুদ্বয় প্রণামের ভঙ্গীতে পায়ের উপরে স্থাপিত। যোগিনী পদ্মাসনা, শুধু তার যোনিমণ্ডল রক্তবস্ত্রে ঢাকা। যোগিনী বললেন, ‘মহারাজ! সম্মুখের তাম্রকোষ থেকে মহাপ্রসাদ গ্রহণ করুন!’ সমুদ্রগুপ্ত মন্ত্রাদিষ্টের মত তাম্রকোষের তীব্র মৈরেয় গ্রহণ করলেন। তার কণ্ঠনালী সেই তরল অগ্নি শরীরে প্রবেশ করল। যোগিনী অস্ফুট স্বরে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগল। সমুদ্রগুপ্ত দেখলেন রঙ্গবতী ক্রমশ ভয়াল হয়ে যাচ্ছে। তিনি বহু যুদ্ধের বীর নায়ক। ভীত হওয়া তার স্বভাব নয়। তিনি আরও মৈরেয় পান করলেন। তিনি স্পষ্ট দেখলেন রঙ্গবতীর মুখমন্ডল দন্তুর হয়ে যাচ্ছে। তার শ্রীফল দুটি ভয়ানক প্রকাণ্ড আকার ধারণ করেছে। ক্রমশ রঙ্গবতির কটিদেশে রক্তবর্ণ ত্রিকোণাকৃতি বস্ত্রখণ্ড যেন উত্তাল নদীবক্ষে নৌকার পাল! নারীর শরীর অদ্ভুত মাদক হয়ে আকর্ষণ করছে, অথচ পরক্রমাঙ্ক যেন চলচ্ছক্তিহীন। এক বিচিত্র অন্ধকারময় আনন্দ তাকে ঘিরে ধরছে। আরও মৈরেয় পান করলেন সমুদ্রগুপ্ত। তার শরীরে রক্তস্রোত প্রবল হোল। চক্ষু আরক্ত, শিরে যেন কেউ উন্মত্ত দুন্দুভি বাজাচ্ছে। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সমুদ্রগুপ্ত যোগিনীকে স্পর্শ গেলেন। মনে হোল যেন তার শরীর বায়বীয়, বাতাসে ভাসমান। মহাক্রমাঙ্ক সমুদ্রগুপ্ত সেই ধাতব যোনিপট্টে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।

রঙ্গবতী দ্রুত উঠে গেল। সুবর্ণনন্দীর দিকে তাকাল। তারপর দ্রুত পিছনের ক্ষুদ্র দ্বার দিয়ে বেড়িয়ে অগমকূপের কাছে গেল। নিঃশব্দে অগমকূপে ঝাপ দিল। সুবর্ণনন্দী তাকে বলে দিয়েছে আগেই, যে অগমকূপের উত্তরদিকে একটি সুরঙ্গ আছে। সেই সুড়ঙ্গ অল্প কিছুদূর পরেই উপরের দিকে যায়। তারপর জলহীন। সেই নাতিদীর্ঘ সুড়ঙ্গ শেষ হয় গঙ্গার তীরে, একটি ভগ্ন শিব মন্দিরে। সেখানে পৌঁছতেই সেই মন্দিরের পূজারী অপেক্ষা করছিনেন শুষ্ক বস্ত্র নিয়ে। তারপর গভীর রাত্রে রঙ্গবতী সেই পুজারীর গৃহে গেল। সেখানেই অপেক্ষা করছিল অনঙ্গনাগ।

ওদিকে প্রায় প্রত্যুষ হয়ে এলো। অধৈর্য জয়রথ মন্দিরের দ্বারে করাঘাত করলেন। নিরুত্তর দেখে তিনি দুয়ার খুলে দেখলেন সেই ভয়ানক দৃশ্য। দ্রুত সৈন্যদের ডেকে তিনি অচৈতন্য মহারাজকে শিবিকায় তুললেন। তার নির্দেশে শিবিকা দ্রুত ছুটল প্রাসাদে। সমুদ্রগুপ্তকে নিয়ে যাওয়া হোল রনিবাসে, মহারানী দত্তাদেবীর কক্ষে। দ্রুত ভিষগাচার্য সুশ্রুতকে আহ্বান করা হোল। এলেন মন্ত্রী বসুগুপ্ত। সুশ্রুত সম্রাটের নাড়ি পরীক্ষা করলেন। নাড়ি অতি দ্রুত। তিনি ছুড়িকা দিয়ে সম্রাটের হাতের শিরা কেটে দিলেন। কিছুটা রক্তপাত হয়ে যাবার পর, ক্ষতস্থান বেঁধে দিলেন। তারপর ঔষধ নির্ণয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মহামন্ত্রী বসুগুপ্তকে বললেন, ‘মহামন্ত্রী! ঘটনাস্থলের প্রতিটি বস্তু রক্ষা করার আদেশ দিন!’ বসুগুপ্তের নির্দেশ নিয়ে অশ্বারোহী ছুটল মন্দিরে। সে বার্তা দিল জয়রথকে। জয়রথ ক্ষিপ্ত বাঘের মত গোটা মন্দির খুঁজতে লাগলেন। সুবর্ণনন্দী অদ্ভুত প্রতারিত স্বরে বললেন, ‘আমরা ব্যর্থ হয়েছি। রঙ্গবতী আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। মহারাজের জন্য নির্দিষ্ট বিষমদ্য সে সরিয়ে ফেলেছে!’ তার বাক্য শেষ হতেই জয়রথের উন্মুক্ত অসির আঘাতে তার শির স্কন্ধচ্যুত হয়ে দেবী চণ্ডিকার পদতলে নিক্ষিপ্ত হোল।

দুদিন পড়ে একদল বৌদ্ধ ভিক্ষু ভিক্ষুনিকে দেখা গেল। গয়ার পথে চলেছে পদব্রজে। পুর্ণিমায় গয়ায় বিরাট উৎসব। ভগবান বুদ্ধের বোধিলাভের স্মরণে। পাটলীপুত্র থেকে গয়া পদব্রজে চারদিনের পথ। শত শত ভিক্ষু ভিক্ষুণীর দল চলেছেন তীর্থযাত্রায়। মুন্ডিত মস্তক, পরিধানে চীবর, হস্তে ভিক্ষাপাত্র। অনন্তনাগ আর রংগবতীও চলেছে সেই ভিড়ে মিশে। সদ্য মুণ্ডিত মস্তক, পরনে চীবর, হাতে যষ্ঠি। গয়ায় পৌঁছলে, সেখান থেকে পশ্চিমে গেলে মিলবে হিরণ্যবাহ নদী। তারপর প্রত্যাবর্তনের দীর্ঘ যাত্রা। দুদিন পড়ে সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের জ্ঞান ফিরে এলো। জয়রথের কাছে সব শুনলেন। রঙ্গবতী খুঁজে বার করার কথা উঠতেই তিনি সকলকে বিরত করলেন। সুস্থ হয়ে সম্রাট গেলেন দেবী পাটনেশ্বরী দর্শনে। পুনরায় শুরু করলেন মদিরাপান। এদিকে রঙ্গবতী আর অনন্তনাগ বজ্রাসনে (গয়া) পৌঁছলেন। তারপর রঙ্গবতী অনন্তনাগকে প্রশ্ন করলেন, এবার? কোথায় যাবো আমরা? বিস্মিত অনঙ্গনাগ বললেন, ‘কেন বেশনগরে!’ রঙ্গবতী দৃঢ়স্বরে বলল, ‘না। আমি আর বেশনগরে ফিরবো না। নগরবনিতার জীবন আমি ত্যাগ করে এসেছি, অনঙ্গ। ধর্মও আর আমাকে আকর্ষণ করে না। ধর্ম শুধু ক্ষমতার ক্রীড়নক। তাতে আর আমার রুচি নেই। আমি নুতনভাবে বাঁচতে চাই, অনঙ্গ!’ অনঙ্গনাগ চুপ করে থাকে। সে আজ আর নাগগণপতি নয়। সেও স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছে রাজার জীবন। ‘আমি গণপতি আর নই, রঙ্গবতী। একজন সাধারণ নাগ মাত্র। আমার সকল বন্ধন ত্যাগ করেছি। আজ আমি মুক্ত!’ রঙ্গবতী অনঙ্গের হাত ধরে। বজ্রাসন থেকে গোপনে পশ্চিমদিকে যাত্রা করে তারা। তিনদিন পথচলার পর তারা হিরণ্যবাহী নদীর তীরে পৌঁছয়। একটি সার্থবাহ দলের সাথে কথা হয়, তারা কিছুদূর গিয়ে দক্ষিণে নারায়ণী নদী দিয়ে সমুদ্রে যাবে। কথা হয় নারায়ণী নদীর মুখে তারা নেমে যাবে। সেখান থেকে অরণ্যপথে বিন্ধ্যের দিকে যাবে। তাদের কোনও তাড়া নেই।

অনঙ্গনাগ ব্যাথিত বিস্মিত হয়ে যায় রঙ্গবতীর কথা শুনে। অথচ সে জানে, রঙ্গবতীর প্রত্যেকটি কথা সত্য। কিন্তু সে আজ আর নাগগণপতি নয়। সেও স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছে রাজার জীবন। ‘আমি গণপতি আর নই, রঙ্গবতী। একজন সাধারণ নাগ মাত্র। তোমার মতই একই অনুভব আমার। তাই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে আমাকে। আমি জানি এই ব্যাধি থেকে যতদিন নাগেরা মুক্ত না হবে, ততদিন তাদের ধ্বংস অনিবার্য। এই যুদ্ধে হয়তো মগধকে পরাস্ত করেছি আমরা, কিন্তু আগামীকালে একই রকম ফল নাও ফলতে পারে। মনুষ্যত্বহীনতার ব্রজ্রকীট আমাদের সমাজশরিরে প্রবেশ করেছে। তার থেকে আমাদের নিস্তার নেই। ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে, তাকে দিয়ে পাপ করায়। আর সেই পাপের মাশুল তাকেই দিতে হয়। পদ্মাবতীর সকল স্ত্রী ও কন্যারা এই যুদ্ধে ধর্ষিত, লাঞ্ছিত হয়েছে। সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত হয়েছেন, সেটা সত্য। কিন্তু তার মুল্য শোধ করেছে নাগনারীগণ। শুধু পদ্মাবতী নয়, প্রতিষ্ঠানে, মথুরায়, অগ্রোদকায়, সর্বত্র। সকল নারীর মধ্যে আমার স্ত্রীগণও ছিল, রঙ্গবতী। আমার সন্তানদের শূলবিদ্ধ করা হয়েছে। বীভৎস মৃত্যু হয়েছে তাদের। শোকে ভেঙ্গে পড়েছি, ক্রোধে মুহ্যমান হয়েছি। কিন্তু শেষে বুঝেছি, ক্ষমতার পাপ আমাদেরও গ্রাস করেছিল। তারপর চিন্তা করেছি, আমার কি কর্তব্য? এবং শেষে আমি আমার সকল বন্ধন ত্যাগ করেছি। আজ আমি মুক্ত!’ পরম মমতায় রঙ্গবতী অনঙ্গের হাত ধরে। সেই স্পর্শে নিষ্কলুষ সততা ছিল।

ভিক্ষুদের কাষায় বস্ত্র তারা পরিত্যাগ করেছে। অনন্তনাগ পরিধান করেছেন কঞ্চুকী, নিম্নাঙ্গে সাধারণ বস্ত্র। আর কানে কুন্ডল। রঙ্গবতী পরিধান করেছে শাটি, কঞ্চুকী আর উপাসংগ। অনন্তনাগ তার সেই নিষ্কের মালা তাকে প্রত্যর্পণ করেছেন। অনন্তনাগের কোমরে লুকনো আছে ছুরিকা আর কিছু দিনার, কার্ষাপণ একটি থলিতে। তিনদিন পথচলার পর তারা হিরণ্যবাহ নদীর তীরে পৌঁছয়। একটি সার্থবাহ দলের সাথে কথা হয়, তারা কিছুদূর গিয়ে দক্ষিণে নারায়ণী নদী দিয়ে সমুদ্রে যাবে। কথা হয় নারায়ণী নদীর মুখে তারা নেমে যাবে। সেখান থেকে অরণ্যপথে বিন্ধ্যের দিকে যাবে। তাদের কোনও তাড়া নেই। নদীবক্ষে প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে দশদিন অতিক্রান্ত হয়। এই প্রথম, অনেকদিন পড়ে ভালো করে আহার জোটে। যথেষ্ট বিশ্রামও হয়। ক্রমে একদিন দ্বিপ্রহরে তাদের পোত নারায়ণী নদীর সংগমস্থলে উপস্থিত হয়। সার্থবাহকে ধন্যবাদ জানিয়ে তারা তীরে অবতরণ করে। তারপর একদিনের পথ পদব্রজে অতিক্রম করে এক আরণ্যক গ্রামে উপস্থিত হয় তারা।

অপরিচিত গ্রামটি, কেমনভাবে তারা তাদের দেখবে, সে নিয়ে সন্দেহ ছিল অনঙ্গের। কিন্তু তারা সাদর অভ্যর্থনাই করল তাদের মত করে। খাদ্য, পানীয় দিল খেতে। সেখানে বনবাসীদের গ্রামটিতে কিছুদিন কাটে তাদের। তাদের খাদ্য, পানীয় কম রোচক নয়। তবে তাদের পরিধেয় বিশেষ কিছু নয়। কটিতে যৎসামান্য বস্ত্র আর ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। মহিলাদের বিশেষকরে যুবতীদের অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গ প্রথম প্রথম তাদের চোখে অন্যরকম লাগছিল। অনঙ্গনাগ তো তাকাতেই পারছিলেন না। বরং রঙ্গবতী তুলনায় অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করছিল। এইভাবে কেটে গেল বেশ কিছু দিন। খাদ্য বলতে ঝলসানো শূকর বা বন্যগাভী, ফলমূল, সিদ্ধ গোধূম, ভাত আর মেরয়। এদের মেরয় অত্যন্ত তীব্র। অল্পদিনেই এদের ভাষা দু একটি করে রপ্ত করল দুজনেই, সঙ্গীতও। সেই সুরে মাদকতা আছে, ভালবাসা আছে। এইভাবে কেটে যায় দিন, মাস।

তারপর একদিন তাদের কাছ থেকে বিদায় নিল রঙ্গবতী আর অনঙ্গ। তাদের গন্তব্য বিন্ধ্যের পাদদেশে, ক্রীতদাস পল্লী। রঙ্গবতীর ইচ্ছা, তার মাতা পিতার সাথে মিলিত হয়। অনঙ্গের নিকটে সে শুনেছে, তারা আর ক্রীতদাস নয়। দাসত্বের বন্ধন মুক্ত। তা হলে কি সেখানেই যাবে রঙ্গবতী? মানুষের বাঁচার জন্য একটা সমাজ তো চাই। অরণ্যের মধ্যে দিয়ে পায়েচলা সঙ্কীর্ণ পথ। সাবধানে পথ চলা। ক্রমে ছোট ছোট টিলা যেন জঙ্গল ফুঁড়ে উঠেছে। তারপর পাথুরে জমি। জঙ্গল এখানে একটু পাতলা। সকালে রোদ স্তিমিত হয়ে এলো। আকাশ জুড়ে মেঘের সজ্জা। জলভরা সে মেঘ জানান দিল, বর্ষা ঋতু সমাসন্ন। অনঙ্গ রঙ্গবতীকে দ্রুত পা চালিয়ে যেতে বললেন। বৃষ্টি নামার আগেই তারা টিলার মাথায় পৌছতে পারলো। এই টিলাটি অদ্ভুত। প্রকৃতির রহস্যময় খেয়ালে যেন একটা আশ্রয় তৈরি হয়েছে। বিরাট দুটি পাথরের দেওয়ালের মাথায় একটি পাথরের ছাদ। তারা সেই খানে আশ্রয় নেবার সাথে সাথেই বৃষ্টি নামলো অঝোরে। নীচে অরণ্যের সবুজ গালিচা ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসে। বৃষ্টির জল টিলার মাথা থেকে নির্ঝরিণী হয়ে নামতে থাকে। তারা তন্ময় হয়ে দেখে।

একসময় বৃষ্টি থামে। তখন সন্ধ্যা হয়ে আসে। নির্মেঘ আকাশে তারারা ফুটে ওঠে। আকাশের বুকে মণিমানিক্যের হীরকদীপ্তি নিয়ে জ্বলে ওঠে অগণ্য নক্ষত্রমালা। দুধগঙ্গার স্বর্গীয় আলো এসে যেন মুখে লাগে। নির্মল আকাশে তারাগুলি তিরতির করে কাঁপতে থাকে। অনঙ্গ রঙ্গবতীর দিকে তাকায়। তার চোখে অদ্ভুত ভালবাসা। নক্ষত্রমালার আলোয় আকাশ যেন ভেসে যাচ্ছে। নিচের অরণ্যে কোনও একাকী চিত্রল হরিণের ডাক শোনা যাচ্ছে। রাত্রির এই রূপ আগে এমন করে পূর্বে দেখেনি অনঙ্গ। রঙ্গবতীকে মনে হয় কাকোনাদবোটে পাথরের ভাস্কর্য। পাথরের সীমার মাঝে শিল্পীর অসীম রূপতৃষা যেন মূর্ত হয়ে আছে। আচ্ছন্ন অনঙ্গনাগ তার পরিধেয় বস্ত্র খুলে ফেলে। খুলে ফেলে কুণ্ডল। ছুঁড়ে ফেলে মুদ্রার থলি। তারপর মমতাভরে একে একে খুলে দেন রঙ্গবতীর উপাসঙ্গ, কঞ্চুকী, অন্তর্বাসক, শাটি। অপার্থিব সেই পাহাড়চূড়ায় দুই আদিম মানব মানবী পরস্পরকে আশ্লেষে আলিঙ্গন করে। রাত্রির শেষে ঊষার অভিসারে শুরু হয় নূতন সকাল।