
দুর্যোধন নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালেন কক্ষের অন্দরে। কক্ষের কেন্দ্রস্থলে প্রদীপ শিখাগুলি যেন নৃত্য করছে। এক পুরুষ আর এক নারী অক্ষক্রীড়ায় মগ্ন। জয় পরাজয়ের উত্তেজনা তাদের মুখে চোখে। দুর্যোধন একটু হাসলেন। বিশেষতঃ নারীটি তার বড় প্রিয়। পুরুষটিও। আবহে উত্তেজনা। সন্ধ্যা অতিক্রান্ত। রাজকার্য হতে ফিরেছেন দুর্যোধন, মনে ক্লান্তির ছাপ। তথাপি শরীরে কোনও ক্লান্তি নেই। যতবার দুর্যোধন তার এই রাজ্ঞীকে দেখেন, ততবারই প্রসন্নতায় ভরে যায় তার মন। কুরু রাজমহলে বিশিষ্টা রমণীর অভাব হয় নি কখনও। প্রপিতামহী সত্যবতী আছেন, আছেন মাতা কুরুসম্রাজ্ঞী গান্ধারী, আর ছিলেন স্বয়ং যাজ্ঞসেনী। কিন্তু তবুও দুর্যোধনের কাছে এ নারী অনন্যা। দুই নারী পারেন রাজার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে, এক পাঞ্চালী আর অন্যজন এই ভানুমতী। অকম্প্র দীপশিখার মত স্থির বিজলী। দুর্যোধনজায়া ভানুমতী! আর যে পুরুষসিংহটি ভানুমতীর সাথে অক্ষক্রীড়ায় মগ্নি, তিনি তার প্রিয়সখা কর্ণ। ক্রমে দান পড়ছিল, আর রানী ভানুমতী পরাজিত হচ্ছিলেন। তার চারুমুখখানি স্বেদান্বিত হচ্ছিল। নাসিকা প্রসারিত হচ্ছিল। আর অঙ্গরাজ? তিনি ভানুমতীর উত্তেজনা দেখে হর্ষ প্রকাশ করছিলেন। জিদের বশবর্তী হয়ে ভানুমতী আবার অক্ষনিক্ষেপ করলেন। এবারেও ভাগ্য তার সহায় হল না। এইসময় রাজা দুর্যোধন কক্ষে নিঃশব্দে প্রবেশ করলেন। পিছন ফিরে বসার জন্য কর্ণ তার আগমন দেখেন নি। কিন্তু রাণী লক্ষ্য করেছেন। চকিতে উঠে দাঁড়ালেন ভানুমতী। কর্ণ ভাবলেন অধিক পরাজয়ের উত্তেজনায় ভানুমতী ক্রীড়া ছেড়ে উঠে যাচ্ছেন। বহু সম্পদ ইতোমধ্যেই হারিয়েছেন ভানুমতী আজকের ক্রীড়ায়। কিন্তু অক্ষক্রীড়ার তো একটা নিয়ম আছে। কর্ণ ছাড়বেন কেন? তিনি সবল হস্তে ভানুমতীর উত্তরাসঙ্গ আকর্ষণ করলেন। শক্তিশালী সে আকর্ষণে ভানুমতীর ঊর্ধ্বাঙ্গ প্রায় অনাবৃত হয়ে গেল। কাঁচুলি স্থানচ্যুত হল। তার কণ্ঠের মোতির মালা ছিন্ন হল। সেইসব অমুল্য মোতিসকল সারা কক্ষে ছড়িয়ে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় কর্ণ বিহ্বল হয়ে গেলেন। ত্রস্ত, লজ্জিত ভানুমতীর গালে শরমের রক্তাভা। দুর্যোধন লক্ষ্য করলেন, তার প্রিয় রাজ্ঞীর অবস্থা। কাঁচুলি স্থানচ্যুত হওয়াতে তার স্তনযুগল দৃশ্যমান। অপূর্ব সুন্দর বরাননে অপমানের ছায়া। ঘটনার আকস্মিকতায় স্থানু হয়ে গেছেন ভানুমতী। তার দৃষ্টি দুর্যোধনের দিকে। সে দৃষ্টিতে এক রাজার করুণা প্রার্থনা। ভানুমতীর দৃষ্টি অনুসরণ করে কর্ণ তাকালেন। তার পিছনে একটু দূরে দণ্ডায়মান দুর্যোধন। কর্ণের মনে তখন আতঙ্ক দেখা দিল। দুর্যোধন তার প্রিয়সখাই নন, তিরি কুরুরাজ্যের সম্রাট। কর্ণ তার অধীন একটি করদরাজ্যের অধিপতি মাত্র। তাও স্বোপার্জিত রাজ্য নয়, দুর্যোধন তার প্রিয়সখাকে অঙ্গ রাজ্য দান করেছেন, কর্ণকে যোগ্য মান্যতা দিতে। ভানুমতী কর্ণের প্রিয়সখী হতে পারেন, কিন্তু তিনি কুরুরাজমহিষী। উত্তেজনার বশে অঙ্গরাজ যা করেছেন, তা অত্যন্ত গর্হিত। কৃতকার্যের জন্য কর্ণের মনে গভীর অনুতাপ জারিত হল। শাস্তির আশঙ্কায় তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন। এই ধীমান বন্ধুটিকে তিনি জানেন, তার সিংহহৃদয়ের কথা কর্ণের থেকে আর বেশি কে জানে? তবু তিনি কুরুসম্রাট আর তার ক্রোধ সর্বজনবিদিত। তা ছাড়া অধিরথপুত্র যা করেছেন, তা অমার্জনীয়। কর্ণের প্রতীক্ষার প্রত্যেক মুহূর্ত যেন অসীমকাল মনে হতে লাগলো। দুর্যোধন বড় কৌতুক অনুভব করলেন। অক্ষক্রীড়া ছেড়ে উঠে যাওয়া, বিশেষতঃ পরাজিতের পক্ষে অনুচিত। কর্ণ এই ভেবে ভানুমতীর বসনাঞ্চল আকর্ষণ করেছে। ভানুমতী রাজাকে দেখেছেন, কিন্তু বসুষেন লক্ষ্য করেন নি। উভয়েই প্রিয়বন্ধু। তিনি কর্ণের দিকে তাকালেন, মুখে তখনও কৌতুক। কর্ণ নতমস্তকে উঠে দাঁড়ালেন তারপর আর বাক্যব্যয় না করে কক্ষ থেকে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রান্ত হলেন। এই ক্ষণে তার শাস্তি হলনা বটে, কিন্তু অনতিবিলম্বে রাজরোষ তার ওপরে নেমে আসবেই। কর্ণ স্মরণ করলেন দ্রুপদনন্দিনীর লাঞ্ছনার কথা। তিনিও সেই লাঞ্ছনার অংশভাক্ ছিলেন। বিধি বড় নিষ্ঠুর! ভানুমতী প্রস্তরমূর্তিবৎ স্থানু হয়ে আছেন। সঘনজঙ্ঘা, গুরুনিতম্বিনী, পীনোন্নতপয়োধরা, দীপ্তকাঞ্চনবর্না কলিঙ্গরাজদূহিতা ভানুমতী। অঙ্গরাজের বলিষ্ঠ আকর্ষণে তার কাঁচুলি স্থানচ্যুত। তার নিরাবরণ স্তনযুগল প্রদীপের আলোয় মোহমেদুর। দুর্যোধন তখন ভূমিগত বিক্ষিপ্ত মোতিগুলি সংগ্রহ করছেন, একত্র করছেন। তারপর সেই মহার্ঘ মুক্তাগুলি সংগ্রহ করে তিনি এগিয়ে এলেন ভানুমতীর দিকে। তার অঞ্জলিবদ্ধ করকমলে মতিসম্ভার অর্পণ করলেন। তারপর ভানুমতীকে বিস্মিত করে দুর্যোধন তার রাজ্ঞীকে প্রগাঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে, তার মুখচুম্বন করলেন! তোষালী নগরী এখন উৎসব মুখর। শরতের উজ্জ্বল প্রভাত। কলিঙ্গের এই রাজধানীটি এতটাই সমৃদ্ধশালী যে নিকট দূরের রাজ্যগুলির তা ঈর্ষার কারণ। রাজা চিত্রাঙ্গদ এখন সিংহাসনে আসীন। তার পুত্রী রাজকুমারী এখন বিবাহযোগ্যা হয়েছেন। রাজকুমারীর রূপের খ্যাতি চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত হয়েছে, গান্ধার থেকে মণিপুর, কাঞ্চী থেকে দ্বারাবতী। মগধ তো লুব্ধ দৃষ্টিতে সর্বক্ষণ তাকিয়ে আছে কলিঙ্গের দিকে। এইজন্যই মহারাজ চিত্রাঙ্গদ ঘোষণা করেছেন তার পুত্রীর স্বয়ম্বরের। বিবাহ একপ্রকার রাজনৈতিক উপায়, বন্ধুত্বস্থাপনের। একটি শক্তিশালী রাজবংশের সাথে রাজকুমারীর বিবাহ হলে, তা কলিঙ্গেরই লাভ। এই বিবাহ উপলক্ষ্যে শত শত শিবির স্থাপনা করা হয়েছে, রাজন্যদের অভ্যর্থনায়। রাজারাজড়া তো একা আসবেন না, তাদের সাথে পাত্রমিত্ররারা আসবেন, সান্ত্রী, সেনা, পুরোহিত আসবেন, আসবেন তাদের গুপ্তপুরুষগণ। তা ছাড়া রাজবাড়ীর বিবাহ বলে কথা, দূর দূরান্তের প্রজারাও আসবে। সার্থবাহরা আসবেন পণ্যের সম্ভার নিয়ে। নটনটী, যাদুকর, বেশ্যা, সাধারণ হাটুরে, সকলেই এসে জমা হচ্ছে তোষালীতে। সমুদ্র থেকে স্বল্প দূরে। কেউ কেউ সমুদ্রতটেও ঘুরে আসছেন। বিপণীগুলি আহার্য, পানীয়, মদ্যে পরিপূর্ণ। কেউ কেউ দেবী চন্ডিকার মন্দিরে যাচ্ছেন দেবীদর্শনে। ফুল মালা দিয়ে অর্চনা করছেন। কিছু তস্করও এসেছে আর এসেছেন অসংখ্য সাধু ও ব্রাহ্মণ। এসেছে কর্মকার, কুম্ভার, চিকিৎসক ইত্যাদি বহু পেশার মানুষজন। আর এসেছে বহুসংখ্যক ধীবর, সামুদ্রিক নানাবিধ দ্রব্যের পশরা নিয়ে। কড়ি, শঙ্খ, প্রবাল ইত্যাদি চমৎকার পণ্যে তাদের অস্থায়ী বিপণী ভরপুর। শঙ্খ বিক্রয় হচ্ছে দেদার। পূর্ব দিকের নারীরা শঙ্খের বলয় বড় পছন্দ করেন। এই শ্বেতশুভ্র বলয় সৌন্দর্যে সুবর্ণবলয়কে ম্লান করে দিতে সক্ষম। শিল্পীর হস্তের অপরূপ সে খোদাইকরা সে শঙ্খ! কে না আসছেন! মগধের মহারাজ জরাসন্ধ, চেদীর পরাক্রান্ত রাজা শিশুপাল, যাবদগণপতি ভীষ্মক, মাহিষ্মতীর রাজা নীল, ভোজরাজ শৃংগ, রাজা বক্র, অশোক প্রমুখ। আগত রাজা মহারাজাদের সেনাদেরদের আগমনে ধুলির ঝড় উঠছে মুহূর্মুহ। কেউ আসছেন গজে, কেউ আসছেন অশ্বারোহনে, কেউ শোভন রথে। স্ব স্ব রাজ্যের নিশান উড়িয়ে। মহামন্ত্রী ও অমাত্যগণ নৃপদের অভ্যর্থনা করছেন যথাযথ। সাদরে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের নির্দিষ্ট শিবিরে। শত শত দাস দাসী নিযুক্ত করা হয়েছে তাদের যথোচিত আপ্যায়নে। প্রত্যেক রাজাদের আলাদা অশ্বশালা, গোশালা, হস্তিশালা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রত্যেক রাজন্যের আগমন সংবাদ ভাট ঘোষণা করছে কম্বুকন্ঠে। মহারাজ চিত্রাঙ্গদ আয়োজনের কোনও ত্রুটি রাখেন নি। দুর্যোধন তার প্রিয়সখা কর্ণের সাথে পৌঁছলেন তোষালী নগরীতে। সঙ্গে হস্তিনাপুরের সৈন্যদল। দুর্যোধনের রথেই কর্ণ আসীন ছিলেন দুর্যোধনের সাথে। তার রথ তাকে অনুসরণ করছিল। রাজপ্রাসাদের নিকটবর্তী হতেই একটি লঘু শর ছুটে এলো। বিদ্ধ করল দুর্যোধনের মুকুট। মুকুটটি শিরোচ্যুত হল। কর্ণ চকিতে শরসন্ধান করতে যাবেন, তাকে থামালেন দুর্যোধন। প্রাসাদ শীর্ষে একদল অঙ্গনা। তার মধ্যেরটি বিদ্যুল্লতার ন্যায়, হস্তে ধনুর্বাণ। দুর্যোধন অনুমান করলেন, তিনিই রাজকুমারী। পরের মুহূর্তেই ললনার দল চক্ষুর আড়ালে চলে গেলো। দুর্যোধন মৃদু হাস্য করে মুকুট কুড়িয়ে নিলেন। কর্ণ আশ্চর্য হলেন দুর্যোধনের শান্ত ব্যবহার দেখে। হস্তিনাপুরের কুরুযুবরাজের মুকুটে শরসন্ধান! তাও যুবরাজ কিছু বললেন না? কর্ণ ভাবিত হন। শরৎ পূর্ণিমার দিন রাজকুমারীর স্বয়ম্বর স্থির হয়েছে। সখী ও দাসীরা রাজকুমারীর গাত্রে হরিদ্রা ও চন্দনলেপ দিলেন। তারপর সুগন্ধীজলে স্নানপর্ব সমাপন হল। অগুরুসুশোভিত ধোঁয়ায় তার কেশপাশ শুস্ক করা হল। কলিঙ্গদেশের রেশমবস্ত্র ভারতবিখ্যাত। বিশেষ নির্বাচিত বয়নকারগণ অতি যত্নে সোনার তন্তু আর ঘন নীল রেশম দিয়ে প্রস্তুত করেছে সে বস্ত্র। নীল বস্ত্রপ্রান্তে সোনালী ময়ূরের সারি। রাজকুমারী পরলেন রত্নখচিত বহুমূল্য কাঁচুলি। গলায় বৈদুর্যের মালা, কটিদেশে সোনার কটিবন্ধ, পায়ে সোনার নূপুর আর হস্তে হাঙ্গরমুখী বলয়। কেশদাম সুসজ্জিত হল রৌপ্যের সিথিতে। মাথার পিছনে চক্রাকার লাজসজ্জা। এইরূপ কেশসজ্জা কলিঙ্গের বৈশিষ্ট। আঁখি পল্লবে কজ্জল আর ওষ্ঠে তাম্বূলরস, লোহিত বর্ণ। কর্ণে কর্ণাভরণ, নাসায় হীরকের নাসাপুস্প। গণ্ডে লোধ্ররেণু। রাজকুমারীকে অপ্সরার মতো দেখাচ্ছিল। স্বয়ম্বরসভাটি প্রশস্ত গোলাকৃতি। চারটি প্রবেশমুখ। উত্তরে দিকটি রাজকীয় প্রবেশদ্বার। পার্শ্বের দুটি রাজাদের আর দক্ষিনেরটি সাধারণের। অপরাহ্ণে স্বয়ম্বর হবে নির্দিষ্ট হয়েছে। স্বয়ম্বর শেষে সন্ধ্যালগ্নে বিবাহ হবে স্থির আছে। মধ্যাহ্নভোজনের পরই ভিড় জমতে শুরু করেছে। তৎপরে এক এক করে রাজারা এলেন সঙ্গীসহকারে। তারা তাদের নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করলে পর ভেরীনাদ হল। প্রবেশ করলেন রাজ্ঞীসহ কলিঙ্গনরেশ চিত্রঙ্গদ। প্রধান পুরোহিত স্বস্তিবাচন করলেন। তারপর রাজা চিত্রাঙ্গদ ঘোষণা করলেন স্বয়ম্বরের অভিপ্রায়। উপস্থিত রাজারা উৎকণ্ঠায় কালযাপন করতে লাগলেন। মঙ্গলশঙ্খের ধ্বনিতে স্বয়ম্বরসভা ধ্বনিত হল। প্রিয়সখীগণ, অঙ্গরক্ষী ও দাসীদের সাথে গজেন্দগমনে প্রবেশ করলেন রাজকুমারী ভানুমতী। একে একে ভাট রাজকুমারীর কাছে রাজাদের বংশ, শৌর্য ইত্যাদির পরিচয় দিলেন। ভানুমতী ক্রমে ভীষ্মক, নীল, শৃংগক অতিক্রম করলেন। তারা হতদ্যম হয়ে বসে পড়লেন। ভানুমতী মগধরাজকেও অতিক্রম করাতে সকলেই বিস্মিত হল। অবশেষে রাজকুমারী এসে দাঁড়ালেন দুর্যোধনের সামনে। স্মিতহাস্যে দুর্যোধন তার চোখে চোখ রাখনেন। ভানুমতী এক মুহূর্ত অপাঙ্গে তাকালেন দুর্যোধনের পানে। তার চক্ষে বিদ্যুৎ। তারপর অগ্রসর হলেন। আর ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল। যুবরাজ দুর্যোধন এক পদ এগ্রসর হয়ে সবলে ভানুমতীর হাত ধরলেন। তারপর তরিৎ গতিতে ভানুমতিকে ভরা স্বয়ম্বর সভা থেকে অপহরণ করে নিষ্ক্রান্ত হলেন। পরিকল্পনা আগেই ঠিক ছিল। দুর্যোধন নিস্কান্ত হতেই কর্ণ সে প্রস্থানপথে সদলবলে দাঁড়ালেন। তিনি জলদকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, “মাননীয় কলিঙ্গরাজ, উপস্থিত মাননীয় রাজন্যবর্গ। রাজদুহিতা ভানুমতী পর্যায় ক্রমে উপস্থিত প্রধান রাজাদের গলায় মালা দেন নি। এতে তাদের ক্ষুব্ধ হবার কারণ নেই, এটাই স্বয়ম্বর সভার প্রথা। তৎপরে হস্তিনাপুরের যুবরাজ দেবী ভানুমতিকে অপহরণ করেছেন। বলপূর্বক অপহরণ ক্ষত্রিয়ের কাছে দূষণীয় নয়। অতীতে এমন ঘটনা ঘটেছে। আপনারা প্রত্যেকেই প্রাজ্ঞ। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন হস্তিনাপুরের বিক্রম সম্পর্কে। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যুবরাজ দুর্যোধনের এ কাজ সমর্থন করবেন। এই মুহূর্ত থেকে দেবী ভানুমতী কুরুকূলবধু। এর পরেও যদি কারোর আপত্তি থাকে অথবা এ বিবাহ অনুমোদন না করেন, তবে আমি অঙ্গরাজ কর্ণ তার সাথে সংগ্রামে প্রস্তুত!” মগধরাজ জরাসন্ধ চুপ করে রইলেন। রাজনৈতিক সমীকরণ তিনি ভাল বোঝেন। ভারতে এই সময়ে তিনটি রাজ্য শক্তিশালী। এই বিবাহের কারণে হস্তিনাপুরকে যুদ্ধে আহ্বান করা সমচীন নয়। তিনি ও ভীষ্মক গ্রাত্রত্থান করলেন। তবু কয়েকজন উত্তেজিত হয়ে কর্ণকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। কর্ণ অনায়াসেই সেইসকল রাজাকে পরাজিত করলেন। এই যুদ্ধ যখন সমাপ্ত হল, দুর্যোধনের চতুরাশ্ব যুক্ত বেগবান রথ গোদাবরী তীরে পৌঁছেছে।
তোষালী নগরী এখন উৎসব মুখর। শরতের উজ্জ্বল প্রভাত। কলিঙ্গের এই রাজধানীটি এতটাই সমৃদ্ধশালী যে নিকট দূরের রাজ্যগুলির তা ঈর্ষার কারণ। রাজা চিত্রাঙ্গদ এখন সিংহাসনে আসীন। তার পুত্রী রাজকুমারী এখন বিবাহযোগ্যা হয়েছেন। রাজকুমারীর রূপের খ্যাতি চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত হয়েছে, গান্ধার থেকে মণিপুর, কাঞ্চী থেকে দ্বারাবতী। মগধ তো লুব্ধ দৃষ্টিতে সর্বক্ষণ তাকিয়ে আছে কলিঙ্গের দিকে। এইজন্যই মহারাজ চিত্রাঙ্গদ ঘোষণা করেছেন তার পুত্রীর স্বয়ম্বরের। বিবাহ একপ্রকার রাজনৈতিক উপায়, বন্ধুত্বস্থাপনের। একটি শক্তিশালী রাজবংশের সাথে রাজকুমারীর বিবাহ হলে, তা কলিঙ্গেরই লাভ। এই বিবাহ উপলক্ষ্যে শত শত শিবির স্থাপনা করা হয়েছে, রাজন্যদের অভ্যর্থনায়। রাজারাজড়া তো একা আসবেন না, তাদের সাথে পাত্রমিত্ররারা আসবেন, সান্ত্রী, সেনা, পুরোহিত আসবেন, আসবেন তাদের গুপ্তপুরুষগণ। তা ছাড়া রাজবাড়ীর বিবাহ বলে কথা, দূর দূরান্তের প্রজারাও আসবে। সার্থবাহরা আসবেন পণ্যের সম্ভার নিয়ে। নটনটী, যাদুকর, বেশ্যা, সাধারণ হাটুরে, সকলেই এসে জমা হচ্ছে তোষালীতে। সমুদ্র থেকে স্বল্প দূরে। কেউ কেউ সমুদ্রতটেও ঘুরে আসছেন। বিপণীগুলি আহার্য, পানীয়, মদ্যে পরিপূর্ণ। কেউ কেউ দেবী চন্ডিকার মন্দিরে যাচ্ছেন দেবীদর্শনে। ফুল মালা দিয়ে অর্চনা করছেন। কিছু তস্করও এসেছে আর এসেছেন অসংখ্য সাধু ও ব্রাহ্মণ। এসেছে কর্মকার, কুম্ভার, চিকিৎসক ইত্যাদি বহু পেশার মানুষজন। আর এসেছে বহুসংখ্যক ধীবর, সামুদ্রিক নানাবিধ দ্রব্যের পশরা নিয়ে। কড়ি, শঙ্খ, প্রবাল ইত্যাদি চমৎকার পণ্যে তাদের অস্থায়ী বিপণী ভরপুর। শঙ্খ বিক্রয় হচ্ছে দেদার। পূর্ব দিকের নারীরা শঙ্খের বলয় বড় পছন্দ করেন। এই শ্বেতশুভ্র বলয় সৌন্দর্যে সুবর্ণবলয়কে ম্লান করে দিতে সক্ষম। শিল্পীর হস্তের অপরূপ সে খোদাইকরা সে শঙ্খ! কে না আসছেন! মগধের মহারাজ জরাসন্ধ, চেদীর পরাক্রান্ত রাজা শিশুপাল, যাবদগণপতি ভীষ্মক, মাহিষ্মতীর রাজা নীল, ভোজরাজ শৃংগ, রাজা বক্র, অশোক প্রমুখ। আগত রাজা মহারাজাদের সেনাদেরদের আগমনে ধুলির ঝড় উঠছে মুহূর্মুহ। কেউ আসছেন গজে, কেউ আসছেন অশ্বারোহনে, কেউ শোভন রথে। স্ব স্ব রাজ্যের নিশান উড়িয়ে। মহামন্ত্রী ও অমাত্যগণ নৃপদের অভ্যর্থনা করছেন যথাযথ। সাদরে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের নির্দিষ্ট শিবিরে। শত শত দাস দাসী নিযুক্ত করা হয়েছে তাদের যথোচিত আপ্যায়নে। প্রত্যেক রাজাদের আলাদা অশ্বশালা, গোশালা, হস্তিশালা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রত্যেক রাজন্যের আগমন সংবাদ ভাট ঘোষণা করছে কম্বুকন্ঠে। মহারাজ চিত্রাঙ্গদ আয়োজনের কোনও ত্রুটি রাখেন নি। দুর্যোধন তার প্রিয়সখা কর্ণের সাথে পৌঁছলেন তোষালী নগরীতে। সঙ্গে হস্তিনাপুরের সৈন্যদল। দুর্যোধনের রথেই কর্ণ আসীন ছিলেন দুর্যোধনের সাথে। তার রথ তাকে অনুসরণ করছিল। রাজপ্রাসাদের নিকটবর্তী হতেই একটি লঘু শর ছুটে এলো। বিদ্ধ করল দুর্যোধনের মুকুট। মুকুটটি শিরোচ্যুত হল। কর্ণ চকিতে শরসন্ধান করতে যাবেন, তাকে থামালেন দুর্যোধন। প্রাসাদ শীর্ষে একদল অঙ্গনা। তার মধ্যেরটি বিদ্যুল্লতার ন্যায়, হস্তে ধনুর্বাণ। দুর্যোধন অনুমান করলেন, তিনিই রাজকুমারী। পরের মুহূর্তেই ললনার দল চক্ষুর আড়ালে চলে গেলো। দুর্যোধন মৃদু হাস্য করে মুকুট কুড়িয়ে নিলেন। কর্ণ আশ্চর্য হলেন দুর্যোধনের শান্ত ব্যবহার দেখে। হস্তিনাপুরের কুরুযুবরাজের মুকুটে শরসন্ধান! তাও যুবরাজ কিছু বললেন না? কর্ণ ভাবিত হন। শরৎ পূর্ণিমার দিন রাজকুমারীর স্বয়ম্বর স্থির হয়েছে। সখী ও দাসীরা রাজকুমারীর গাত্রে হরিদ্রা ও চন্দনলেপ দিলেন। তারপর সুগন্ধীজলে স্নানপর্ব সমাপন হল। অগুরুসুশোভিত ধোঁয়ায় তার কেশপাশ শুস্ক করা হল। কলিঙ্গদেশের রেশমবস্ত্র ভারতবিখ্যাত। বিশেষ নির্বাচিত বয়নকারগণ অতি যত্নে সোনার তন্তু আর ঘন নীল রেশম দিয়ে প্রস্তুত করেছে সে বস্ত্র। নীল বস্ত্রপ্রান্তে সোনালী ময়ূরের সারি। রাজকুমারী পরলেন রত্নখচিত বহুমূল্য কাঁচুলি। গলায় বৈদুর্যের মালা, কটিদেশে সোনার কটিবন্ধ, পায়ে সোনার নূপুর আর হস্তে হাঙ্গরমুখী বলয়। কেশদাম সুসজ্জিত হল রৌপ্যের সিথিতে। মাথার পিছনে চক্রাকার লাজসজ্জা। এইরূপ কেশসজ্জা কলিঙ্গের বৈশিষ্ট। আঁখি পল্লবে কজ্জল আর ওষ্ঠে তাম্বূলরস, লোহিত বর্ণ। কর্ণে কর্ণাভরণ, নাসায় হীরকের নাসাপুস্প। গণ্ডে লোধ্ররেণু। রাজকুমারীকে অপ্সরার মতো দেখাচ্ছিল। স্বয়ম্বরসভাটি প্রশস্ত গোলাকৃতি। চারটি প্রবেশমুখ। উত্তরে দিকটি রাজকীয় প্রবেশদ্বার। পার্শ্বের দুটি রাজাদের আর দক্ষিনেরটি সাধারণের। অপরাহ্ণে স্বয়ম্বর হবে নির্দিষ্ট হয়েছে। স্বয়ম্বর শেষে সন্ধ্যালগ্নে বিবাহ হবে স্থির আছে। মধ্যাহ্নভোজনের পরই ভিড় জমতে শুরু করেছে। তৎপরে এক এক করে রাজারা এলেন সঙ্গীসহকারে। তারা তাদের নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করলে পর ভেরীনাদ হল। প্রবেশ করলেন রাজ্ঞীসহ কলিঙ্গনরেশ চিত্রঙ্গদ। প্রধান পুরোহিত স্বস্তিবাচন করলেন। তারপর রাজা চিত্রাঙ্গদ ঘোষণা করলেন স্বয়ম্বরের অভিপ্রায়। উপস্থিত রাজারা উৎকণ্ঠায় কালযাপন করতে লাগলেন। মঙ্গলশঙ্খের ধ্বনিতে স্বয়ম্বরসভা ধ্বনিত হল। প্রিয়সখীগণ, অঙ্গরক্ষী ও দাসীদের সাথে গজেন্দগমনে প্রবেশ করলেন রাজকুমারী ভানুমতী। একে একে ভাট রাজকুমারীর কাছে রাজাদের বংশ, শৌর্য ইত্যাদির পরিচয় দিলেন। ভানুমতী ক্রমে ভীষ্মক, নীল, শৃংগক অতিক্রম করলেন। তারা হতদ্যম হয়ে বসে পড়লেন। ভানুমতী মগধরাজকেও অতিক্রম করাতে সকলেই বিস্মিত হল। অবশেষে রাজকুমারী এসে দাঁড়ালেন দুর্যোধনের সামনে। স্মিতহাস্যে দুর্যোধন তার চোখে চোখ রাখনেন। ভানুমতী এক মুহূর্ত অপাঙ্গে তাকালেন দুর্যোধনের পানে। তার চক্ষে বিদ্যুৎ। তারপর অগ্রসর হলেন। আর ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল। যুবরাজ দুর্যোধন এক পদ এগ্রসর হয়ে সবলে ভানুমতীর হাত ধরলেন। তারপর তরিৎ গতিতে ভানুমতিকে ভরা স্বয়ম্বর সভা থেকে অপহরণ করে নিষ্ক্রান্ত হলেন। পরিকল্পনা আগেই ঠিক ছিল। দুর্যোধন নিস্কান্ত হতেই কর্ণ সে প্রস্থানপথে সদলবলে দাঁড়ালেন। তিনি জলদকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, “মাননীয় কলিঙ্গরাজ, উপস্থিত মাননীয় রাজন্যবর্গ। রাজদুহিতা ভানুমতী পর্যায় ক্রমে উপস্থিত প্রধান রাজাদের গলায় মালা দেন নি। এতে তাদের ক্ষুব্ধ হবার কারণ নেই, এটাই স্বয়ম্বর সভার প্রথা। তৎপরে হস্তিনাপুরের যুবরাজ দেবী ভানুমতিকে অপহরণ করেছেন। বলপূর্বক অপহরণ ক্ষত্রিয়ের কাছে দূষণীয় নয়। অতীতে এমন ঘটনা ঘটেছে। আপনারা প্রত্যেকেই প্রাজ্ঞ। আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন হস্তিনাপুরের বিক্রম সম্পর্কে। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যুবরাজ দুর্যোধনের এ কাজ সমর্থন করবেন। এই মুহূর্ত থেকে দেবী ভানুমতী কুরুকূলবধু। এর পরেও যদি কারোর আপত্তি থাকে অথবা এ বিবাহ অনুমোদন না করেন, তবে আমি অঙ্গরাজ কর্ণ তার সাথে সংগ্রামে প্রস্তুত!” মগধরাজ জরাসন্ধ চুপ করে রইলেন। রাজনৈতিক সমীকরণ তিনি ভাল বোঝেন। ভারতে এই সময়ে তিনটি রাজ্য শক্তিশালী। এই বিবাহের কারণে হস্তিনাপুরকে যুদ্ধে আহ্বান করা সমচীন নয়। তিনি ও ভীষ্মক গ্রাত্রত্থান করলেন। তবু কয়েকজন উত্তেজিত হয়ে কর্ণকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। কর্ণ অনায়াসেই সেইসকল রাজাকে পরাজিত করলেন। এই যুদ্ধ যখন সমাপ্ত হল, দুর্যোধনের চতুরাশ্ব যুক্ত বেগবান রথ গোদাবরী তীরে পৌঁছেছে।
মধ্যে মধ্যে মিত্র কর্ণকে নিয়ে ধাঁধা হয় মনে। বীর, উদার, দানী কর্ণ যে মনে মনে পাণ্ডবদের ঘৃণা করেন, তা দুর্যোধন অনুভব করেন। তার নিজের সাথে পাণ্ডবদের শত্রুতার তবু একটা কারণ আছে। কারা কুরুবংশের সিংহাসনে বসবেন, সেই বিবাদের নিষ্পত্তি কিভাবে হবে, তা নিয়ে পাণ্ডবদের সাথে তার দ্বন্দ্ব। কিন্তু কর্ণ তো জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব! মাতা কুন্তীর গর্ভে ঋষি দুর্বাসার পুত্র। ঋষি দুর্বাসা মাতা কুন্তির পালকপিতা কুন্তিভোজের আতিথ্য গ্রহণ করেন। ঋষির আপ্যায়নের নিমিত্ত কুন্তি সেই কাজে নিযুক্ত হন এক বৎসর। সেই সেবার ফলে কুন্তি গর্ভবতী হন। কর্ণের জন্ম হয়। কুমারী কুন্তি রাজার আজ্ঞায় সেই শিশুকে ত্যাগ করেন। সকলেই জানেন, শুধু কেউ কেউ না জানার ভাণ করেন। কর্ণের ক্ষত্রিয়ত্ব লাভই কি একমাত্র লক্ষ্য? আর সে পথে কণ্টক হল স্বয়ং পাণ্ডব ভ্রাতাগণ। তাই সম্ভবত কর্ণ এরূপ পাণ্ডব বিরোধী। তাই তিনি কর্ণকে ব্যবহার করেন। কর্ণকে তার প্রয়োজন। পিতামহ ভীষ্ম, তাত বিদুর, গুরু দ্রোণাচার্যের পরামর্শে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে যৌবরাজ্যে অধিষ্ঠিত করেছেন বটে একরকম বাধ্য হয়েই। কিন্তু মনে মনে তিনি অখুশি। আর অখুশি অঙ্গরাজ কর্ণ। নিজের রাজ্যে কদাচ গমন করেন না, সদা কুরুরাজধানীতেই অধিষ্ঠান করেন। মাতুল শকুনির পরামর্শে যখন পাণ্ডবভ্রাতাদের বারণাবত নগরীতে প্রেরণ করার প্রস্তাব হল, তখন তাদের নিজেদের মধ্যেই মতান্তর ছিল। দুর্যোধন তাদের গুপ্তহত্যার বিরোধী ছিলেন। বসুষেন আর মাতুল শকুনি সেই পরিকল্পনার দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। দুর্যোধন আশঙ্কা করেছিলেন রাজপ্রাসাদে মহামন্ত্রি বিদুরের গুহ্যপুরুষ সর্বত্র। ফলে অচিরেই পরিকল্পনা যুধিষ্ঠিরের গোচরে এলো। ধৃতরাষ্ট্রর মুখ পুড়ল। দুর্যোধনেরও, কারণ এই ষড়যন্ত্রে তো তিনিও অংশভাক্ ছিলেন। সমগ্র আর্যাবর্তে কৌরবগণ নিন্দিত হলেন। বিদুরের সহায়তায় বরং পাণ্ডবরা কৌরবদের নিশ্ছিদ্র জাল ছিন্ন করে পলায়ন করলেন। বিদুরের সাহায্যে সকুন্তী পাণ্ডবেরা বারণাবত নগরী থেকে পলায়ন করলেন। ব্যসদেবের পরামর্শে তারা একচক্রা গ্রামে আশ্রয় নিলেন। কিন্তু একটি বিষয় বড় ভাবাচ্ছে দুর্যোধনকে। পাঁচ পুত্রসহ নিষাদ রমণীর হত্যা। সামান্য খাদ্যে প্রলভিত করে মদ্যে নেশাতুর করে তাদের অগ্নি সমর্পণ করা কি বীরত্ব, তা কি ক্ষত্রিয়ত্ব? তা কোন ধর্ম? যুধিষ্ঠির নিজেকে ধর্মরাজ বলে মনে মনে প্রসাদ অনুভব করেন। তা হলে কোনও ধর্মমত বলে নিরীহ নিশাদগণের হত্যা তিনি সমর্থন করলেন? নিজের পিতৃপরিচয় তিনি কি জানেন না? তিনি যে তার বিদুরের ঔরসজাত, তা তো মাতা কুন্তী জানেন। তাহলে সেই ক্ষত্তপুত্র রাজসিংহাসন দাবী করেন কোন অধিকারে? তাত মহারাজ পাণ্ডু অসমর্থ ছিলেন, তাই সিংহাসনের দাবী করার জন্য মাতা কুন্তীকে প্রেরণ করেছেন নানা পুরুষের শয্যায়, মাতা মাদ্রীকেও। সেটাও নাকি ধর্ম! দুর্যোধনের বিবমিষা লাগে। আর এই ঋষিগণ! ধর্মের ভেকধারী মূর্তিমান অধর্ম। এইসব মহাত্মাগণ সকলেই রাজানুগ্রহপ্রার্থী। বর্ণভেদ ব্যবস্থা চালু করে সমাজের শীর্ষে আসীন। সকলেই বেদানুসারী, তথাপি প্রত্যেকের এক একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী। গোষ্ঠীগুলির মধ্যে চূড়ান্ত বিরোধ। কোন গোষ্ঠী কোন রাজপরিবারকে নিজেদের প্রভাবাধীন রাখবেন এই নিয়ে লড়াই। যেমন পিতামহ মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। বৃদ্ধপিতামহীর কানীন পুত্র তিনি। মহর্ষি পরাশর তাকে ধর্ষণ করেছিলেন একাকী নৌকা আরোহণে। পরাশরের সাথে ব্যাসের পিতাপুত্রের সম্পর্ক খুবই সুদৃঢ়, তিনি দ্বৈপায়নের গুরুও বটে। অগস্ত্যের পর তিনিও বেদ বিভাজন করেছেন। এই বেদ কালে কালে অনেকেই বিভাজন করেছেন। সেইতো আদি বেদ ঋককে ভাগ করা। যেমন যেমন যাগযজ্ঞের জাকজমক বেড়েছে, তেমনই মন্ত্রের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। বেদ গীতও হয়, তাই তার ছন্দ ও সুর প্রামাণ্য করে রাখতে হয়। তাই আবার বেদ বিভাজন করতে হয়েছে। দুর্যোধন নিজেও বেদশিক্ষা করেছেন। তিনি জানেন প্রাকৃত নানা যাদু, তন্ত্র, ইত্যাদি বেদে প্রবেশ করেছে। বেদ আর কেবল ব্রহ্মসাধনা নয়। এককালে যা ছিল এ জগতকে জানার এবং মানুষের নিজেকে জানার বৌদ্ধিক সন্ধান, তাই আজ ক্ষমতা দখলের উপায়ে পরিণত হয়েছে। তা বেদে শুধু ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের অধিকার। ব্রাহ্মণগণ প্রচার করেন, বেদই ঈশ্বরসাধনা। যিনি বেদে আস্থা রাখেন না,তাদের বিধান অনুযায়ী, তিনি ঈশ্বরেও বিশ্বাস করেন না। তাই তারা নাস্তিক। এখন ব্রহ্মের ক্ষমতা ক্ষীয়মাণ, বিষ্ণু এখন প্রধান দেবতা। আর্যাবর্তে বহু মানুষ বিষ্ণুর অবতারে বিশ্বাস করে। তাই বিষ্ণুর অবতারের ছড়াছড়ি। এই কালখণ্ডে তিনজন বিষ্ণুর অবতার বর্তমান। জামদগ্ন্য পরশুরাম, তার অস্ত্রগুরু হলধারি বলরাম আর তার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা বাসুদেব কৃষ্ণ! দুর্যোধন ভাবেন আর্যাবর্তে ব্রাহ্মন্যধর্ম এই মুহুর্তে প্রধান শক্তিশালী হলেও, সমাজ থেমে থাকে না। তার অন্দরে বহুবিধ সংঘর্ষ চলতেই থাকে। বানিজ্যব্যবস্থা ক্রমে শক্তিশালী হচ্ছে। গঙ্গা যমুনা দোয়াবে উদ্বৃত্ত ফসল রপ্তানি হচ্ছে অন্যত্র। রাজাদের সৈন্যবাহিনী মূলত শূদ্র কৃষকে পরিপূর্ণ। কৃষির বিস্তারে তাদের হাতে খাদ্য এসেছে, তাই তারা যুদ্ধের বদলে সুস্থিতি চায়। রাজারা চান রাজ্যবিস্তার, ব্রাহ্মণরা চান তাদের প্রাভাবের বিস্তার। ব্রাহ্মণ তাই বর্ণভেদকে অস্ত্র করেছেন। ক্ষত্রিয় রাজার ক্ষমতা তার যুদ্ধক্ষমতা, সৈন্যদল। যুদ্ধবিগ্রহে লাভ হয় রাজন্যগণের, ব্রাহ্মণ ঋষিগণের, কিন্তু শুধু ক্ষতি হয় প্রজার, বার্তাশস্ত্রজীবিদের। তা ছাড়াও আছে আরাধ্য দেবদেবীর দ্বন্দ্ব। ব্রাহ্মন্যধর্ম এখন আর নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা করে না। তাদের বহু ভাগ। সৌর, গাণপত্য, বৈষ্ণব, শৈব ইত্যাদি। তন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে শাক্তধারার সৃষ্টি হয়েছে। বেদবাদীগণ বিপরীত ক্রিয়ায় অসংখ্য দেব দেবী কল্পনা করে চলেছেন। দুর্যোধন মনে মনে হাসেন। সকলেই ক্ষমতালোভী, কুযশের ভাগী শুধু হলেন কৌরবগণ! ভানুমতী বড় বিষণ্ণ। রুষ্টও বটে। সখা কর্ণ ও আর্য দুর্যোধন চলেছেন পাঞ্চালরাজের দুহিতার স্বয়ম্বরসভায়। ক্ষত্রিয় পুরুষদের এই বহুবিবাহের ধারণা যে কত ভ্রান্ত, তা কে শোনে। পশুপালক আর্যগণ যখন এ দেশে আসেন, তখন তাদের সাথে রমণী থাকতেন না। প্রাকৃতিক কারণেই তারা এ দেশীয় নারীদের বিবাহ করতেন। তারপর দ্রুত নিজেদের গোষ্ঠীর বিস্তারে তারা একাধিক দার পরিগ্রহ করতেন। কিন্তু তো অনেক কাল পূর্বের কথা! আসলে আর্যরা তাদের জীবনে নারীর কোনও মুল্য দেন না। এমনকি বিষ্ণুর অবতার বলে যিনি নিজেকে প্রচার করেন, সেই বাসুদেব কৃষ্ণও নন। ইতিমধ্যেই আটটি নারীকে স্ত্রীরূপে গ্রহন করেছেন। বসুষেন ইতিমধ্যেই দু দুটি বিবাহ করেছেন। তার মধ্যে একজন তার প্রিয়সখী সুপ্রিয়া। তিনিও চলেছেন পাঞ্চালে। তার বহু অবিবাহিত দেবর আছেন, কই তাদের তো পাঠাতে পারতেন আর্য দুর্যোধন। ভানুমতী শুনেছেন বহু নৃপ, যারা পাঞ্চালীর পিতা বা পিতামহসম, তারাও এই স্বয়ম্বরে লালায়িত হয়ে পাঞ্চালে ধাবিত হচ্ছেন। আর্য দুর্যোধন তো নিজেকে এই সকলদের থেকে পৃথক দাবী করেন। তিনিও লোভের বশবর্তী হয়ে পাঞ্চালদেশে গমন করবেন বলে স্থির করেছে। এই ক্ষত্রিয়গন এত অমানবিক কেন? ভানুমতী দীর্ঘশ্বাস মোচন করেন। শ্বশ্রূমাতা গান্ধারীর নিকট ভানুমতী দ্রুপদনন্দিনীর জন্মবৃতান্ত শুনেছেন। মহারাজ দ্রুপদের ঔরসে এক সন্তানের জন্ম হয়, কিন্তু সন্তানটি নপুংসক হওয়ার কারণে পাঞ্চাল সিংহাসনের উত্তরাধিকারী অনিশ্চিত হয়ে যায়। রাজা দ্রুপদ বিশেষভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তারপর ঋষিদের অনুরোধে নিয়োগ প্রথা আশ্রয় নেন। এই কার্যে যাজ ও উপযাজ নামে দুই ব্রাহ্মণ মহারানীতে উপগত হন। সেই নিযুক্তিতে দ্রুপদের দুই সন্তানের জন্ম হয়। অবশ্যা প্রজাদের বিভ্রান্ত করার জন্য যাগযজ্ঞের আয়োজন করেন রাজা দ্রুপদ। যথাকালে সেই সন্তানেরা রাজকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন ও কৃষ্ণা বলে পরিচিত হন। কৃষ্ণা নীলকেশী, পলাশলোচনা, পীনন্নত পয়োধরা, অসামান্য সুন্দরী। দ্রোণের কাছে পরাজিত হবার কারণে দ্রুপদের মনে প্রতিশোধের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছিল। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তার সন্তান এর প্রতিশোধ নেবে। তাতেও নিশ্চিত না হয়ে তিনি দ্রৌপদীর সাথে সর্বশ্রেষ্ঠ ধানুকী অর্জুনের বিবাহ স্থির করলেন। কিন্তু একটি বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে। স্বয়ম্বরমন্ডপের শীর্ষে দুটি ঘূর্ণায়মান চক্র। পরস্পর বিপরীত দিকে ঘুরছে। সকল রাজা যখন লক্ষ্যবিদ্ধ করার জন্য বাহ্যাড়ম্বর করছেন, তখন অর্জুন একান্তচিত্তে সেই চক্রদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। দুটি চক্র ভিন্ন গতিতে ঘুরছে। তার উপরে মৎস্যের চক্ষু, ওইটাই বিদ্ধ করতে হবে। একটি বিশেষ মুহূর্তে চক্রদ্বয়ের অক্ষগুলি এক স্থানে আসে। তারপরই আবার একে অপরকে রুদ্ধ করে। আর ধনুকটিও বিশেষ। যুদ্ধে এ ধনুক ব্যবহার হয় না। এ ধনুক তিনি দেখেছেন শবরদের নিকট। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে শরসন্ধান করা যায়। বনে বৃক্ষাম্ভন্তরে ধাবমান হরিণাদি পশুকে তিরবিদ্ধ করা বেশ কঠিন। ছিলার আকর্ষণ অধিক হবে না, অথচ শর নিক্ষিপ্ত হবে দ্রুতগতিতে। অর্জুন মনে মনে তুষ্ট হলেন। কোনও রাজাই লক্ষ্যবিদ্ধ করতে পারলেন না। কর্ণও না। কৃষ্ণ এসেছেন পুত্র শাম্বের সাথে। তারা দুজনেই দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর প্রার্থী। অর্জুন কৌতুক অনুভব করলেন। অবশেষে সকল ক্ষত্রিয়গণ ক্ষান্ত দিলে ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন লক্ষ্যবিদ্ধ করলেন। দ্রুপদ মনে মনে অত্যন্ত পুলকিত হলেন। ক্ষত্রিয় রাজারা গোল বাধালেন। যুদ্ধের উপক্রম হতে কৃষ্ণ মধ্যস্থতা করলে সকলকে শান্ত করলেন। ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্নের সাথে যাজ্ঞসেনী গজেন্দ্রগমনে সভায় এলেন। অর্জুনের সাথে তার শুভদৃষ্টি হল। তিনি অর্জুনের গলায় বরমালা দিলেন। অর্জুন কৃষ্ণাকে বিবাহ তো করলেন, কিন্তু কুন্তী লক্ষ্য করলেন ভাতৃবধুর প্রতি যুধিষ্ঠিরের কামনার দৃষ্টি। অন্য ভ্রাতাদের এমন মনে হতে পারে এই আশঙ্কায় কুন্তী ওপর চার ভ্রাতাকেও যাজ্ঞসেনীর পতিরূপে বরণ করলেন। একদা লাঞ্ছিতা, বহুভোগ্যা কুন্তীর মনে কি বিজাতীয় ঘৃণা জন্মেছিল ক্ষত্রিয় পুরুষদের প্রতি। আর নারীদের প্রতি হিংসা? আর ভানুমতী সমস্ত বিবরণ শুনলেন। কৃষ্ণার দুঃখে তিনি কাঁদলেন। আর তার ভর্তা সুযোধন? তার প্রতি ভানুমতীর যে শ্রদ্ধা ছিল, তা অবশ হয়ে গেলো।
ইন্দ্রপ্রস্থে সাজসাজ রব। হস্তিনাপুর থেকে স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র এসেছেন, এসেছেন গাঙ্গেয় ভীষ্ম, বিদুর, দ্রোণ সহ দুর্যোধন। এসেছেন বহু ঋষিগণ। স্বয়ং কেশব তো আছেনই। আর এসেছেন মাতা গান্ধারী আর সন্তানসহ দেবী ভানুমতী। বহুদিন পরে এই পারিবারিক মিলনে ইন্দ্রপ্রস্থ আনন্দে ভরপুর। দুর্যোধন ও পাণ্ডব ভাইদের দেখে কে বলবে, এরা ঘোষিত শত্রু। পাঞ্চালীর অন্তঃপুরে ভানুমতীর স্থান হয়েছে। তারও তো পাঁচ বালকপুত্র। দুর্যোধনের অপত্যদের সাথে মিলে সাত। পাঞ্চালীর গৃহাভ্যন্তর সাতটি শিশুর কলকাকলিতে পূর্ণ। অতিথি সৎকারের ফাঁকে পাঞ্চালি ও ভানুমতী একান্তে গল্প করেন। মাতা কুন্তী আর মাতা গান্ধারীর বড় পরিতোষ। জীবনের এই খণ্ডকালের সুখ বড় বেশি ক্ষণস্থায়ী মনে হয় যেন। এ আনন্দ কি কুরুবংশে বেশিদিন সইবে? আনন্দের উদ্বেলতার মাঝে গোপনে দীর্ঘশ্বাস মোচন করেন কুরুললনাগণ। সব যুদ্ধেই আগে লাঞ্ছিত হন নারীরা, এতো যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। তাদের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা তো সেই কথাই বলে। তবু ক্ষনিকের জন্য হলেও, এ দুর্মূল্য আনন্দ তারা দুহাতে আঁকড়ে ধরছেন পরম মমতায়। যুধিষ্ঠিরের মনে সাধ জেগেছে রাজসূয় যজ্ঞের। চক্রবর্তী সম্রাটরাই তো রাজসূয় যজ্ঞ করেন। কিন্তু পাণ্ডবেরা তো হস্তিনাপুরের অধীনস্ত, সার্বভৌম নয়। গাঙ্গেয় ভীষ্ম বা বিদুর মুখে কিছু বললেন না। কিন্তু দুর্যোধনের মনে শঙ্কার ছায়া দেখা দিল। মনে মনে রুষ্ট হলেন ধৃতরাষ্ট্র। যুধিষ্ঠির কি বুঝতে পারেন নি এই কথাটি? নাকি ইচ্ছে করেই দুর্যোধনকে তিনি প্রতিস্পর্ধা দেখাতে চাইছিলেন? অজেয় অর্জুন, মহাশক্তিধর ভীমসেন, মিত্র কেশব তাকে সেইমত মদগর্বী করে তুলেছিল?? অনুমান করলেন শুধু কৃষ্ণ। তিনি একান্তে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “রাজন! রাজসূয় যজ্ঞের অর্থ হল সকল রাজাদের আপনার ক্ষমতাকে স্বীকার করা। এই নয় যে সকল রাজ্যকে বাহুবলে পরাজিত করা, কিন্তু ক্ষমতায় আপনার শ্রেষ্ঠত্বকে অনুমোদন করা। বর্তমান সময়ে ভারতবর্ষের সকল রাজা কি তা করেন? কেউ যদি আপনার যজ্ঞের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন, তা হলে যজ্ঞের উদ্দেশ্য ব্যহত হবে। যাদব গণপতি ভীষ্মক, চেদীরাজ শিশুপাল, এবং সর্বশেষে মগধরাজ জরাসন্ধ কি আপনার সারবভৌমত্ব মেনে নেবেন? যদি না নেন, তবে আপনার যজ্ঞ করে কি লাভ হবে, একমাত্র হাস্যাস্পদ হওয়া ছাড়া? তা হলে সর্বাপেক্ষা খুশি হবেন আর্য দুর্যোধন!” অনেকক্ষণ চুপ থেকে অর্জুন প্রশ্ন করলেন, “তাহলে উপায় কি, মাধব?” কৃষ্ণ বললেন, “জরাসন্ধের নিধন! জরাসন্ধ নিহত হলে চেদীরাজ ও অন্যান্য রাজাগন হতোদ্যম হয়ে পরবেন! জয়াসন্ধ কৌরবদের বন্ধু নন, তাই হস্তিনাপুর হতে কোনও আশঙ্কা নেই!” কৃষ্ণের পরামর্শ মতো জরাসন্ধের হত্যা পরিকল্পনা করা হল গোপনে। নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনা, সম্মুখসমর নয়, গুপ্তঘাত। সম্মুখসমরে জরাসন্ধকে পরাজিত ক্ষমতা পাণ্ডব ও যাবদদের মিলিত শক্তির পক্ষেও অসম্ভব ছিল। জরাসন্ধ বহুদিন ধরেই যাদবদের পথের কাঁটা, সেই কংসের নিধনের পর থেকেই। তারই কারণে যাদবদের দ্বারকায় পলায়ন একপ্রকার। যুধিষ্ঠির তার রাজসূয় যজ্ঞ স্থগিত রাখছেন, এ সংবাদ পৌঁছল ধৃতরাষ্ট্র সমীপে। তিনি সন্তোষ প্রকাশ করলেন। কিন্তু দুর্যোধন? তিনি ভাবলেন, এর মধ্যে কি অন্য অর্থ লুকিয়ে আছে। বিশেষ করে মাধব বড় চতুর ব্যক্তি। পরিকল্পনামাফিক বিভিন্ন সময়ান্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল যাত্রা করল পাটলীপুত্রের অভিমুখে। অগ্রবর্তী কয়েকটি দল যাত্রা করা পর আর একটি ছোট দল রওনা হল, সে দলে কৃষ্ণ, ভীম আর অর্জুন। সাথে তাদের নির্বাচিত দেহরক্ষী। তারাওo যাদব যোদ্ধা, কৃষ্ণের নির্বাচিত। তারা চললেন ব্রাহ্মণের বেশে। পাটলীপুত্রে জরাসন্ধের রাজগৃহ যথেষ্ট সুদৃঢ় ও বিশাল। একপাশ দিয়ে পবিত্র ভাগীরথী বয়ে যাচ্ছে। পাটলীপুত্র ভারতের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ জনপদ। প্রাচীনও বটে। জরাসন্ধ নিজে পরম শৈব, তথাপি তার রাজত্বে বৈষ্ণব, শাক্ত, গাণপত্য, চার্বাকপন্থী সকলেই বাস করেন। তন্ত্রবাদী জরা গোষ্ঠী মহারাজের বিশেষ প্রিয়। শৈশবে মহারাজের অবয়বে একটি বিশেষ অসুখ ধরা পড়ে। তার পদসন্ধির যায়গাটি বিশেষ দুর্বল। এই জরা গোষ্ঠীর যিনি প্রধানা, তিনি বিশেষ ওষধি প্রয়োগ করে তাকে সুস্থ করেন। জরাসন্ধের পিতা সেইজন্য জরা গোষ্ঠীকে আজীবন সাহায্যের আশ্বাস দেন। সেই প্রধানা জরাসন্ধের নিমিত্ত একটি বিশেষ বন্ধনীর ব্যবস্থা করেন কিছুদিন অন্তর অন্তর। মহারাজ সারা দিনমান সেই বন্ধনী পরে থাকেন, কেবল রাত্রে দেবার্চনার সময় খুলে রাখেন সযত্নে। বন্ধনী পরিহিত জরাসন্ধকে মল্লে পরাজিত কেউ করতে পারেন না, এমনকি ভীমসেনও না। অমিত বলশালী জরাসন্ধ অন্যান্য যুদ্ধেও অতি সক্ষম যোদ্ধা। এ সমস্ত সংবাদ কৃষ্ণকে দিয়েছিলে তার বিশেষ গুঢ়পুরুষেরা। সভাগারে উপবেসিত আছেন মহারাজ জরাসন্ধ। তার দর্শনপ্রার্থী আজ তিন ব্রাহ্মণ। তারা শৈব দর্শনের বিশেষ কিছু প্রশ্ন নিয়ে মহারাজের সাথে আলোচনা করতে প্রত্যাশী। মহারাজ সানন্দে আলোচনার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। ব্রাহ্মণগণ নিবেদন করলেন, সভাগৃহে নয়, মহারাজের উপাসনাগারে, স্বয়ং মহাকালের সম্মুখে তারা এই আলোচনা করতে চান। জরাসন্ধ আনন্দে সম্মতি দিলেন। ঠিক হল সূর্যাস্তের পর ব্রাহ্মণেরা যেন তার সমীপে আসেন। দিনকর অস্তাচলে গেছেন। রাজপুরীতে জ্বলে উঠেছে মশালের আলো। তিন ব্রাহ্মণ রাজপুরীতে এলেন। পরনে শুভ্র বসন ও উত্তরীয়। রক্ষীরা তাদের প্রবেশ করতে দিল। ব্রাহ্মণেরা তারপর রাজকীয় উপাসনালয়ে প্রবিষ্ট হলেন। মহারাজ তখন তার বিশেষ বন্ধনীমুক্ত হয়ে, স্নান করে মহাকালের অর্চনার কাজে সবে ব্যাপৃত হয়েছেন। তিনজন ব্রাহ্মণকে মহারাজ সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। আর তখনই সেই ব্রাহ্মণের বেশধারী আততায়ীগণ, কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন, জরাসন্ধকে হত্যা করলেন। ইঙ্গিতে বাহিরে অপেক্ষমান আরও যাদবসেনা দ্রুত প্রবেশ করল রাজগৃহে। রক্ষীরা কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই সংগঠিত হল জরাসন্ধবধ। ধর্মযুদ্ধ কেন, কোনও যুদ্ধই নয়, অক্ষত্রচিত খুনে আততায়ীদের নেতৃত্ব দিলেন স্বয়ং বাসুদেব কৃষ্ণ। জরাসন্ধ নিহত হলেন, ফলে তার অনুগামী রাজারাও হতদ্যম হয়ে গেলেন। রাজসূয় যজ্ঞ করবার জন্য যুধিষ্ঠিরের আর কোনও বাধা থাকল না। ভীষ্ম, বিদুরের ইচ্ছায় মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রও মত দিলেন। পাঞ্চাল ও বিরাটরাজও অনুমোদন করলেন। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যখন পাণ্ডবদের দিকে, তখন যাদবরাও রাজসূয় যজ্ঞে সানন্দে রাজি হলেন। যুধিষ্ঠির মহা উৎসাহে রাজসূয় যজ্ঞ আয়োজনে ব্রতী হলেন। হস্তিনাপুর থেকে সকলে এলেন ইন্দ্রপ্রস্থে, পাণ্ডবদের নবনির্মিত রাজধানীতে। যজ্ঞের নাম শুনে মুনি, ঋষি, ব্রাহ্মণেরা ভিড় জমাতে লাগলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। ইন্দ্রপ্রস্থে তখন চাঁদের হাট। রাজপ্রাসাদের যে মহার্ঘ এক অংশে সপরিবার দুর্যোধন অবস্থান করেন সেই হস্তিনাপুরে রাজগৃহটি প্রাচীন ও কাষ্ঠনির্মিত। আর ইন্দ্রপ্রস্তের এই রাজগৃহ নবনির্মিত, মর্মরাদি প্রস্তরদ্বারা প্রস্তুত। দক্ষিণদিকের একদল অনার্য শিল্পী, ময় নামক গোষ্ঠীপতির তত্বাবধানে এই সুবিশাল রাজগৃহটি নির্মাণ করেছে। রাজসূয় যজ্ঞ উপলক্ষে আরও অনেক অস্থায়ী গৃহ, কুটির ও শিবির স্থাপন করা হয়েছে। অতিথি রাজন্যগণের জন্য সুদৃশ্য মর্মরগৃহ, ব্রাহ্মণ্যগণের জন্য স্তরভেদে শিবির ও কুটির নির্মিত হয়েছে। কুরুজ্ঞাতিগণ অবশ্যই রাজপ্রাসাদেই অবস্থান করছেন। নিজকক্ষের সম্মুখে কৃষ্ণপ্রস্তরময় অলিন্দে দুর্যোধন পদচারণা করছেন। সে অলিন্দ অতি মসৃণ ও পিচ্ছিল। পিচ্ছিল অলিন্দে অভ্যস্থ হতে হয়, তাই দুর্যোধনের এই পদচারণা। তিনি অলিন্দের গাত্রে খোদিত অলঙ্করণের শিল্পসুষমা উপভোগ করছিলেন। সন্ধ্যায় দেবী ভানুমতীর সন্ধানে ওদিকেই আসছিলেন রাজ্ঞী যাজ্ঞসেনী। পথে দেখা হল দুর্যোধনের সাথে। মিষ্ট হাস্য করে দ্রৌপদী বললেন, “সকল কুশল তো আর্য সুযোধন?” ভানুমতীর কাছে এই সম্বোধনটি তিনি সংগ্রহ করেছেন। “হ্যাঁ দেবী!” দুর্যোধন মৃদু হাসলেন। তিনি দ্রৌপদীকে ভাল করে লক্ষ্য করলেন। স্বয়ম্বরের পর প্রায় চোদ্দ বছর কেটে গেছে। পাঞ্চালী এখন পূর্ণ যুবতী। ভানুমতী যদি নম্র দীপশিখা হন, তবে পাঞ্চালী প্রজ্বলিত মশাল। যেন দাউ দাউ করে জ্বলছেন। ভানুমতী তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা, পাঞ্চালী কৃষ্ণা। ভানুমতী কলিঙ্গের জল হাওয়ায় তৈরি পেলব পুত্তলি, আর যাজ্ঞসেনী আর্যাবর্তের জল হাওয়ায় নির্মিত ক্ষুরধার প্রতিমা। দুজনেই অলোকসামান্যা সুন্দরী, কিন্তু দু রকমের। দুর্যোধন প্রশ্ন করেন, “মহারাজ্ঞীর কি সংবাদ?” প্রশ্নটি নির্দোষ, কিন্তু পাঞ্চালীকে বিঁধল তীব্রভাবে, তার অন্তরে প্রায় প্রশমিত ক্ষতে রক্তক্ষরণ শুরু হল। তিনি হাস্যমুখে বললেন, “পাণ্ডবরমণী আমি, পাঁচ পাঁচজন পুরুষের অধীনা। তারাই আমার স্বামী। আমি সর্বদা নিজেকে তৃপ্ত বোধ করতে শিখে নিয়েছি, আর্য দুর্যোধন! সুখ কি বস্তু তা তো আমি জানি না! দুর্যোধন অনুভব করলেন পাঞ্চালীর ক্ষতটি। মনে মনে ভাবলেন কি যেন। দ্রৌপদী প্রসঙ্গ পাল্টালেন, “ভগ্নি ভানুমতী কত ভাগ্যবতী দেখুন, আমার ঈর্ষা হয়। তার আমার মতো অসংখ্য স্বপত্নি নেই, অন্তত অদ্যাবধি। নিজ স্বামীর উপর তার সম্পূর্ণ অধিকার!আর আমি? বাহিরের অসামান্য চাকচিক্য, অন্দরে এক দীন ভিখারিনী!” দ্রৌপদীর কথাটি বিদ্যুতের মত তার কানে পৌঁছল। তাকে অতর্কিতে আক্রমণ করে ধরাশায়ী করে দিল। তিনি কি মনে মনে পাঞ্চালীকে কামনা করেন না এখনও? যদি করেন, তবে তা কি ভানুমতীর প্রতি বিশ্বাসঘাত নয়? ভানুমতী কি বুঝতে পারেন তার এ দুর্বলতার কথা? তিনি যখন ভানুমতীকে শৃঙ্গার করেন, তখন কি তার নয়নপথে পাঞ্চালীর মূর্তি ভেসে ওঠে? “কি ভাবছেন আর্য?" দুর্যোধন বিহ্বল হয়ে গেছেন। অর্জুন বহুবিবাহ করেছেন, তা গোপনে নয়, প্রকাশ্যে। তার কথা কৃষ্ণা জানেন। কিন্তু তিনি যে মনে মনে পাঞ্চালীকে আজও কামনা করেন, তা তো ভানুমতী জানেন না। অর্জুন কৃষ্ণাকে জয় করেছিলেন, স্বীয় দক্ষতার পরাকাষ্ঠায়। তিনি সেদিন পারেন নি। তবুও তিনি অন্যায্যভাবে কৃষ্ণাতে আসক্ত! ভানুমতী কি বুঝতে পারেন? দ্রৌপদী তার দিকে অর্থপূর্ণ হাস্য করে ভানুমতীর কক্ষের দিকে চললেন। আকস্মিক পদচারনায় দুর্যোধনের পদস্খলন হল মসৃণ কৃষ্ণপ্রস্তরে। অপ্রস্তুত দুর্যোধনকে দেখে গমনরতা পাঞ্চালী হেসে উঠলেন তরুণীর প্রগলভতায়। আর্য দুর্যোধন আজ ধরা পড়ে গেছেন! নির্দিষ্ট দিনে রাজসূয় যজ্ঞ শুরু হল। নারদগোষ্ঠীর প্রধান যিনি, তিনি নারদ বলেই বিখ্যাত, তারই তত্বাবধানে যজ্ঞ হবে। ব্রতী যুধিষ্ঠিরকে প্রথমে একজন ব্যক্তিকে অর্ঘ্য দিয়ে বরণ করতে হবে। গোল বাধল, কাকে দেবেন তিনি সেই অর্ঘ্য? শাস্ত্রে আছে আচার্য, ঋত্বিক, সম্বন্ধি, স্নাতক, নৃপতি ও প্রিয়ব্যক্তি, এই ছয় প্রকার ব্যক্তি অর্ঘ্যের অধিকারী। সকলে মনে করেছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ গাঙ্গেয় ভীষ্ম এই অর্ঘ্য পাবেন। তিনি কুরুকুলপ্রদীপও, সকল নৃপতি ঋষিগণের মান্য। কিন্তু যুধিষ্ঠির বাসুদেব কৃষ্ণকে অর্ঘ্য দেবার মনঃস্থ করলেন। উপস্থিত রাজাদের অনেকেই তীব্র আপত্তি করলেন। তার মধ্যে ছিলে চেদীরাজ শিশুপাল। স্বয়ং ভীষ্ম কি মনে মনে আহত হয়েছিলেন? কৃষ্ণ যেমন নিজেকে বাসুদেব বলেন, তেমনই সুহ্মের রাজা এবং চেদীরাজও নিজেদের বাসুদেব বলে দাবী করেন। তার মধ্যে শিশুপাল আবার যাদব বংশোদ্ভূত। একে তো অর্ঘ্যের অধিকার, তায় আবার বাসুদেব পদ নিয়ে টানাটানি, কৃষ্ণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তদুপরি ভীষ্ম পরম বৈষ্ণবও বটে। সমগ্র আর্যাবর্তে বাসুদেব পদটি রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অর্ঘ্যদান সেই প্রশ্নে শিলমোহর দেবে, এই ছিল কৃষ্ণের পরিকল্পনা। চেদীরাজ তাকে বাদ সাধলেন। কৃষ্ণ যারপরনাই কুপিত হলেন। অতর্কিতে যাদব যোদ্ধাদের সাহায্যে যজ্ঞস্থলেই শিশুপালকে হত্যা করলেন। শিশুপাল যুধিষ্ঠিরের আমন্ত্রিত আতিথি। তারই আয়োজিত যজ্ঞে তিনি এসেছিলেন সৈন্যবাহিনী ছাড়াই। সেখানে কৃষ্ণ তাকে হত্যা করলেন নৃশংসভাবে। ক্ষমতা ও পদের মোহ বৈষ্ণবহৃদয়সম্রাট কৃষ্ণকে এই পথে ঠেলে দিল! যুধিষ্ঠির প্রতিবাদ করলেন না, বিষ্ণুভক্ত নারদগণ প্রতিবাদ করলেন না, যাদবদের তরবারির ভয়ে সকলেই মৌন থাকলেন। ভীষ্ম তাড়াতাড়ি যুধিষ্ঠিরকে অনুজ্ঞা করলেন কৃষ্ণকে অর্ঘ্য দেবার জন্য। যজ্ঞবেদীতে রক্তের দাগ লেগে রইল। কৃষ্ণের বাসুদেবত্বের প্রতিস্পর্ধা করার কেউ রইল না। পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন হল। শুধু ঋষি ব্যাসদেব দুর্লক্ষণ আশঙ্কা করলেন। কুরুগণ ফিরে চললেন হস্তিনাপুরে। বিমর্ষ ভীষ্ম, মৌন বিদুর। শুধু দুর্যোধন বারবার ভানুমতীর দিকে তাকাচ্ছেন। ভানুমতী তার প্রতি স্মিত হাস্য করছেন। লক্ষ্মণ ও লক্ষ্মণাকে সামলাচ্ছেন। আর্য সুযোধনের কি হল? দুর্যোধন ভেবেই চলেছেন, পাঞ্চালী কি ভানুমতীকে বলে দিয়েছেন সব কথা?
গান্ধাররাজ সুবলকে ভীষ্ম বন্দী করে রেখেছিলেন তার সন্তানসহ আমৃত্যু। অজুহাত ছিল, তিনি নাকি গান্ধারীর ভ্রান্ত কোষ্ঠী দিয়ে প্রতারণা করেছেন। আসলে প্রতারণা করেছিলেন স্বয়ং গাঙ্গেয়, ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্ব গান্ধাররাজের নিকট লুকিয়েছিলেন। সেই কারাপাশ থেকে একজনই জীবিত ফিরে এসেছিলেন, তিনি সুবলনন্দন শকুনি। বুদ্ধিমান শকুনির একমাত্র লক্ষ্য, প্রতিশোধ। ভাগিনেয় দুর্যোধন তার বড় প্রিয়পাত্র। দুর্যোধন যুবরাজ, তাই ভীষ্ম সৌবলকে কিছু করতে পারেন না। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে শকুনির প্রতি। শৈশব হতেই শকুনি দুর্যোধন ও তার ভ্রাতাদের গাঙ্গেয় ভীষ্মের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তুলেছেন বহু আয়াসে। তা ছাড়া শকুনি মনে মনে ঘৃণা করেন আর একজনকে, তিনি বিদুর। বিদুর ক্ষত্ত, বুদ্ধিমান। কিন্তু তিনি গোপনে পাণ্ডবদের পক্ষে, তিনি সতত যুবরাজ দুর্যোধনের অমঙ্গল কামনা করেন। হস্তিনাপুরের মহামন্ত্রী হবার সুবাদে তার হাতে ক্ষমতাও কম নয়, রাজকোষ তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। দুর্যোধনের অন্তঃপুরে একটি গোপন সভা বসেছে। সেখানে উপস্থিত আছেন অঙ্গরাজ কর্ণ, দুঃশাসন, শকুনি এবং স্বয়ং যুবরাজ দুর্যোধন। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ সকলকে খুবই চিন্তান্বিত করেছে। দুর্যোধন প্রশ্ন করলেন, “মাতুল! এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কি?” কর্ণ, দুঃশাসন নিরুত্তর। নীরবতা ভাঙলেন শকুনি। “যুদ্ধ অসম্ভব! তার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি আবশ্যক। বিশেষ কূটনৈতিক পরিকল্পনাও করাও দরকার। এখন সে সময় নয়। আমি চিন্তা করে একটা উপায় স্থির করেছি!” “কি উপায়, মাতুল?” “অক্ষক্রীড়া! যুধিষ্ঠির অত্যন্ত অক্ষাসক্ত, কিন্তু তার অক্ষক্রীড়ায় তার দক্ষতা নেই। যুধিষ্ঠিরসহ সকল পাণ্ডবদের অক্ষক্রীড়ায় আহ্বান করা হোক!” “কিন্তু যুধিষ্ঠির যদি সে আমন্ত্রণ গ্রহন না করেন?” কর্ণ এবার প্রশ্ন করলেন।“ “কোনও নৃপতি যদি যুদ্ধে, মৃগয়ায় ও অক্ষক্রীড়ায় প্রতিস্পর্ধার সম্মুখীন হন, তা হলে তাকে সেই প্রতিস্পর্ধা স্বীকার করতেই হবে। এটাই আর্য নরপতিগণের পালনীয় নিয়ম, বসুষেন!” “কৌরবপক্ষে কে অক্ষক্রীড়া করবেন, মাতুল?” দুঃশাসন প্রশ্ন করলেন। “অবশ্যই আমি দুঃশাসন। তুমি জ্ঞাত আছ যে, অক্ষক্রীড়ায় আমার দক্ষতা সুবিদিত!” সভায় আসীন আছেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, গাঙ্গেয় দেবদত্ত, মহামন্ত্রী বিদুর, গুরু দ্রোণাচার্য, কৃপ আদি সকলেই। যুবরাজ দুর্যোধন পাণ্ডবদের সাথে অক্ষক্রীড়ার প্রস্তাব দিলেন। যথারীতি ভীষ্ম ও বিদুর আপত্তি জানালেন। অনেক বাদানুবাদের পর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মন্ত্রী বিদুরকে আদেশ দিলেন সপরিবার পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে আসার জন্য। পাণ্ডবেরা সকলেই হস্তিনাপুরে এলেন। এ সংবাদ যখন কৃষ্ণ শুনলেন, তখন তিনি দ্বারকা অভিমুখে যাত্রা করছেন। মূর্খ যুধিষ্ঠির তাকে জ্ঞাপন করার প্রয়োজনও বোধ করলেন না। বাসুদেব কৃষ্ণ সর্বনাশের কৃষ্ণমেঘ দেখলেন। রথের মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত হস্তিনাপুরের দিকে যাত্রা করলেন। রাজসভার পাশা খেলতে বসলেন যুধিষ্ঠির আর শকুনি। তাদের ঘিরে রয়েছেন পাণ্ডব ও কৌরবগণ। নারীরা অন্দরে। প্রিয়জনের সাথে বাক্যালাপে মত্ত। অক্ষক্রীড়া হচ্ছে পণ রেখে। প্রথমে যুধিষ্ঠির তার সমস্ত ধন রত্ন হারলেন। তারপর সকল ভাইদের। যুধিষ্ঠির পরাজিত হয়ে ক্রমশ বোধবুদ্ধিহীন হয়ে যাচ্ছেন। তিনি এইবার পণ রাখলেন তার ভাইদের। পণের শর্ত অনুযায়ী পাণ্ডব ভ্রাতাগণ দুর্যোধনের দাস হলেন। এবার কথা বললেন দুর্যোধন, “পাঞ্চালীকে পণ রাখুন ভ্রাতা যুধিষ্ঠির!” চিত্রাঙ্গদা, সুভদ্রা নয়, পাঞ্চালী দ্রৌপদী? যদি দ্রৌপদী পাণ্ডবদের রাণী হন, তাহলে তারাও তো পাণ্ডবদের রানী। যুধিষ্ঠির স্থিরনিশ্চয় না দেখে দুর্যোধন আবার বললেন, “আপনারা ইতোপূর্বেই আমার অধীন হয়েছেন, দাস। দাসের কোনও স্বাধীন চিন্তা থাকতে পারে না, যুধিষ্ঠির!” যুধিষ্ঠির নতমুখে কৃষ্ণাকে পণ রাখলেন। শকুনির পাশা এবারেও জিতে গেলো। স্তব্ধ রাজসভা। এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটে নি, বিশেষত কুরুবংশে। কেঁপে উঠলেন ধৃতরাষ্ট্র। দুর্যোধন বললেন, “প্রাতিকামিন! দ্রৌপদীকে সভায় আনয়ন কর!” অক্ষক্রীড়ার ফলাফল শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন কুরুমহিষী গান্ধারী, পাণ্ডবমাতা কুন্তী এবং অন্যান্য সকলে। পাঞ্চালী রজস্বলা ছিলে বলে একবস্ত্রা হয়ে পৃথক কক্ষে অবস্থান করছিলেন। প্রাতিকামী এসে তাকে দুর্যোধনের আদেশ নিবেদন করল। দ্রৌপদী তাকে ফেরত পাঠালেন জেনে আসতে, যে তিনি যুধিষ্ঠির বিজিত হবার পূর্বে বিজিত হয়েছেন কি না! প্রাতিকামী সে কথা সভায় নিবেদন করলে দুর্যোধন প্রাতিকামীকে আদেশ দিলেন, দ্রৌপদীকে বলপূর্বক সভায় নিয়ে আসতে। প্রাতিকামী মাথা নিচু করে সে আদেশ অগ্রাহ্য করল। ক্ষিপ্ত দুর্যোধন তখন দুঃশাসনকে পাঠালেন দ্রৌপদী বলপূর্বক নিয়ে আসার জন্য। দুঃশাসন দ্রৌপদিকে সভায় আনলেন অর্ধনগ্ন অবস্থায়, তার কেশ আকর্ষণ করে। একমাত্র বৃকোদর ব্যতীত সকলে নীরব রইল। ক্রন্দনরতা পাঞ্চালী কুরুবৃদ্ধ গাঙ্গেয় ভীষ্মকে প্রশ্ন করলেন, “বলুন তাত ধর্ম কি? বিজিত দাস কখনও তার স্ত্রীকে পণ রাখতে পারে?” “ভীষ্ম বললেন, “ধর্মের গতি অতি সূক্ষ্ম পাঞ্চালী। তোমার স্বামী যুধিষ্ঠির বিজিত হয়ে এক্ষণে দাস মাত্র। তার আর কোনও সম্পদে অধিকার নেই, এটি নিশ্চিত। কিন্তু সে তোমার স্বামী, সেই কারণে তার তোমাকে পণ রাখা অধর্ম নয়!” ক্রোধে আরক্ত ভীমসেন সভায় দণ্ডায়মান হলেন। যুধিষ্ঠিরের বাহু আকর্ষণ করে সহদেবকে বললেন, “সহদেব! ত্বরায় অগ্নি আনো। যে হাত দিয়ে যুধিষ্ঠির অক্ষক্রীড়া করেছেন, তাকে আমি অগ্নিসমর্পণ করবো!” অর্জুন কোনওমতে তাকে নিবৃত্ত করলেন। তখনও বিবস্ত্রা পাঞ্চালী কেঁদে চলেছেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপ নিরুত্তর। শুধু বালক বিকর্ণ প্রতিবাদ করলেন। তখনই সভায় ঝড়ের বেগে প্রবেশ করলেন কৃষ্ণ। তড়িৎগতিতে নিজের উত্তরীয় দিয়ে দ্রৌপদীকে আবৃত করলেন। তারপর ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সভাস্থ সকলের দিকে তাকালেন, “ধিক্কার সকলকে! আপনারা শুধু কুরুবংশের মুখে কালিমা লেপন করেন নি, আপনারা আর্যাবর্তের সমস্ত ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণকে কলঙ্কিত করেছেন। শ্রবন করুণ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, কৃষ্ণাকে এই অসম্মানের পাপে কুরুবংশ নির্বংশ হবে!” রুষ্ট মাধব আরও কথা বলার আগেই ভীমসেন বলে উঠলেন, “শুনুন উপস্থিত সকলে, আমি পাণ্ডুতনয় ভীমসেন আমার পিতৃপুরুষকে স্মরণ করে প্রতিজ্ঞা করছি, যে দুঃশাসন প্রকাশ্য সভামধ্যে পাঞ্চালীকে বক্ষলগ্না করতে চেয়েছে, আমি যুদ্ধে তার বক্ষ বিদীর্ণ করবো। সে পাঞ্চালীর কেশ আকর্ষণ করেছিল, আমি তার বিদীর্ণ বক্ষের রুধিরে পাঞ্চালীর কেশ ধৌত করবো! আর দুর্যোধন, যুবরাজ দুর্যোধন! ক্ষমতার মদগর্বে গর্বিত হতে সে পাঞ্চালীকে তার জানুতে বসার কুৎসিত আহ্বান করেছিল। আমি তার ঊরুদেশ এমনভাবে বিদীর্ণ করবো, যে সে যেন আর দুপায়ে হেঁটে চলতে না পারে। আর যদি আমি এই প্রতিজ্ঞা থেকে ভ্রষ্ট হই, যেন মৃত্যুর পরে আমার অগ্নিসৎকার না হয়, যেন পিতৃলোকে আমার স্থান না হয়!” এমনসময় রাজ্ঞী গান্ধারী এলেন। তার দৃষ্টিতে অগ্নির উত্তাপ। তিনি শুধু মহারাজকে বললেন, “ধিক মহারাজ! আমি কুরুমহিষী গান্ধারী। আমি কুরুকূলবধু পাঞ্চালীকে মুক্ত করছি। শুধু পাঞ্চালীকে নয়, আমি পাণ্ডবদেরও মুক্ত করছি। আপনারা অবগত হন!” এইবলে দেবী ভানুমতী পাঞ্চালীকে ধরে প্রাসাদ অন্দরে নিয়ে গেলেন। বিক্ষুব্ধ বাসুদেব হস্তিনাপুরের সভা ত্যাগ করলেন। তখন সন্ধ্যা। পাঞ্চালীর অপমানে ম্লান দিনমনি অস্তাচলে গেলেন। একা গবাক্ষের পাশে বসে রয়েছেন ভানুমতী, তার চোখের দৃষ্টি উদাস! বেদনাবিদ্ধ। দুর্যোধন এলেন সে কক্ষে। কক্ষে তখন দীপ জ্বলে নি। নিশ্চুপ দুর্যোধন। অনেকক্ষণ পড়ে মুখ খুললেন দেবী ভানুমতী। “পাঞ্চালীর উপর আপনার এতো ক্রোধ কেন, আর্য সুযোধন? প্রেমে প্রত্যাখ্যাত বলে?দ্রৌপদীর প্রতি আপনার এই ব্যবহার কুরুকূলচিত তো নয়ই, ক্ষত্রিয় কুলোচিত নয়। তবে কি সত্যই আপনি দুর্যোধন, আমার প্রিয় আর্য সুযোধন নন আপনি এতদিন তবে আমার সাথে ছলনা করেছেন!” দুর্যোধন কক্ষ থেকে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হন। দেবী ভানুমতী তাকে ধরে ফেলেছেন। এক্ষণে মদিরায় ডুবে যেতে চান তিনি।!
ভানুমতী বড় বিষণ্ণ। রুষ্টও বটে। সখা কর্ণ ও আর্য দুর্যোধন চলেছেন পাঞ্চালরাজের দুহিতার স্বয়ম্বরসভায়। ক্ষত্রিয় পুরুষদের এই বহুবিবাহের ধারণা যে কত ভ্রান্ত, তা কে শোনে। পশুপালক আর্যগণ যখন এ দেশে আসেন, তখন তাদের সাথে রমণী থাকতেন না। প্রাকৃতিক কারণেই তারা এ দেশীয় নারীদের বিবাহ করতেন। তারপর দ্রুত নিজেদের গোষ্ঠীর বিস্তারে তারা একাধিক দার পরিগ্রহ করতেন। কিন্তু তো অনেক কাল পূর্বের কথা! আসলে আর্যরা তাদের জীবনে নারীর কোনও মুল্য দেন না। এমনকি বিষ্ণুর অবতার বলে যিনি নিজেকে প্রচার করেন, সেই বাসুদেব কৃষ্ণও নন। ইতিমধ্যেই আটটি নারীকে স্ত্রীরূপে গ্রহন করেছেন। বসুষেন ইতিমধ্যেই দু দুটি বিবাহ করেছেন। তার মধ্যে একজন তার প্রিয়সখী সুপ্রিয়া। তিনিও চলেছেন পাঞ্চালে। তার বহু অবিবাহিত দেবর আছেন, কই তাদের তো পাঠাতে পারতেন আর্য দুর্যোধন। ভানুমতী শুনেছেন বহু নৃপ, যারা পাঞ্চালীর পিতা বা পিতামহসম, তারাও এই স্বয়ম্বরে লালায়িত হয়ে পাঞ্চালে ধাবিত হচ্ছেন। আর্য দুর্যোধন তো নিজেকে এই সকলদের থেকে পৃথক দাবী করেন। তিনিও লোভের বশবর্তী হয়ে পাঞ্চালদেশে গমন করবেন বলে স্থির করেছে। এই ক্ষত্রিয়গন এত অমানবিক কেন? ভানুমতী দীর্ঘশ্বাস মোচন করেন। শ্বশ্রূমাতা গান্ধারীর নিকট ভানুমতী দ্রুপদনন্দিনীর জন্মবৃতান্ত শুনেছেন। মহারাজ দ্রুপদের ঔরসে এক সন্তানের জন্ম হয়, কিন্তু সন্তানটি নপুংসক হওয়ার কারণে পাঞ্চাল সিংহাসনের উত্তরাধিকারী অনিশ্চিত হয়ে যায়। রাজা দ্রুপদ বিশেষভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তারপর ঋষিদের অনুরোধে নিয়োগ প্রথা আশ্রয় নেন। এই কার্যে যাজ ও উপযাজ নামে দুই ব্রাহ্মণ মহারানীতে উপগত হন। সেই নিযুক্তিতে দ্রুপদের দুই সন্তানের জন্ম হয়। অবশ্যা প্রজাদের বিভ্রান্ত করার জন্য যাগযজ্ঞের আয়োজন করেন রাজা দ্রুপদ। যথাকালে সেই সন্তানেরা রাজকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন ও কৃষ্ণা বলে পরিচিত হন। কৃষ্ণা নীলকেশী, পলাশলোচনা, পীনন্নত পয়োধরা, অসামান্য সুন্দরী। দ্রোণের কাছে পরাজিত হবার কারণে দ্রুপদের মনে প্রতিশোধের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছিল। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তার সন্তান এর প্রতিশোধ নেবে। তাতেও নিশ্চিত না হয়ে তিনি দ্রৌপদীর সাথে সর্বশ্রেষ্ঠ ধানুকী অর্জুনের বিবাহ স্থির করলেন। কিন্তু একটি বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে। স্বয়ম্বরমন্ডপের শীর্ষে দুটি ঘূর্ণায়মান চক্র। পরস্পর বিপরীত দিকে ঘুরছে। সকল রাজা যখন লক্ষ্যবিদ্ধ করার জন্য বাহ্যাড়ম্বর করছেন, তখন অর্জুন একান্তচিত্তে সেই চক্রদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। দুটি চক্র ভিন্ন গতিতে ঘুরছে। তার উপড়ে মৎস্যের চোখ। একটি বিশেষ মুহূর্তে চক্রদ্বয়ের অক্ষগুলি এক জায়গার আসে। তারপরই আবার একে অপরকে রুদ্ধ করে। আর ধনুকটিও বিশেষ। যুদ্ধে এ ধনুক ব্যবহার হয় না। এ ধনুক তিনি দেখেছেন শবরদের নিকট। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে শরসন্ধান করা যায়। বনে বৃক্ষাম্ভন্তরে ধাবমান হরিণাদি পশুকে তিরবিদ্ধ করা বেশ কঠিন। ছিলার আকর্ষণ অধিক হবে না, অথচ শর নিক্ষিপ্ত হবে দ্রুতগতিতে। অর্জুন মনে মনে তুষ্ট হলেন। কোনও রাজাই লক্ষ্যবিদ্ধ করতে পারলেন না। কর্ণও না। কৃষ্ণ এসেছেন পুত্র শাম্বের সাথে। তারা দুজনেই দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর প্রার্থী। অর্জুন কৌতুক অনুভব করলেন। অবশেষে সকল ক্ষত্রিয়গণ ক্ষান্ত দিলে ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন লক্ষ্যবিদ্ধ করলেন। দ্রুপদ মনে মনে অত্যন্ত পুলকিত হলেন। ক্ষত্রিয় রাজারা গোল বাধালেন। যুদ্ধের উপক্রম হতে কৃষ্ণ মধ্যস্থতা করলে সকলকে শান্ত করলেন। ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্নের সাথে যাজ্ঞসেনী গজেন্দ্রগমনে সভায় এলেন। অর্জুনের সাথে তার শুভদৃষ্টি হল। তিনি অর্জুনের গোলার বরমালা দিলেন। অর্জুন কৃষ্ণাকে বিবাহতো করলেন, কিন্তু কুন্তী লক্ষ্য করলেন ভাতৃবধুর প্রতি যুধিষ্ঠিরের কামনার দৃষ্টি। অন্য ভ্রাতাদের এমন মনে হতে পারে এই আশঙ্কায় কুন্তী ওপর চার ভ্রাতাকেও যাজ্ঞসেনীর পতিরূপে বরণ করলেন। একদা লাঞ্ছিতা, বহুভোগ্যা কুন্তীর মনে কি বিজাতীয় ঘৃণা জন্মেছিল ক্ষত্রিয় পুরুষদের প্রতি। আর নারীদের প্রতি হিংসা? আর ভানুমতী সমস্ত বিবরণ শুনলেন। কৃষ্ণার দুঃখে তিনি কাঁদলেন। আর তার ভর্তা যুযোধন? তার প্রতি ভানুমতীর যে শ্রদ্ধা ছিল, তা অবশ হয়ে গেলো।
অক্ষক্রীড়ায় পরাজিত পাণ্ডবেরা সর্বস্ব হারিয়ে বনে গেলেন। ইন্দ্রপ্রস্থের রাজকীয় সুখ বঞ্চিত হলেন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের দ্যূতাসক্তির কারণে, দুবার। প্রথমে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা আর দ্বিতীয়বারে ধনহীন, রাজ্যহীন হয়ে পথের ভিখারি হলেন পাণ্ডবগণ। এবার মাতা কুন্তী রইলেন বিদুরের আশ্রয়ে। পাঞ্চালীসহ পঞ্চপাণ্ডব ঘুরে বেড়ান বন থেকে বনান্তরে। অনার্য জাতিগুলির সাথে তাদের সখ্য হয়। তারা সকলেই পাণ্ডবদের প্রীতির চক্ষে দেখেন। তাদের সাথে প্রচ্ছন্নভাবে যোগাযোগ রাখেন যাদবেরা, বিশেষ করে কৃষ্ণ। এইভাবে প্রায় বারো বছর কেটে যায়। এবার এক বছর অজ্ঞাতবাসের পালা। পাণ্ডবেরা তখন মৎস্যরাজ্যের উপান্তে। তারা পরিকল্পনা করলেন, মৎস্যরাজ্যে ছদ্মবেশে অবস্থান করবেন একবছর। কুরু ও মৎস্য, এই দুই রাজ্যের মধ্যে বৈরিভাব ছিলই, বিশেষত গোসম্পদে মৎস্যরাজ্য অধিক সমৃদ্ধ ছিল। মৎস্যরাজ বিরাটের আরেকটি শক্তির কারণ ছিল তার সেনাদল এবং তার সেনাপতি কীচক। সেনাপতি কীচককে সর্বদা ঘিরে থাকতো তার বিশেষ রক্ষীদল। সংখ্যায় তারা একশত পাঁচ জন। লোকে তাদের সম্ভ্রম করে বলত উপকীচক। ছদ্মবেশের সাথে পাণ্ডবেরা নিলেন ছদ্মনাম ও ছদ্মপেশা। এত দুর্ভাগ্যেও যুধিষ্ঠির অক্ষকে ছাড়তে পারেন নি। তিনি হলেন মৎস্যরাজ বিরাটের অক্ষক্রীড়াসঙ্গী কঙ্ক। বৃকোদর হলেন রাজার পাকশালার পাচক বল্লব। নকুল ভার নিলেন গো রক্ষণাবেক্ষণে, নাম তার অরিষ্টনেমি। সহদেব হলেন অশ্বশালার প্রধান অশ্বপাল, তিনি নাম গ্রহণ করলেন গ্রন্থিক। অর্জুন আগেই নৃত্যে পারঙ্গম ছিলেন। তারপর গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন তাকে আরও পাঠ দিয়েছেন। অর্জুন এখন একজন নৃত্যবিশারদ। রাজবাড়িতে নৃত্য শিখবেন রাজকন্যা কিশোরী উত্তরা। রাজ অন্তঃপুরে পুরুষ শিল্পীর প্রবেশ অসম্ভব। তাই অর্জুন নারীর রূপ ধরলেন আর নাম নিলেন বৃহন্নলা। আর দ্রৌপদী? অরণ্যবাসে তিনি কৃশ, মেদহীনা, কৃষ্ণা হলেও রূপ তার অগ্নির প্রায়। তিনি পরিচারিকা হলেন রাজবাড়ীর। তাকে সকলে সৈরিন্ধ্রী নামেই ডাকে। এইপ্রকার রূপবতী পরিচারিকা সকলের অভিপ্রেত। তার দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে তাজিয়ে থাকেন কীচক। মহাশক্তিশালী কীচক। বিশেষকরে সায়ংকালে সুরাপানের সময়। সৈরিন্ধ্রী প্রয়াস করেন কীচককে প্রতিহত করবার। কত ছলনা করেন, কিন্তু সকলই ব্যর্থ হয়ে যায়। অগত্যা! ভীমের শরীরে নাগরক্ত প্রবহমান। নারীকে শুধু যৌনদাসী ভাবেন না অনার্যেরা, তাদের কাছে নারী সম্পদ নয়, পণ্য নয়, নারী তাদের কাছে শ্রদ্ধার আসনে আসীন। পাঞ্চালী তার দুর্দশার কথা বললেন বল্লবকে। বল্লবের নাগরক্ত উদ্বেলিত হল। পরিকল্পনা করলেন সৈরিন্ধ্রী। রাজকীয় সুরাশালালায় সৈরিন্ধ্রী আমন্ত্রণ করলেন একাকী কীচককে। গোপনে সেখানে উপস্থিত ছিলেন ভীম। প্রবল দুই যোদ্ধার মল্লযুদ্ধ হল সেই নির্জন মদিরালয়ে। মত্ত কীচক ভীমের হাতে নিহত হলেন। ছিন্নকন্ঠ মৃত কীচকের হাতে তখনও ধরা ছিল সৈরিন্ধ্রীর হাত। বল্লব নিশব্দে পলায়ন করলেন। সৈরিন্ধ্রী জানালেন অদৃশ্য যক্ষেরা মহামান্য কীচককে হত্যা করেছেন। রাজগৃহে হাহাকার। শোক করলেন বিরাট, রাজ্ঞী সুদেষ্ণা। কঙ্ক আর অন্য সকলে। মৃত্যুর সময়ে সৈরিন্ধ্রীর হাত ধরেছিলেন কীচক, তাই উপকীচকেরা দাবী করল, মহাবাহু কীচকের সাথে সহমরণ হবে সৈরিন্ধ্রীর। বাধা দেবার প্রশ্নই ওঠে না। সৈরিন্ধ্রী চললেন কীচকের সাথে সহমরণে। অতি গোপনে ভীমসেন তাদের পিছু নিলেন। জনমাননশুন্য ভয়াল শ্মশান। অন্ধকার রাতে চারিদিকে শুধু শাপদের তীক্ষ্ণ চিৎকার। মহাবলী ভীম অতর্কিতে আক্রমণ করলেন সেই শোকগ্রস্ত আকন্ঠ মদ্যপ একশত পাঁচজন উপকীচককে। তারা সকলেই নিহত হল। বল্লভ সৈরিন্ধ্রীকে উদ্ধার করে ফিরে এলেন রাজনিবাসে। কীচকের মৃত্যু সংবাদ ক্রমে পৌঁছল হস্তিনাপুরে। দুর্যোধনের কানেও উঠল সেই সংবাদ। সংবাদ পেলেন ত্রিগর্তের রাজা সুশর্ম্মাও। দুর্যোধন দূত পাঠিয়ে আমন্ত্রণ করলেন তাকে। কৌরবদের লোভ ছিল মৎস্যরাজ্যের ঈর্ষনীয় গোসম্পদের প্রতি। ত্রিগর্তরাজের সাথে পরামর্শ হল, তিনি অতর্কিতে মৎস্যরাজ্য আক্রমণ করবেন। সহজেই বিরাট পরাজিত হবেন, কারণ, কোনও এক রহস্যময় গন্ধর্বের হাতে মৎস্য সেনাপতি কীচক নিহত হয়েছেন। এক্ষণে বিরাট নিতান্ত হীনবল। সুশর্মা গো অপহরণ করবার পশ্চাতে কৌরবগণ তা গ্রহণ করবেন। অতীতে ত্রিগর্তরাজ একবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কীচকের কাছে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। তার প্রতিশোধ নেবার সময় এসেছে। সুশর্ম্মা মৎস্যরাজ্য আক্রমণ করলেন। অতর্কিত আক্রমণে বিরাটের সৈন্যরা পশ্চাদপসরণ করল। বিশাল গোসম্পদ অধিকার করে যখন তার সৈন্যরা ফিরে যাবেন, তখন পাণ্ডবেরা হস্তক্ষেপ করলেন। বিরাটের তরুণ পুত্র উত্তর হলেন নূতন সেনাপতি। যুদ্ধের শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা তার নেই। রাজঅন্তঃপুরের দাসী সৈরিন্ধ্রী বললেন, বৃহন্নলাকে সারথ্যে বরণ করে নিতে। সৈরিন্ধ্রীর প্রস্তাবে রাজকুমার উত্তর অবাক হলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৃহন্নলাকে সারথিও করলেন। বৃহন্নলারূপী অর্জুন সহজেই সুশর্ম্মাকে পর্যদুস্ত করলেন। এবার সরাসরি যুদ্ধে নামলেন ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, কর্ণসহ দুর্যোধন। বিশাল তাদের সেনাবাহিনী। অর্জুনের প্রতাপে একে একে সকলেই পলায়ন করলেন। তারমধ্যে কবচকুন্ডলসহ কর্ণ দু দুবার অর্জুনের নিকট পরাভূত হয়ে পালিয়ে বাঁচলেন। সমস্ত গো সম্পদ পুনরায় গ্রহণ করে অর্জুন ফিরে এলেন মৎস্যরাজ বিরাটের সম্মুখে। যখন যুদ্ধ চলছে, তখন উদ্বেগে বিরাট তার সোনার অক্ষ ছুঁড়ে মেরেছিলেন কঙ্কের কপালে। কঙ্কের কপাল বাহিত হয়ে রক্তের ধারা তার বক্ষ স্পর্শ করল। সেই ক্ষতচিহ্ন ললাটে নিয়ে তারপর কঙ্ক আর কোনোদিন পাশা খেলেন নি। গননা করে দেখা গেলো পাণ্ডবদের এক বছরের অজ্ঞাতবাস সমাপ্ত হয়েছে। সকলে আত্মপ্রকাশ করলেন। মৎস্যরাজ বিরাট স্বীয় কন্যা উত্তরাকে অর্জুনের হাতে দিতে চাইলেন। অর্জুন বললেন, “মহারাজ! রাজ অন্তঃপুরে দেবী সুদেষ্ণা আমাকে বিশ্বাস করে কল্যানীয়া উত্তরার নৃত্যশিক্ষার ভার ন্যস্ত করেছিলেন। আর আমি আপন পুত্রীস্নেহে রাজনন্দিনী উত্তরাকে শিক্ষা দান করেছি। এই অবস্থায় উত্তরার পাণিগ্রহণ আমার পক্ষে একান্ত অসমীচীন হবে। তবে আমার একটি প্রস্তাব মহারাজ বিবেচনা করে দেখতা পারেন। আমি পুত্র অভিমন্যুর সাথে উত্তরার বিবাহ দিতে ইচ্ছুক!” বিরাট আনন্দে আপ্লুত হলেন। দ্বারকায় সংবাদ গেলো। তার কিছুদিন পরে অভিমন্যু আর উত্তরা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন। হস্তিনাপুরের আকাশে এক টুকরো কালো মেঘের ছায়া ঘনিয়েছে। সর্বাপেক্ষা চিন্তিত যুবরাজ দুর্যোধন। ভীষ্ম, বিদূর, ধৃতরাষ্ট্র সকলেই চিন্তিত। কিন্তু তাদের চিন্তা ভিন্ন ভিন্ন। অভিমন্যুর বিবাহের পর আর্যাবর্তের প্রধান রাজ্যগুলি এখন পাণ্ডবদের মিত্র। পাঞ্চাল, মৎস্য তো তাদের সহযোগী। যাদবরাও তাদের বিরুদ্ধে তো নয়ই বরং পাণ্ডবদের প্রতি একটু অধিক বন্ধুভাবাপন্ন। সুরালয়ে উপবেশিত আছেন দুর্যোধন। তার কপালে চিন্তার ছায়া। মদিরাপাত্র অধরা। প্রদীপের শিখা কম্পমান। বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাস শেষে পাণ্ডবেরা এখন অধিক শক্তিমান। তারা এখন অর্ধেক কুরুরাজ্য দাবী করবেন, আর তাদের এ দাবী ন্যায়সঙ্গত। এই অভিমত মহামন্ত্রী বিদূরের। তিনি শান্তিতে রাজ্যভাগের পক্ষে। কুরুরাজ্যে দ্বিধাবভক্ত হলেও, কৌরব ও পাণ্ডবেরা উভয়েই ভ্রাতা। অতীতের সমস্ত তিক্ততা ভুলে উভয়েই শান্তিতে রাজত্ব করুন। তাতে কুরুবংশের মঙ্গল। বিদূরের মনে আর একটি সুপ্ত বাসনা, তার ঔরসজাত পুত্র যুধিষ্ঠির অন্তত সিংহাসনে বসুক। নীরবে শুনছিলেন রাজা ধৃতরাষ্ট্র। মুখ খুললেন তাত ভীষ্ম। “বিষয়টি যত সরল মনে করছ, ততটা সরল বোধ হয় নয়। পুত্র ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠভ্রাতা হয়েও শুধু অন্ধ বলে সিংহাসন বসতে পারেন নি। পাণ্ডু রাজ সিংহাসনে বসেছিলেন। তার মৃত্যুর পর ধৃতরাষ্ট্র রাজা হয়েছেন। তার পুত্র যুধিষ্ঠির হবেন কি বর্তমান রাজার পুত্র দুর্যোধন রাজা হবেন, এ প্রশ্নের নিষ্পত্তি কিন্তু এখনও হয় নি। দ্বিতীয়ত আমি মনে করি কুরুরাজ্যের বিভাজন হলে, যতই দুই রাজ্যের মধ্যে সৌহার্দ্য থাকুক না কেন, শেষ পর্যন্ত হস্তিনাপুর দুর্বল হবেই। দুপক্ষই একে অপরের কারণে সর্বদা চিন্তিত থাকবে। আর তাছাড়া মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র প্রাজ্ঞ রাজা, তিনি আমাদের কথা মান্য করেন। কিন্তু দুর্যোধন রাজা হলে, সে আমাদের কথা মান্য নাও করতে পারে। তাছাড়া আর্যাবর্তের রাজনৈতিক অবস্থাও যথেষ্ট সঙ্কুল। বেদবাদী ও বৈষ্ণবদের মধ্যে বিরোধ এখন প্রকাশ্যে আসে নি বটে, তবে তা বিরোধের আকার নিতে শুধু সময়ের অপেক্ষা!” “দুর্যোধন ও যুধিষ্ঠিরের মধ্যে সংঘাত হলে আপনি কোন পক্ষ নেবেন, তাত?” মুখ খুললেন রাজা ধৃতরাষ্ট্র। প্রশ্নের আকস্মিকতায় একটু থমকে গেলেন গাঙ্গেয় ভীষ্ম। তিনি কোন পক্ষে যাবেন? সত্যিই তো কোনোদিন এই প্রশ্নটার মুখোমুখি হন নি তিনি। যখনি সমস্যা সামনে এসেছে, তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন। ভীষ্ম নীরব রইলেন। একই প্রশ্ন বিদূরকে করলেন ধৃতরাষ্ট্র, “আপনি ভ্রাতা বিদূর?” বিদূর চমকে উঠলেন। তিনি কোনপক্ষে যাবেন? পুত্র যুধিষ্ঠিরের পক্ষে না কি দুর্যোধনের পক্ষে? তিনি ভাবলেন। তারপর বললেন, “মহারাজ, আমি হস্তিনাপুরের মহামন্ত্রী। আমি হস্তিনাপুরের সিংহাসনের প্রতি দায়বদ্ধ। আর আপনি এখনও হস্তিনাপুরের সিংহাসনে, অবিভক্ত কুরুরাজ্যের মহারাজাধিরাজ। তাই আমি আপনার পক্ষেই থাকব!” “গুরু দ্রোণ? আপনিও কি দুর্যোধনের পক্ষে?” “মহারাজ! এ কথা ঠিক অর্জুনের সামর্থে আমি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে পরাজিত করেছি। অর্ধেক পাঞ্চাল আমার অধিগত। কিন্তু মনে মনে আমি জানি আমি ব্রাহ্মণ, শিক্ষক। রাজা হওয়া আমার সাজে না। যেদিন অপমানিত আমি আপনার আশ্রয় ভিক্ষা করেছিলাম, সে দিন আমাকে আশ্রয় দিয়ে কুরুকুমারদের অস্ত্রশিক্ষার ভার দিয়েছিলেন। সেদিনই আমি মহারাজের অন্নদাস হয়ে গিয়েছি। পার্থ আমার প্রিয় শিষ্য তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি কুরু সিংহাসনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, এ ব্রাহ্মণের অঙ্গীকার।“ সুরালয়ের রক্ষীরা সসম্ভ্রমে পথ মুক্ত করল। নিঃশব্দে প্রবেশ করলেন রাণী ভানুমতী। দুর্যোধন তাকে দেখে আশ্চর্য হলেন। তিনি পিছন ফিরে তাকালেন, রক্ষীরা বিদায় নিল। “দেবী হঠাৎ এস্থলে?” “আর্য সুযোধন! আপনি আজকাল সুরালয়ে সায়ংকাল অতিবাহিত করেন। অগত্যা এখানে আসতে হল!” দুর্যোধন প্রমাদ গনলেন, ভানুমতী নিশ্চিত কারণ ছাড়া এত গম্ভীর হন না। কিন্তু বিষয়টি কি? দুর্যোধন ভাবলেন। “আর্য সুযোধন, যে বীর আমাকে হরণ করে এনেছিলেন, যে বীর প্রজাপালক, যে বীর পররাজ্যলোলুপ নন, যে বীর আপন স্নেহচ্ছায়ায় ভ্রাতেদের রক্ষা করেন, যে বীর মাতা ও পিতাকে দেবতার ন্যায় শ্রদ্ধা করেন, সেই বীর সুযোধন আজ কোথায়? আরেকজন মানুষ, যিনি ক্রুর, ক্ষমতালিপ্সু, সর্বাপেক্ষা যিনি নারী নিপীড়ক, সেই মানুষটি আমার অপরিচিত। কল্যাণী যাজ্ঞসেনীকে যে অসম্মান আপনি করেছেন, বলুন আর্য সুযোধন তা কি বীরোচিত? ক্ষত্রিয়চিত? আপনারা পূর্ণ রাজসভায় সকলে মিলে এক অসহায়া নারীকে ধ্বস্ত করলেন, বিবস্ত্র করলেন, তা কি লজ্জার নয়? আপনি কোনও পাণ্ডব ভ্রাতাকে আঘাত করেন নি, ভ্রাতৃজায়া, এক নারীকে লাঞ্ছনা করেছেন। আমার স্বামী এ হীন কর্ম করতে পারেন ভেবে আমি লজ্জায় মাটিতে মিশে গেছি। স্বয়ং বাসুদেব এসে পাঞ্চালীকে রক্ষা না করলে, তার পরিণতি কি হতো, তা ভাবলে আমার শরীর অবশ হয়ে আসে। দেবর দুঃশাসন, আর্য কর্ণ, সকলে সেদিন একসাথে ধর্ম বিস্মৃত হয়েছিলেন। যেন কোন এক এক পশুর বেশে মূর্তিমান অধর্ম আপনাকে গ্রাস করেছিল!” “দেবী ভানুমতী!” চিৎকার করে উঠলেন দুর্যোধন। “আমাকেও কি লাঞ্ছিত করবেন আর্য? কৃষ্ণার মতো? বিবস্ত্র করবেন আপনাকে প্রশ্ন করার জন্য?” “এখনি এ স্থান ত্যাগ করুন রাজ্ঞী ভানুমতী!” দুর্যোধন যেন অনুনয় করলেন। “আপনার কাছে অনুমতি চাইতে এসেছি আর্য সুযোধন। আমার কাজ শেষ হয়েছে। পুত্র বড় হয়ে গেছে, কন্যার বিবাহ হয়ে গেছে। কলিঙ্গের জন্য মনটা বড় উতলা হয়েছে। পিতার জন্য, মাতার জন্য, কলিঙ্গের গাছপালা, মানুষ, সমুদ্রের জন্য বড় ব্যাকুল হয়েছি আমি। অনুমতি করুন আর্য সুযোধন, আমি কলিঙ্গে যাই একবার!” দেবী ভানুমতীর সুতীব্র তিরস্কার শুনেও দুর্যোধন নীরবে বসে থাকেন। ভানুমতীর প্রত্যেকটি কথা কাঁটার মত বিঁধেছে তার হৃদয়ে। উন্মাদের মতো সুরা পান করে যান দুর্যোধন। যন্ত্রণায় তার মুখমণ্ডল বিকৃত হয়ে আসে। বিষাদপ্রতিমা দেবী ভানুমতী স্খলিতচরণে নিঃশব্দে বিদায় নেন।
ইন্দ্রপ্রস্থে সাজসাজ রব। হস্তিনাপুর থেকে স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র এসেছেন, এসেছেন গাঙ্গেয় ভীষ্ম, বিদুর, দ্রোণ সহ দুর্যোধন। এসেছেন বহু ঋষিগণ। স্বয়ং কেশব তো আছেনই। আর এসেছেন মাতা গান্ধারী আর সন্তানসহ দেবী ভানুমতী। বহুদিন পরে এই পারিবারিক মিলনে ইন্দ্রপ্রস্থ আনন্দে ভরপুর। দুর্যোধন ও পাণ্ডব ভাইদের দেখে কে বলবে, এরা ঘোষিত শত্রু। পাঞ্চালীর অন্তঃপুরে ভানুমতীর স্থান হয়েছে। তারও তো পাঁচ বালক ও শিশুপুত্র। দুর্যোধনের অপত্যদের সাথে মিলে সাত। পাঞ্চালীর গৃহাভ্যন্তর সাতটি শিশুর কলকাকলিতে পূর্ণ। অতিথি সৎকারের ফাঁকে পাঞ্চালি ও ভানুমতী একান্তে গল্প করেন। মাতা কুন্তী আর মাতা গান্ধারীর বড় পরিতোষ। জীবনের এই খণ্ডকালের সুখ বড় বেশি ক্ষণস্থায়ী মনে হয় যেন। এ আনন্দ কি কুরুবংশে বেশিদিন সইবে? আনন্দের উদ্বেলতার মাঝে গোপনে দীর্ঘশ্বাস মোচন করেন কুরুললনাগণ। সব যুদ্ধেই আগে লাঞ্ছিত হন নারীরা, এতো যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। তাদের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা তো সেই কথাই বলে। তবু ক্ষনিকের জন্য হলেও, এ দুর্মূল্য আনন্দ তারা দুহাতে আঁকড়ে ধরছেন পরম মমতায়। যুধিষ্ঠিরের মনে সাধ জেগেছে রাজসূয় যজ্ঞের। চক্রবর্তী সম্রাটরাই তো রাজসূয় যজ্ঞ করেন। কিন্তু পাণ্ডবেরা তো হস্তিনাপুরের অধীনস্ত, সার্বভৌম নয়। গাঙ্গেয় ভীষ্ম বা বিদুর মুখে কিছু বললেন না। কিন্তু দুর্যোধনের মনে শঙ্কার ছায়া দেখা দিল। মনে মনে রুষ্ট হলেন ধৃতরাষ্ট্র। যুধিষ্ঠির কি বুঝতে পারেন নি এই কথাটি? নাকি ইচ্ছে করেই দুর্যোধনকে তিনি প্রতিস্পর্ধা দেখাতে চাইছিলেন? অজেয় অর্জুন, মহাশক্তিধর ভীমসেন, মিত্র কেশব তাকে সেইমত মদগর্বী করে তুলেছিল। অনুমান করলেন শুধু কৃষ্ণ। তিনি একান্তে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “রাজন! রাজসূয় যজ্ঞের অর্থ হল সকল রাজাদের আপনার ক্ষমতাকে স্বীকার করা। এই নয় যে সকল রাজ্যকে বাহুবলে পরাজিত করা, কিন্তু ক্ষমতায় আপনার শ্রেষ্ঠত্বকে অনুমোদন করা। বর্তমান সময়ে ভারতবর্ষের সকল রাজা কি তা করেন? কেউ যদি আপনার যজ্ঞের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন, তা হলে যজ্ঞের উদ্দেশ্য ব্যহত হবে। যাদব গণপতি ভীষ্মক, চেদীরাজ শিশুপাল, এবং সর্বশেষে মগধরাজ জরাসন্ধ কি আপনার সারবভৌমত্ব মেনে নেবেন? যদি না নেন, তবে আপনার যজ্ঞ করে কি লাভ হবে, একমাত্র হাস্যাস্পদ হওয়া ছাড়া? তা হলে সর্বাপেক্ষা খুশি হবেন আর্য দুর্যোধন!” অনেকক্ষণ চুপ থেকে অর্জুন প্রশ্ন করলেন, “তাহলে উপায় কি, মাধব?” কৃষ্ণ বললেন, “জরাসন্ধের নিধন! জরাসন্ধ নিহত হলে চেদীরাজ ও অন্যান্য রাজাগন হতোদ্যম হয়ে পরবেন! জয়াসন্ধ কৌরবদের বন্ধু নন, তাই হস্তিনাপুর হতে কোনও আশঙ্কা নেই!” কৃষ্ণের পরামর্শ মতো জরাসন্ধের হত্যা পরিকল্পনা করা হল গোপনে। নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনা, সম্মুখসমর নয়, গুপ্তঘাত। সম্মুখসমরে জরাসন্ধকে পরাজিত ক্ষমতা পাণ্ডব ও যাবদদের মিলিত শক্তির পক্ষেও অসম্ভব ছিল। জরাসন্ধ বহুদিন ধরেই যাদবদের পথের কাঁটা, সেই কংসের নিধনের পর থেকেই। তারই কারণে যাদবদের দ্বারকায় পলায়ন একপ্রকার। যুধিষ্ঠির তার রাজসূয় যজ্ঞ স্থগিত রাখছেন, এ সংবাদ পৌঁছল ধৃতরাষ্ট্র সমীপে। তিনি সন্তোষ প্রকাশ করলেন। কিন্তু দুর্যোধন? তিনি ভাবলেন, এর মধ্যে কি অন্য অর্থ লুকিয়ে আছে। বিশেষ করে মাধব বড় চতুর ব্যক্তি। পরিকল্পনামাফিক বিভিন্ন সময়ান্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল যাত্রা করল পাটলীপুত্রের অভিমুখে। অগ্রবর্তী কয়েকটি দল যাত্রা করা পর আর একটি ছোট দল রওনা হল, সে দলে কৃষ্ণ, ভীম আর অর্জুন। সাথে তাদের নির্বাচিত দেহরক্ষী। তারা যাদব যোদ্ধা, কৃষ্ণের নির্বাচিত। তারা চললেন ব্রাহ্মণের বেশে। পাটলীপুত্রে জরাসন্ধের রাজগৃহ যথেষ্ট সুদৃঢ় ও বিশাল। একপাশ দিয়ে পবিত্র ভাগীরথী বয়ে যাচ্ছে। পাটলীপুত্র ভারতের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ জনপদ। প্রাচীনও বটে। জরাসন্ধ নিজে পরম শৈব, তথাপি তার রাজত্বে বৈষ্ণব, শাক্ত, গাণপত্য, চার্বাকপন্থী সকলেই বাস করেন। তন্ত্রবাদী জরা গোষ্ঠী মহারাজের বিশেষ প্রিয়। শৈশবে মহারাজের অবয়বে একটি বিশেষ অসুখ ধরা পড়ে। তার পদসন্ধির যায়গাটি বিশেষ দুর্বল। এই জরা গোষ্ঠীর যিনি প্রধানা, তিনি বিশেষ ওষধি প্রয়োগ করে তাকে সুস্থ করেন। জরাসন্ধের পিতা সেইজন্য জরা গোষ্ঠীকে আজীবন সাহায্যের আশ্বাস দেন। সেই প্রধানা জরাসন্ধের নিমিত্ত একটি বিশেষ বন্ধনীর ব্যবস্থা করেন কিছুদিন অন্তর অন্তর। মহারাজ সারা দিনমান সেই বন্ধনী পরে থাকেন, কেবল রাত্রে দেবোর্চনার সময় খুলে রাখেন সযত্নে। বন্ধনী পরিহিত জরাসন্ধকে মল্লে পরাজিত কেউ করতে পারেন না, এমনকি ভীমসেনও না। অমিত বলশালী জরাসন্ধ অন্যান্য যুদ্ধেও অতি সক্ষম যোদ্ধা। এ সমস্ত সংবাদ কৃষ্ণকে দিয়েছিলে তার বিশেষ গুঢ়পুরুষেরা। সভাগারে উপবেসিত আছেন মহারাজ জরাসন্ধ। তার দর্শনপ্রার্থী আজ তিন ব্রাহ্মণ। তারা শৈব দর্শনের বিশেষ কিছু প্রশ্ন নিয়ে মহারাজের সাথে আলোচনা করতে প্রত্যাশী। মহারাজ সানন্দে আলোচনার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। ব্রাহ্মণগণ নিবেদন করলেন, সভাগৃহে নয়, মহারাজের উপাসনাগারে, স্বয়ং মহাকালের সম্মুখে তারা এই আলোচনা করতে চান। জরাসন্ধ আনন্দে সম্মতি দিলেন। ঠিক হল সূর্যাস্তের পর ব্রাহ্মনেরা যেন তার সমীপে আসেন। দিনকর অস্তাচলে গেছেন। রাজপুরীতে জ্বলে উঠেছে মশালের আলো। তিন ব্রাহ্মণ রাজপুরীতে এলেন। পরনে শুভ্র বসন ও উত্তরীয়। রক্ষীরা তাদের প্রবেশ করতে দিল। ব্রাহ্মণেরা তারপর রাজকীয় উপাসনালয়ে প্রবিষ্ট হলেন। মহারাজ তখন তার বিশেষ বন্ধনীমুক্ত হয়ে, স্নান করে মহাকালের অর্চনার কাজে সবে ব্যাপৃত হয়েছেন। তিনজন ব্রাহ্মণকে মহারাজ সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। আর তখনই সেই ব্রাহ্মণের বেশধারী আততায়ীগণ, কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন, জরাসন্ধকে হত্যা করলেন। ইঙ্গিতে বাহিরে অপেক্ষমান আরও যাদবসেনা দ্রুত প্রবেশ করল রাজগৃহে। রক্ষীরা কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই সংগঠিত হল জরাসন্ধবধ। ধর্মযুদ্ধ কেন, কোনও যুদ্ধই নয়, অক্ষত্রচিত খুনে আততায়ীদের নেতৃত্ব দিলেন স্বয়ং বাসুদেব কৃষ্ণ।
জরাসন্ধ নিহত হলেন, ফলে তার অনুগামী রাজারাও হতদ্যম হয়ে গেলেন। রাজসূয় যজ্ঞ করবার জন্য যুধিষ্ঠিরের আর কোনও বাধা থাকল না। ভীষ্ম, বিদুরের ইচ্ছায় মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রও মত দিলেন। পাঞ্চাল ও বিরাটরাজও অনুমোদন করলেন। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যখন পাণ্ডবদের দিকে, তখন যাদবরাও রাজসূয় যজ্ঞে সানন্দে রাজি হলেন। যুধিষ্ঠির মহা উৎসাহে রাজসূয় যজ্ঞ আয়োজনে ব্রতী হলেন। হস্তিনাপুর থেকে সকলে এলেন ইন্দ্রপ্রস্থে, পাণ্ডবদের নবনির্মিত রাজধানীতে। যজ্ঞের নাম শুনে মুনি, ঋষি, ব্রাহ্মণেরা ভিড় জমাতে লাগলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। ইন্দ্রপ্রস্থে তখন চাঁদের হাট। রাজপ্রাসাদের মহার্ঘ এক অংশে সপরিবার দুর্যোধন অবস্থান করছে। হস্তিনাপুরে রাজগৃহটি প্রাচীন ও কাষ্ঠনির্মিত। আর ইন্দ্রপ্রস্তের এই রাজগৃহ নবনির্মিত, মর্মরাদি প্রস্তরদ্বারা প্রস্তুত। দক্ষিণদিকের একদল অনার্য শিল্পী, ময় নামক গোষ্ঠীপতির তত্বাবধানে এই সুবিশাল রাজগৃহটি নির্মাণ করেছে। রাজসূয় যজ্ঞ উপলক্ষে আরও অনেক অস্থায়ী গৃহ, কুটির ও শিবির স্থাপন করা হয়েছে। অতিথি রাজন্যগণের জন্য সুদৃশ্য মর্মরগৃহ, ব্রাহ্মণ্যগণের জন্য স্তরভেদে শিবির ও কুটির নির্মিত হয়েছে। কুরুজ্ঞাতিগণ অবশ্যই রাজপ্রাসাদেই অবস্থান করছেন। নিজকক্ষের সম্মুখে কৃষ্ণপ্রস্তরময় অলিন্দে দুর্যোধন পদচারণা করছেন। সে অলিন্দ অতি মসৃণ ও পিচ্ছিল। পিচ্ছিল অলিন্দে অভ্যস্থ হতে হয়, তাই দুর্যোধনের এই পদচারণা। তিনি অলিন্দের গাত্রে খোদিত অলঙ্করণের শিল্পসুষমা উপভোগ করছিলেন। সন্ধ্যায় দেবী ভানুমতীর সন্ধানে ওদিকেই আসছিলেন রাজ্ঞী যাজ্ঞসেনী। পথে দেখা হল দুর্যোধনের সাথে। মিষ্ট হাস্য করে দ্রৌপদী বললেন, “সকল কুশল তো আর্য সুযোধন?” ভানুমতীর কাছে এই সম্বোধনটি তিনি সংগ্রহ করেছেন। “হ্যাঁ দেবী!” দুর্যোধন মৃদু হাসলেন। তিনি দ্রৌপদীকে ভাল করে লক্ষ্য করলেন। স্বয়ম্বরের পর প্রায় চোদ্দ বছর কেটে গেছে। পাঞ্চালী এখন পূর্ণ যুবতী। ভানুমতী যদি নম্র দীপশিখা হন, তবে পাঞ্চালী প্রজ্বলিত মশাল। যেন দাউ দাউ করে জ্বলছেন। ভানুমতী তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা, পাঞ্চালী কৃষ্ণা। ভানুমতী কলিঙ্গের জল হাওয়ায় তৈরি পেলব পুত্তলি, আর যাজ্ঞসেনী আর্যাবর্তের জল হাওয়ায় নির্মিত ক্ষুরধার প্রতিমা। দুজনেই অলোকসামান্যা সুন্দরী, কিন্তু দু রকমের। দুর্যোধন প্রশ্ন করেন, “মহারাজ্ঞীর কি সংবাদ?” প্রশ্নটি নির্দোষ, কিন্তু পাঞ্চালিকে বিঁধল তীব্রভাবে, তার অন্তরে প্রায় প্রশমিত ক্ষতে রক্তক্ষরণ শুরু হল। তিনি হাস্যমুখে বললেন, “পাণ্ডবরমণী আমি, পাঁচ পাঁচজন পুরুষের অধীনা। তারাই আমার স্বামী। আমি সর্বদা নিজেকে তৃপ্ত বোধ করতে শিখে নিয়েছি, আর্য দুর্যোধন! সুখ কি বস্তু তা তো আমি জানি না! দুর্যোধন অনুভব করলেন পাঞ্চালীর ক্ষতটি। মনে মনে ভাবলেন কি যেন। দ্রৌপদী প্রসঙ্গ পাল্টালেন, “ভগ্নি ভানুমতী কত ভাগ্যবতী দেখুন, আমার ঈর্ষা হয়। তার আমার মতো অসংখ্য স্বপত্নি নেই, অন্তত অদ্যাবধি। নিজ স্বামীর উপর তার সম্পূর্ণ অধিকার! আর আমি? বাহিরের অসামান্য চাকচিক্য, অন্দরে এক দীন ভিখারিনী!” দ্রৌপদীর কথাটি বিদ্যুতের মত তার কানে পৌঁছল। তাকে অতর্কিতে আক্রমণ করে ধরাশায়ী করে দিল। তিনি কি মনে মনে পাঞ্চালীকে কামনা করেন না এখনও? যদি করেন, তবে তা কি ভানুমতীর প্রতি বিশ্বাসঘাত নয়? ভানুমতী কি বুঝতে পারেন তার এ দুর্বলতার কথা? তিনি যখন ভানুমতীকে আদর করেন, তখন কি তার নয়নপথে পাঞ্চালীর মূর্তি ভেসে ওঠে? “কি ভাবছেন আর্য?" দুর্যোধন বিহ্বল হয়ে গেছেন। অর্জুন বহুবিবাহ করেছেন, তা গোপনে নয়, প্রকাশ্যে। তার কথা কৃষ্ণা জানেন। কিন্তু তিনি যে মনে মনে পাঞ্চালীকে আজও কামনা করেন, তা তো ভানুমতী জানেন না। অর্জুন কৃষ্ণাকে জয় করেছিলেন, স্বীয় দক্ষতার পরাকাষ্ঠায়। তিনি সেদিন পারেন নি। তবুও তিনি অন্যায্যভাবে কৃষ্ণাতে আসক্ত! ভানুমতী কি বুঝতে পারেন? রাজ্ঞী দ্রৌপদী তার দিকে অর্থপূর্ণ হাস্য করে ভানুমতীর কক্ষের দিকে চললেন। আকস্মিক পদচারনায় দুর্যোধনের পদস্খলন হল মসৃণ কৃষ্ণপ্রস্তরে। অপ্রস্তুত দুর্যোধনকে দেখে গমনরতা পাঞ্চালী হেসে উঠলেন তরুণীর প্রগলভতায়। আর্য দুর্যোধন আজ ধরা পড়ে গেছেন! নির্দিষ্ট দিনে রাজসূয় যজ্ঞ শুরু হল। নারদগোষ্ঠীর প্রধান যিনি, তিনি নারদ বলেই বিঝ্যাত, তারই তত্বাবধানে যজ্ঞ হবে। ব্রতী যুধিস্থিরকে প্রথমে একজন ব্যক্তিকে অর্ঘ্য দিয়ে বরণ করতে হবে। গোল বাধল, কাকে দেবেন তিনি সেই অর্ঘ্য? শাস্ত্রে আছে আচার্য, ঋত্বিক, সম্বন্ধি, স্নাতক, নৃপতি ও প্রিয়ব্যক্তি, এই ছয় প্রকার ব্যক্তি অর্ঘ্যের অধিকারী। সকলে মনে করেছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ গাঙ্গেয় ভীষ্ম এই অর্ঘ্য পাবেন। তিনি কুরুকুলপ্রদীপও, সকল নৃপতি ঋষিগণের মান্য। কিন্তু যুধিষ্ঠির বাসুদেব কৃষ্ণকে অর্ঘ্য দেবার মনঃস্থ করলেন। উপস্থিত রাজাদের অনেকেই তীব্র আপত্তি করলেন। তার মধ্যে ছিলে চেদীরাজ শিশুপাল। স্বয়ং ভীষ্ম কি মনে মনে আহত হয়েছিলেন? কৃষ্ণ যেমন নিজেকে বাসুদেব বলেন, তেমনই সুহ্মের রাজা এবং চেদীরাজও নিজেদের বাসুদেব বলে দাবী করেন। তার মধ্যে শিশুপাল আবার যাদব বংশোদ্ভূত। একে তো অর্ঘ্যের অধিকার, তায় আবার বাসুদেব পদ নিয়ে টানাটানি, কৃষ্ণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। তদুপরি ভীষ্ম পরম বৈষ্ণবও বটে। সমগ্র আর্যাবর্তে বাসুদেব পদটি রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অর্ঘ্যদান সেই প্রশ্নে শিলমোহর দেবে, এই ছিল কৃষ্ণের পরিকল্পনা। চেদীরাজ তাকে বাদ সাধলেন। কৃষ্ণ যারপরনাই কুপিত হলেন। অতর্কিতে যাদব যোদ্ধাদের সাহায্যে যজ্ঞস্থলেই শিশুপালকে হত্যা করলেন। শিশুপাল যুধিষ্ঠিরের আমন্ত্রিত আতিথি। তারই আয়োজিত যজ্ঞে তিনি এসেছিলেন সৈন্যবাহিনী ছাড়াই। সেখানে কৃষ্ণ তাকে হত্যা করলেন নৃশংসভাবে। ক্ষমতা ও পদের মোহ বৈষ্ণবহৃদয়সম্রাট কৃষ্ণকে এই পথে ঠেলে দিল। যুধিষ্ঠির প্রতিবাদ করলেন না, বিষ্ণুভক্ত নারদগণ প্রতিবাদ করলেন না, যাদবদের তরবারির ভয়ে সকলেই মৌন থাকলেন। ভীষ্ম তাড়াতাড়ি যুধিষ্ঠিরকে অনুজ্ঞা করলেন কৃষ্ণকে অর্ঘ্য দেবার জন্য। যজ্ঞবেদীতে রক্তের দাগ লেগে রইল। কৃষ্ণের বাসুদেবত্বের প্রতিস্পর্ধা করার কেউ রইল না। পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন হল। শুধু ঋষি ব্যাসদেব দুর্লক্ষণ আশঙ্কা করলেন। কুরুগণ ফিরে চললেন হস্তিনাপুরে। বিমর্ষ ভীষ্ম, মৌন বিদুর। শুধু দুর্যোধন বারবার ভানুমতীর দিকে তাকাচ্ছেন। ভানুমতী তার প্রতি স্মিত হাস্য করছেন। লক্ষ্মণ ও লক্ষ্মণাকে সামলাচ্ছেন। আর্য সুযোধনের কি হল? দুর্যোধন ভেবেই চলেছেন, পাঞ্চালী ভানুমতীকে বলে দিয়েছেন সব কথা?
গান্ধাররাজ সুবলকে ভীষ্ম বন্দী করে রেখেছিলেন তার সন্তানসহ আমৃত্যু। অজুহাত ছিল, তিনি নাকি গান্ধারীর ভ্রান্ত কোষ্ঠী দিয়ে প্রতারণা করেছেন। আসলে প্রতারণা করেছিলেন স্বয়ং গাঙ্গেয়, ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্ব গান্ধাররাজের নিকট লুকিয়েছিলেন। সেই কারাপাশ থেকে একজনই জীবিত ফিরে এসেছিলেন, তিনি সুবলনন্দন শকুনি। বুদ্ধিমান শকুনির একমাত্র লক্ষ্য, প্রতিশোধ। ভাগিনেয় দুর্যোধন তার বড় প্রিয়পাত্র। দুর্যোধন যুবরাজ, তাই ভীষ্ম সৌবলকে কিছু করতে পারেন না। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে শকুনির প্রতি। শৈশব হতেই শকুনি দুর্যোধন ও তার ভ্রাতাদের গাঙ্গেয় ভীষ্মের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তুলেছেন বহু আয়াসে। তা ছাড়া শকুনি মনে মনে ঘৃণা করেন আর একজনকে, তিনি বিদুর। বিদুর ক্ষত্ত, বুদ্ধিমান। কিন্তু তিনি গোপনে পাণ্ডবদের পক্ষে, তিনি সতত যুবরাজ দুর্যোধনের অমঙ্গল কামনা করেন। হস্তিনাপুরের মহামন্ত্রী হবার সুবাদে তার হাতে ক্ষমতাও কম নয়, রাজকোষ তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। দুর্যোধনের অন্তঃপুরে একটি গোপন সভা বসেছে। সেখানে উপস্থিত আছেন অঙ্গরাজ কর্ণ, দুঃশাসন, শকুনি এবং স্বয়ং যুবরাজ দুর্যোধন। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ সকলকে খুবই চিন্তান্বিত করেছে। দুর্যোধন প্রশ্ন করলেন, “মাতুল! এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কি?” কর্ণ, দুঃশাসন নিরুত্তর। নীরবতা ভাঙলেন শকুনি। “যুদ্ধ অসম্ভব! তার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি আবশ্যক। বিশেষ কূটনৈতিক পরিকল্পনাও করাও দরকার। এখন সে সময় নয়। আমি চিন্তা করে একটা উপায় স্থির করেছি!” “কি উপায়, মাতুল?” “অক্ষক্রীড়া! যুধিষ্ঠির অত্যন্ত অক্ষাসক্ত, কিন্তু তার অক্ষক্রীড়ায় তার দক্ষতা নেই। যুধিষ্ঠিরসহ সকল পাণ্ডবদের অক্ষক্রীড়ায় আহ্বান করা হোক!” “কিন্তু যুধিষ্ঠির যদি সে আমন্ত্রণ গ্রহন না করেন?” কর্ণ এবার প্রশ্ন করলেন।“ “কোনও নৃপতি যদি যুদ্ধে, মৃগয়ায় ও অক্ষক্রীড়ায় প্রতিস্পর্ধার সম্মুখীন হন, তা হলে তাকে সেই প্রতিস্পর্ধা স্বীকার করতেই হবে। এটাই আর্য নরপতিগণের পালনীয় নিয়ম, বসুষেন!” “কৌরবপক্ষে কে অক্ষক্রীড়া করবেন, মাতুল?” দুঃশাসন প্রশ্ন করলেন। “অবশ্যই আমি দুঃশাসন। তুমি জ্ঞাত আছ যে, অক্ষক্রীড়ায় আমার দক্ষতা সুবিদিত!” সভায় আসীন আছেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, গাঙ্গেয় দেবদত্ত, মহামন্ত্রী বিদুর, গুরু দ্রোণাচার্য, কৃপ আদি সকলেই। যুবরাজ দুর্যোধন পাণ্ডবদের সাথে অক্ষক্রীড়ার প্রস্তাব দিলেন। যথারীতি ভীষ্ম ও বিদুর আপত্তি জানালেন। অনেক বাদানুবাদের পর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মন্ত্রী বিদুরকে আদেশ দিলেন সপরিবার পাণ্ডবদের হস্তিনাপুরে আসার জন্য। পাণ্ডবেরা সকলেই হস্তিনাপুরে এলেন। এ খবর যখ কৃষ্ণ শুনলেন, তখন তিনি দ্বারকা অভিমুখে যাত্রা করেছে। মূর্খ যুধিষ্ঠির তাকে জ্ঞাপন করার প্রয়োজনও বোধ করলেন না। বাসুদেব কৃষ্ণ সর্বনাশের কৃষ্ণমেঘ দেখলেন। রথের মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত হস্তিনাপুরের দিকে যাত্রা করলেন। রাজসভার পাশা খেলতে বসলেন যুধিষ্ঠির আর শকুনি। তাদের ঘিরে রয়েছেন পাণ্ডব ও কৌরবগণ। নারীরা অন্দরে। প্রিয়জনের সাথে বাক্যালাপে মত্ত। অক্ষক্রীড়া হচ্ছে পণ রেখে। প্রথমে যুধিষ্ঠির তার সমস্ত ধন রত্ন হারলেন। তারপর সকল ভাইদের। যুধিষ্ঠির পরাজিত হয়ে ক্রমশ বোধবুদ্ধিহীন হয়ে যাচ্ছেন। তিনি এইবার পণ রাখলেন তার ভাইদের। পণের শর্ত অনুযায়ী পাণ্ডব ভ্রাতাগণ দুর্যোধনের দাস হলেন। এবার কথা বললেন দুর্যোধন, “পাঞ্চালীকে পণ রাখুন ভ্রাতা যুধিষ্ঠির!” চিত্রাঙ্গদা, সুভদ্রা নয়, পাঞ্চালী দ্রৌপদী? যদি দ্রৌপদী পাণ্ডবদের রাণী হন, তাহলে তারাও তো পাণ্ডবদের রানী। যুধিষ্ঠির স্থিরনিশ্চয় না দেখে দুর্যোধন আবার বললেন, “আপনারা ইতোপূর্বেই আমার অধীন হয়েছেন, দাস। দাসের কোনও স্বাধীন চিন্তা থাকতে পারে না, যুধিষ্ঠির!” যুধিষ্ঠির নতমুখে কৃষ্ণাকে পন রাখলেন। শকুনির পাশা এবারেও জিতে গেলো। স্তব্ধ রাজসভা। এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটে নি, বিশেষত কুরুবংশে। কেঁপে উঠলেন ধৃতরাষ্ট্র। দুর্যোধন বললেন, “প্রাতিকামিন! দ্রৌপদীকে সভায় আনয়ন কর!” অক্ষক্রীড়ার ফলাফল শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন কুরুমহিষী গান্ধারী, পাণ্ডবমাতা কুন্তী এবং অন্যান্য সকলে। পাঞ্চালী রজস্বলা ছিলে বলে একবস্ত্রা হয়ে পৃথক কক্ষে অবস্থান করছিলেন। প্রাতিকামী এসে তাকে দুর্যোধনের আদেশ নিবেদন করল। দ্রৌপদী তাকে ফেরত পাঠালেন জেনে আসতে, যে তিনি যুধিষ্ঠির বিজিত হবার পূর্বে বিজিত হয়েছেন কি না! প্রাতিকামী সে কথা সভায় নিবেদন করলে দুর্যোধন প্রাতিকামীকে আদেশ দিলেন, দ্রৌপদীকে বলপূর্বক সভায় নিয়ে আসতে। প্রাতিকামী মাথা নিচু করে সে আদেশ অগ্রাহ্য করল। ক্ষিপ্ত দুর্যোধন তখন দুঃশাসনকে পাঠালেন দ্রৌপদী বলপূর্বক নিয়ে আসার জন্য। দুঃশাসন দ্রৌপদিকে সভায় আনলেন অর্ধনগ্ন অবস্থায়, তার কেশ আকর্ষণ করে। একমাত্র বৃকোদর ব্যতীত সকলে নীরব রইল। ক্রন্দনরতা পাঞ্চালী কুরুবৃদ্ধ গাঙ্গেয় ভীষ্মকে প্রশ্ন করলেন, “বলুন তাত ধর্ম কি? বিজিত দাস কখনও তার স্ত্রীকে পন রাখতে পারে?” “ভীষ্ম বললেন, “ধর্মের গতি অতি সূক্ষ্ম পাঞ্চালী। তোমার স্বামী যুধিষ্ঠির বিজিত হয়ে এক্ষণে দাস মাত্র। তার আর কোনও সম্পদে অধিকার নেই, এটি নিশ্চিত। কিন্তু সে তোমার স্বামী, সেই কারণে তার তোমাকে পণ রাখা অধর্ম নয়!” ভীমসেন সভায় দণ্ডায়মান হলেন। যুধিষ্ঠিরের বাহু আকর্ষণ করে সহদেবকে বললেন, “সহদেব! ত্বরায় অগ্নি আনো। যে হাত দিয়ে যুধিষ্ঠির অক্ষক্রীড়া করেছেন, তাকে আমি অগ্নিসমর্পণ করবো!” অর্জুন কোনওমতে তাকে নিবৃত্ত করলেন। তখনও বিবস্ত্রা পাঞ্চালী কেঁদে চলেছে। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপ নিরুত্তর। শুধু বালক বিকর্ণ প্রতিবাদ করলেন। তখনই সভায় ঝড়ের বেগে প্রবেশ করলেন কৃষ্ণ। তড়িৎগতিতে নিজের উত্তরীয় দিয়ে দ্রৌপদীকে আবৃত করলেন। তারপর ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সভাস্থ সকলের দিকে তাকালেন “ধিক্কার সকলকে! আপনারা শুধু কুরুবংশের মুখে কালিমা লেপন করেন নি, আপনারা আর্যাবর্তের সমস্ত ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণকে কলঙ্কিত করেছেন। শ্রবন করুণ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, কৃষ্ণাকে এই অসম্মানের পাপে কুরুবংশ নির্বংশ হবে!” রুষ্ট মাধব আরও কথা বলার আগেই ভীমসেন বলে উঠলেন, “শুনুন উপস্থিত সকলে, আমি পাণ্ডুতনয় ভীমসেন আমার পিতৃপুরুষকে স্মরণ করে প্রতিজ্ঞা করছি, যে দুঃশাসন প্রকাশ্য সভামধ্যে পাঞ্চালীকে বক্ষলগ্না করতে চেয়েছে, আমি যুদ্ধে তার বক্ষ বিদীর্ণ করবো। সে পাঞ্চালীর কেশ আকর্ষণ করেছিল, আমি তার বিদীর্ণ বক্ষের রুধিরে পাঞ্চালীর কেশ ধৌত করবো! আর দুর্যোধন, যুবরাজ দুর্যোধন! ক্ষমতার মদগর্বে গর্বিত হতে সে পাঞ্চালীকে তার জানুতে বসার কুৎসিত আহ্বান করেছিল। আমি তার ঊরুদেশ এমনভাবে বিদীর্ণ করবো, যে সে যেন আর দুপায়ে হেঁটে চলতে না পারে। আর যদি আমি এই প্রতিজ্ঞা থেকে ভ্রষ্ট হই, যেন মৃত্যুর পরে আমার অগ্নিসৎকার না হয়, যেন পিতৃলোকে আমার স্থান না হয়!” এমনসময় রাজ্ঞী গান্ধারী এলেন। তার দৃষ্টিতে অগ্নির উত্তাপ। তিনি শুধু মহারাজকে বললেন, “ধিক মহারাজ! আমি পাঞ্চালীকে মুক্ত করছি। শুধু পাঞ্চালীকে নয়, আমি পাণ্ডবদেরও মুক্ত করছি। আপনারা অবগত হন!” এইবলে দেবী ভানুমতী পাঞ্চালীকে ধরে প্রাসাদ অন্দরে নিয়ে গেলেন। বিক্ষুব্ধ বাসুদেব হস্তিনাপুরের সভা ত্যাগ করলেন। তখন সন্ধ্যা। একা গবাক্ষের পাশে বসে রয়েছেন ভানুমতী, তার চোখের দৃষ্টি উদাস! বেদনাবিদ্ধ। দুর্যোধন এলেন সে কক্ষে। কক্ষে তখন দীপ জ্বলে নি। নিশ্চুপ দুর্যোধন। অনেকক্ষণ পড়ে মুখ খুললেন দেবী ভানুমতী। “পাঞ্চালীর উপর আপনার এতো ক্রোধ কেন, আর্য সুযোধন? প্রেমে প্রত্যাখ্যাত বলে? আপনি এতদিন তবে আমার সাথে ছলনা করেছেন!” দুর্যোধন কক্ষ থেকে দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হন। দেবী ভানুমতী তাকে ধরে ফেলেছেন। এক্ষণে মদিরায় ডুবে যেতে চান তিনি।

পুনর্বার অক্ষক্রীড়াসক্ত যুধিষ্ঠির পাশা খেললেন এবং নির্বোধের মতো পরাজিত হলেন। তারপর পূর্ব নির্ধারিত পণ অনুযায়ী বারো বছরের জন্য বনে গেলেন । সঙ্গে গেলেন ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব আর মাতা কুন্তী। সুভদ্রা দ্বারকায় রয়ে গেলেন ভ্রাতাদের কাছে। তাকে বনবাসে পাঠানোর সাহস কারোর ছিল না। শুধু দ্রৌপদী রইলেন পাণ্ডবদের সাথে। নানা দেশ ঘুরে অবশেষে পাণ্ডবরা এক মনোরম সরবরের তীরে তাদের বাসস্থান স্থির করলেন। স্থানটি যক্ষ নামক অনার্যদের এলাকা, চিত্রসেন তাদের দলপতি। পাণ্ডবেরা বনে গেছেন, তবু দুরযোধনের মনে শান্তি নেই। দুর্যোধন মনে করেছিলেন, পাঞ্চালীকে কাষায় বস্ত্র পরিয়ে তিনি মনে শান্তি পাবেন। সেই কাষায় বস্ত্র তো পরেছেন পাঞ্চালী, তবু কোথাও যেন দুর্যোধনের তৃপ্তি হচ্ছে না। অবজ্ঞা তার সয় না, বিশেষকরে কোনও নারীর! ভানুমতী খুব আশ্চর্য হয়েছিলেন, যখন যুধিষ্ঠির আবার পাশা খেলতে রাজি হলেন। দুর্যোধনের উপর তার রাগ হয়েছিল। কিন্তু এই কুরুবংশে সমস্ত পুরুষই সমান, ভানুমতীর মনে হয়েছিল। এমন একজনও নারী কুরুবংশে আসেন নি, যার উপর কোনও না কোনোভাবে অন্যায় হয়েছিল। হয়ত এটাই এ কালের নিয়ম। ক্ষত্রিয় কেন, ঋষি, মুনীরাই কম যান নাকি? ভানুমতী মাধবীর উপাখ্যান শুনেছেন। যযাতির কন্যা মাধবী, রাজকন্যা মাধবী। অমন যে সসাগরা ধরিত্রীর অধিপতি যযাতির তার কন্যার মুল্য ছয়শত অশ্বের সমান! কাহিনিটি এইরকম শুনেছেন ভানুমতী। ‘কান্যকুব্জের রাজা ঋচীক গাধিরাজের সুন্দরী কন্যার পাণিগ্রহণ করবার অভিপ্রায়ে প্রস্তাসব দিলেন। গাধিরাজ একটি শর্তে তার প্রস্তাবে রাজি হলেন। সুন্দরী কন্যার বিনিময়ে আটশত শ্যামৈককর্ণ অশ্ব চাই। এক কান কালো নিখুঁত আটশত দুধসাধা ঘোড়া! ঋচীক ঘোড়া আনতে গেলে উত্তর পশ্চিম দেশে, গান্ধার পেরিয়ে বরুণদেশে। অনেকে আবার এইদেশেকে ইলাবৃতবর্ষও বলেন। তার একপ্রান্তে বিশাল কশ্যপসাগর। আটশত অশ্ব নিয়ে বিতস্তা নদী পার হবার কালে নদীর স্রোতে দুইশত অশ্ব ভেসে যায়। ঋচীক অবশিষ্ট ছয়শত শ্যামৈককর্ণ অশ্বের বিনিময়ে গাধিরাজকন্যাকে বিবাহ করলেন। গাধিরাজ তার কতক নিজের কাছে রাখলেন আবার কতক বিপ্রগণের মধ্যে দান করে দিলেন। তার কিছু পরে ঋষি বিশ্বামিত্রের ওই অশ্বগুলির প্রয়োজন হয়ে পড়ল। তিনি ধরলেন তার শিষ্য গালবকে। গালব ভাবতে লাগলেন, কি উপায়ে ছয়শত এক কান কালো ঘোড়ার যোগাড় করবেন? যযাতির স্বর্গে যাবার ইচ্ছে। তাকে বোঝালেন গালব যে ছয়শত অশ্বের বিনিময়ে তিনি বিশ্বামিত্রের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হলেই তবে স্বর্গে যেতে পারবেন। যযাতি খুশিমনে স্বীয় কন্যা মাধবীকে গালবের হস্তে দিলেন। গালব তার নবলব্ধ পুত্রীকে প্রথমে রাজা হর্য্যাশ্বর সাথে মাধবীর বিবাহ দিলেন দুই শত অশ্বের বিনিময়ে। মাধবীর গর্ভে হর্য্যাশ্বের পুত্রলাভ হল। তারপর মাধবী পুনরায় কন্যাবস্থা প্রাপ্ত হলেন। অনেকটাই কুন্তীর মতো, দুর্বাসা ভোগ করার পর যেমন তিনি হয়েছিলেন। এরপর গালব গেলেন রাজা দিবোদাসের নিকট। সেখানেও গালব পেলেন দুইশত শ্যামৈককর্ণ অশ্ব। মাধবীর গর্ভে দিবোদাসের পুত্র হল আর মাধবী পুনর্বার কন্যাবস্থায় ফিরে গেলেন। ঠিক সত্যবতীর মত। পরাশর ঋষি তার গর্ভে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নকে জন্ম দেবার পর যেমন পুনরায় কনকাবস্থায় ফিরে যান ঋষির প্রসাদে। এবার মাধবী গেলেন ঊশীনরের প্রাসাদে। সেখানেও একই কাহিনী। গালবের অশ্বলাভ ও ঊশীনরের পুত্রলাভ। এইভাবে গালব ছয়শত এক কান কালো ঘোড়া নিয়ে বিশ্বামিত্রের কাছে গিয়ে বললেন, “গুরুদেব, আর অশ্ব তো প্রাপ্ত হবার সম্ভাবনা নেই, কারণ বাকি দুই শত অশ্ব নদীস্রোতে ভেসে গেছে!” বিশ্বামিত্র তার সেই ছয় শত শ্যামৈককর্ণ অশ্ব ও মাধবীকে গ্রহণ করলেন ভার্যারূপে এবং তার গর্ভে তার পুত্র হল। রাজা যযাতির স্বর্গে গেলেন। গালবের গুরুদক্ষিণা দান হল। মাধবী হারিয়ে গেলেন কাহিনির অরণ্যে!’ নারীরা আদতে পন্য, সম্পদ বিনিময়ের উপায়মাত্র। প্রণয় শুধুই ছলনা। আনমনা হয়ে যান দেবী ভানুমতী। সেই গন্ধর্বদেশে গোধনের প্রাচুর্য। হরিণ, শূকর, ইত্যাদি মৃগয়ার বড় প্রশস্ত স্থল। দুর্যোধনের বড় ইচ্ছা, তিনি ওইস্থলে মৃগয়া করবেন। সদলবলে ঘোষযাত্রায় রওয়ানা দিলেন, কর্ণ ও ভ্রাতাগণসহ দুর্যোধন। সাথে চলেন অন্যান্য পুরনারীর সাথে দেবী ভানুমতীও। যথেচ্ছ মৃগয়ায় সেই স্থানে বড় উৎপাতের সৃষ্টি হল। স্থানীয় গন্ধর্বেরা বিরক্ত হয়ে দুর্যোধনের সৈন্যদের সাথে যুদ্ধে ব্যাপৃত হল। গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন এসে দুর্যোধন ও কর্ণের সাথে যুদ্ধ করলেন। পরাজিত কর্ণ কবচ কুণ্ডলসহ পালিয়ে বাঁচলেন, কিন্তু ভ্রাতাগণসহ দুর্যোধন বন্দী হলেন চিত্রসেনের হাতে। তখন সকলে যুধিষ্ঠিরের কাছে সাহায্যের প্রত্যাশায় গেলেন। যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে অর্জুন চিত্রসেনের হাট থেকে দুর্যোধনসহ বাকি ভাইদের মুক্ত করলেন। কাষারবস্ত্র পরিহিত দ্রৌপদী ভানুমতী ও অন্যান্য পুরনারীদের যথেষ্ট আপ্যায়ন করলেন। অপমানিত লাঞ্ছিত দুর্যোধন হস্তিনাপুরে ফিরে এলেন।
পাণ্ডবদের বনবাস প্রায় শেষ হয়ে আসছে। তারপর এক বছর অজ্ঞাতবাস। আর দুর্যোধনের দুশ্চিন্তা ততই বাড়ছে। অজ্ঞাসবাস শেষ হলে তো পাণ্ডবেরা আবার রাজ্য চাইবে। নিজের শক্তি সম্পর্কে দুর্যোধন দ্বিধাগ্রস্ত। পিতামহ ভীষ্ম নবতিপর, প্রায় অশক্ত শরীরে তিনি কতটা যুদ্ধ করতে পারবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। আচার্য দ্রোণেরও বয়স হয়েছে, তবে তিনি এখনও পারঙ্গম। তাত বিদুর মনে মনে পাণ্ডবদের পক্ষে, তিনি আবার কুরু মহামন্ত্রী। রাজক্ষমতার কুঞ্চিকা তার হাতেই, বিশেষ করে অর্থ। কৃপাচার্য অবশ্যই তার পক্ষে, তিনি আচার্য দ্রোণের অনুগামী। জয়দ্রথ আছেন পক্ষে, তিনি শক্তিমানও বটে। গুরুপুত্র অশ্বত্থামা পিতার পিতার মতানুসারী, তবে অর্জুনের সাথে তার ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতা আছে। কৌরবপক্ষের তিনি অন্যতম শক্তি। কিন্তু কর্ণকে নিয়ে তার সংশয়। যতটা বাহ্বাস্ফোট করেন, ততটা শক্তি বসুষেনের নেই। এদিকে কুরুরাজ্যকে প্রতিস্পর্ধা যদি কোনও রাজ্য করতে পারে, তা পাঞ্চাল, যদিও পাঞ্চাল এখন বিভক্ত। যাজ্ঞসেনীর অপমানে পাঞ্চালরাজের চক্ষে ক্রোধের অগ্নি সতত প্রজ্জলিত। আর যাদবরা? যাদবগণ দ্বিধাবিভক্ত। আর যাদবশ্রেষ্ঠ কেশব অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও রণকৌশলী। তদুপরি তিনি অর্জুনের শ্যালক। ত্রিগর্তরাজ সুশর্ম্মা তাদের পক্ষে আছেন বটে, তিনি তার শক্তি পরীক্ষিত নয়। শাল্বরাজের আক্রমণে দ্বারাবতী প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে। যদিও কৃষ্ণ অতিকষ্টে শাল্বরাজকে পরাজিত ও নিহত করেছেন, তবু যুদ্ধে যাদবদের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কৃষ্ণ ব্যতীত সকল যাদবগণ শ্বাল্বের কাছে পরাজিত হয়েছেন। ভানুমতীর চোখের সামনে তার কন্যাটি বড় হয়ে গেলো। সদ্য প্রস্ফুটিত মল্লিকা পুষ্পের ন্যায় বালিকা লক্ষণা কুরুপ্রাসাদের অন্দরে ছুটে বেড়ায়। সকলের নয়নের মণি সে। কুরুপ্রাসাদের দুঃখ, অশান্তি, অসূয়া তাকে স্পর্শ করে না। সেই কন্যা একদিন স্বামীগৃহে চলে যাবে, ভাবতেই ভানুমতীর কান্না পায়। তার সমস্ত সুখের সবটুকু এখন লক্ষণা। নিজের ইচ্ছামত যত্নে লক্ষণাকে গড়ে তুলেছেন ভানুমতী। তাকে নৃত্যের শিক্ষা দিয়েছেন, মল্লযুদ্ধেরও। যোদ্ধাকে তো নৃত্য শিক্ষা করতেই হয়, তার যুদ্ধের প্রকরণ হিসাবে। নৃত্যশিল্প জানে না, এমন কেউ সুযোদ্ধা হতে পারে না। ভানুমতী শুনেছেন, মধ্যমপান্ডব পার্থ একজন সুনিপুণ নৃত্যশিল্পী। তাই পার্থ একজন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। ভানুমতীর মনোগত ইচ্ছা, একদিন নৃত্যে পার্থকে প্রতিস্পর্ধা জানাবেন। ভেবেই হেসে ফেলেন ভানুমতী। আর্য সুযোধন নৃত্য জানেন না! শুধু শক্তি দিয়ে যুদ্ধে হয় না, ভানুমতী ভাবেন। দুর্যোধন তার পুত্রী লক্ষণার স্বয়ম্বর আয়োজন করলেন। কুরুবংশের কন্যার পাণিপ্রার্থী অনেকেই সেই স্বয়ম্বরে এসেছেন। যাদবরাও এসেছেন সদলবলে। সে এক বিশাল আয়োজন। যেমন হয়, অতবর মহাজার দৌহিত্রীর স্বয়ম্বর। হস্তিনাপুরে তিল ধারনের স্থান নেই। দুঃশাসন, বিবিংশতি প্রভৃতি কুরুরাজকুমারগণ সমস্ত তদারক করছেন। স্বয়ম্বরের জন্য একটি নূতন সভাস্থলই নির্মিত হয়েছে। কিন্তু স্বয়ম্বরের দিন এক অঘটন ঘটল। কৃষ্ণপুত্র শাম্ব সভাস্থল থেকেই লক্ষণাকে অপহরণ করলেন। দুর্যোধন ক্রোধে কাঁপতে লাগলেন। কুরুবৃদ্ধগণ স্তম্ভিত। কৃষ্ণ, বলরাম ইত্যাদি যাদব প্রমুখ লজ্জিতবদন। হস্তিনাপুরের সীমানা অতিক্রমের পূর্বেই শাম্ব ধরা পড়ে গেলেন। এবং সেই গণ্ডগোলের মধ্যেই লক্ষণার থেকে তাকে বিযুক্ত করে কারান্তরালে ক্ষেপণ করা হল। শাম্বের কারাবাসে যাদবরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। বহু বৎসর সন্তানহীনা থাকার পর কৃষ্ণের অনুরোধের শিবের প্রসাদে রাজ্ঞী জাম্ববতীর একটি অনিন্দ্যকান্তি পুত্রলাভ হয়। সেই পুত্রটিই শাম্ব। শাম্ব আবার তার জ্যেষ্ঠতাত বলরামের বড় প্রিয়পাত্র। শাম্বের কারাবাসে রুষ্ট হলেন তিনি। তিনি কুরুসভায় ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন শাম্বকে মুক্তি দিতে। দুর্যোধন নতমস্তকে তার অস্ত্রগুরুর আদেশ মেনে নিলেন। লক্ষণার পুনর্বার স্বয়ম্বরের স্থির হল। অন্তঃপুরে দুর্যোধনের মুখোমুখি হলেন দেবী ভানুমতী। “আর্য সুযোধন! আপনি কি আমাকে হরণ করা বিস্মৃত হয়েছেন? কুমার শাম্ব স্বয়ং বাসুদেব কৃষ্ণের পুত্র। সুদর্শন, তার পিতা মাধবের মতই। আজ যাদবরা অপমানিত হয়ে শাম্বের মুক্তিভিক্ষা করে বিদায় নিলে, তাহলে কি হস্তিনাপুরের মঙ্গলসাধন হবে? আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি স্বয়ং শাম্বের সাথে লক্ষণার বিবাহ দিন। কেশব স্বয়ং আপনার বৈবাহিক হলে আপনার রাজনৈতিক লাভও হবে। আর অন্যান্য যাদবগণও সন্তুষ্ট হবেন। মনে রাখবেন, বাসুদেব অত্যন্ত বিচক্ষন ব্যক্তি, তাকে বৈবাহিক হিসাবে পেলে আপনি শুধু একজন শক্তিশালী মিত্র লাভই করবেন না, পাণ্ডবদের বলহীনও করবেন!” ভানুমতীর দিকে তাকিয়ে রইলেন দুর্যোধন। তারপর তাকে আলিঙ্গনপাশে যুক্ত করে বললেন, “যথা আজ্ঞা দেবী!” সকলকে আশ্চর্য করে দুর্যোধন সভামধ্যে বাসুদেব ও বলদেবের সম্মুখে শাম্ব ও লক্ষণার বিবাহ প্রস্তাব রাখলেন। সকলে সমস্বরে আনন্দের সাথে অনুমোদন করলেন শাম্বের সাথে লক্ষনারবিবাহের প্রস্তাব। ভীষ্ম, বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী প্রমুখও সকলেই দুর্যোধনকে আশীর্বাদ করলেন। তারপর ব্যাপৃত হলেন বিবাহের আয়োজনে। বড় ধুমধাম করে লক্ষণার বিবাহ অনুষ্ঠিত হল। হাতি, ঘোড়া, অশ্বেতর, গো মহিষের শত শত শকট বোঝাই করে যাদবগণ কন্যাপণের ধনরাশি নিয়ে চললেন দ্বারকায়। যুদ্ধে ধ্বংসপ্রায় দ্বারকার এখন অর্থের বড় প্রয়োজন। লক্ষণা বিদায় দিয়ে বড় ভেঙে পড়লেন দেবী ভানুমতী। এতদিন যেন লক্ষণার জন্যই তিনি বাঁচতেন! দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার পর থেকেই নিজের অন্তঃপুর থেকে অক্ষ বিদায় দিয়েছেন। এখন নৃত্যচর্চাও বন্ধ হয়ে গেলো। কার জন্যে আর ওসব করবেন?
অক্ষক্রীড়ায় পরাজিত পাণ্ডবেরা সর্বস্ব হারিয়ে বনে গেলেন। ইন্দ্রপ্রস্থের রাজকীয় সুখ বঞ্চিত হলেন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের দ্যূতাসক্তির কারণে, দুবার। প্রথমে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা আর দ্বিতীয়বারে ধনহীন, রাজ্যহীন হয়ে পথের ভিখারি হলেন পাণ্ডবগণ। এবার মাতা কুন্তী রইলেন বিদুরের আশ্রয়ে। পাঞ্চালীসহ পঞ্চপাণ্ডব ঘুরে বেড়ান বন থেকে বনান্তরে। অনার্য জাতিগুলির সাথে তাদের সখ্য হয়। তারা সকলেই পাণ্ডবদের প্রীতির চক্ষে দেখেন। তাদের সাথে প্রচ্ছন্নভাবে যোগাযোগ রাখেন যাদবেরা, বিশেষ করে কৃষ্ণ। এইভাবে প্রায় বারো বছর কেটে যায়। এবার এক বছর অজ্ঞাতবাসের পালা। পাণ্ডবেরা তখন মৎস্যরাজ্যের উপান্তে। তারা পরিকল্পনা করলেন, মৎস্যরাজ্যে ছদ্মবেশে অবস্থান করবেন একবছর। কুরু ও মৎস্য, এই দুই রাজ্যের মধ্যে বৈরিভাব ছিলই, বিশেষত গোসম্পদে মৎস্যরাজ্য অধিক সমৃদ্ধ ছিল। মৎস্যরাজ বিরাটের আরেকটি শক্তির কারণ ছিল তার সেনাদল এবং তার সেনাপতি কীচক। সেনাপতি কীচককে সর্বদা ঘিরে থাকতো তার বিশেষ রক্ষীদল। সংখ্যায় তারা একশত পাঁচ জন। লোকে তাদের সম্ভ্রম করে বলত উপকীচক। ছদ্মবেশের সাথে পাণ্ডবেরা নিলেন ছদ্মনাম ও ছদ্মপেশা। এত দুর্ভাগ্যেও যুধিষ্ঠির অক্ষকে ছাড়তে পারেন নি। তিনি হলেন মৎস্যরাজ বিরাটের অক্ষক্রীড়াসঙ্গী কঙ্ক। বৃকোদর হলেন রাজার পাকশালার পাচক বল্লব। নকুল ভার নিলেন গো রক্ষণাবেক্ষণে, নাম তার অরিষ্টনেমি। সহদেব হলেন অশ্বশালার প্রধান অশ্বপাল, তিনি নাম গ্রহণ করলেন গ্রন্থিক। অর্জুন আগেই নৃত্যে পারঙ্গম ছিলেন। তারপর গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন তাকে আরও পাঠ দিয়েছেন। অর্জুন এখন একজন নৃত্যবিশারদ। রাজবাড়িতে নৃত্য শিখবেন রাজকন্যা কিশোরী উত্তরা। রাজ অন্তঃপুরে পুরুষ শিল্পীর প্রবেশ অসম্ভব। তাই অর্জুন নারীর রূপ ধরলেন আর নাম নিলেন বৃহন্নলা। আর দ্রৌপদী? অরণ্যবাসে তিনি কৃশ, মেদহীনা, কৃষ্ণা হলেও রূপ তার অগ্নির প্রায়। তিনি পরিচারিকা হলেন রাজবাড়ীর। তাকে সকলে সৈরিন্ধ্রী নামেই ডাকে। এইপ্রকার রূপবতী পরিচারিকা সকলের অভিপ্রেত। তার দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে তাজিয়ে থাকেন কীচক। মহাশক্তিশালী কীচক। বিশেষকরে সায়ংকালে সুরাপানের সময়। সৈরিন্ধ্রী প্রয়াস করেন কীচককে প্রতিহত করবার। কত ছলনা করেন, কিন্তু সকলই ব্যর্থ হয়ে যায়। অগত্যা! ভীমের শরীরে নাগরক্ত প্রবহমান। নারীকে শুধু যৌনদাসী ভাবেন না অনার্যেরা, তাদের কাছে নারী সম্পদ নয়, পণ্য নয়, নারী তাদের কাছে শ্রদ্ধার আসনে আসীন। পাঞ্চালী তার দুর্দশার কথা বললেন বল্লবকে। বল্লবের নাগরক্ত উদ্বেলিত হল। পরিকল্পনা করলেন সৈরিন্ধ্রী। রাজকীয় সুরাশালালায় সৈরিন্ধ্রী আমন্ত্রণ করলেন একাকী কীচককে। গোপনে সেখানে উপস্থিত ছিলেন ভীম। প্রবল দুই যোদ্ধার মল্লযুদ্ধ হল সেই নির্জন মদিরালয়ে। মত্ত কীচক ভীমের হাতে নিহত হলেন। ছিন্নকন্ঠ মৃত কীচকের হাতে তখনও ধরা ছিল সৈরিন্ধ্রীর হাত। বল্লব নিশব্দে পলায়ন করলেন। সৈরিন্ধ্রী জানালেন অদৃশ্য যক্ষেরা মহামান্য কীচককে হত্যা করেছেন। রাজগৃহে হাহাকার। শোক করলেন বিরাট, রাজ্ঞী সুদেষ্ণা। কঙ্ক আর অন্য সকলে। মৃত্যুর সময়ে সৈরিন্ধ্রীর হাত ধরেছিলেন কীচক, তাই উপকীচকেরা দাবী করল, মহাবাহু কীচকের সাথে সহমরণ হবে সৈরিন্ধ্রীর। বাধা দেবার প্রশ্নই ওঠে না। সৈরিন্ধ্রী চললেন কীচকের সাথে সহমরণে। অতি গোপনে ভীমসেন তাদের পিছু নিলেন। জনমাননশুন্য ভয়াল শ্মশান। অন্ধকার রাতে চারিদিকে শুধু শাপদের তীক্ষ্ণ চিৎকার। মহাবলী ভীম অতর্কিতে আক্রমণ করলেন সেই শোকগ্রস্ত আকন্ঠ মদ্যপ একশত পাঁচজন উপকীচককে। তারা সকলেই নিহত হল। বল্লব সৈরিন্ধ্রীকে উদ্ধার করে ফিরে এলেন রাজনিবাসে। কীচকের মৃত্যু সংবাদ ক্রমে পৌঁছল হস্তিনাপুরে। দুর্যোধনের কানেও উঠল সেই সংবাদ। সংবাদ পেলেন ত্রিগর্তের রাজা সুশর্ম্মাও। দুর্যোধন দূত পাঠিয়ে আমন্ত্রণ করলেন তাকে। কৌরবদের লোভ ছিল মৎস্যরাজ্যের ঈর্ষনীয় গোসম্পদের প্রতি। ত্রিগর্তরাজের সাথে পরামর্শ হল, তিনি অতর্কিতে মৎস্যরাজ্য আক্রমণ করবেন। সহজেই বিরাট পরাজিত হবেন, কারণ, কোনও এক রহস্যময় গন্ধর্বের হাতে মৎস্য সেনাপতি কীচক নিহত হয়েছেন। এক্ষণে বিরাট নিতান্ত হীনবল। সুশর্মা গো অপহরণ করবার পশ্চাতে কৌরবগণ তা গ্রহণ করবেন। অতীতে ত্রিগর্তরাজ একবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কীচকের কাছে তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। তার প্রতিশোধ নেবার সময় এসেছে। সুশর্ম্মা মৎস্যরাজ্য আক্রমণ করলেন। অতর্কিত আক্রমণে বিরাটের সৈন্যরা পশ্চাদপসরণ করল। বিশাল গোসম্পদ অধিকার করে যখন তার সৈন্যরা ফিরে যাবেন, তখন পাণ্ডবেরা হস্তক্ষেপ করলেন। বিরাটের তরুণ পুত্র উত্তর হলেন নূতন সেনাপতি। যুদ্ধের শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা তার নেই। রাজঅন্তঃপুরের দাসী সৈরিন্ধ্রী বললেন, বৃহন্নলাকে সারথ্যে বরণ করে নিতে। সৈরিন্ধ্রীর প্রস্তাবে রাজকুমার উত্তর অবাক হলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৃহন্নলাকে সারথিও করলেন। বৃহন্নলারূপী অর্জুন সহজেই সুশর্ম্মাকে পর্যদুস্ত করলেন। এবার সরাসরি যুদ্ধে নামলেন ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, কর্ণসহ দুর্যোধন। বিশাল তাদের সেনাবাহিনী। অর্জুনের প্রতাপে একে একে সকলেই পলায়ন করলেন। তারমধ্যে কবচকুন্ডলসহ কর্ণ দু দুবার অর্জুনের নিকট পরাভূত হয়ে পালিয়ে বাঁচলেন। সমস্ত গো সম্পদ পুনরায় গ্রহণ করে অর্জুন ফিরে এলেন মৎস্যরাজ বিরাটের সম্মুখে। যখন যুদ্ধ চলছে, তখন উদ্বেগে বিরাট তার সোনার অক্ষ ছুঁড়ে মেরেছিলেন কঙ্কের কপালে। কঙ্কের কপাল বাহিত হয়ে রক্তের ধারা তার বক্ষ স্পর্শ করল। সেই ক্ষতচিহ্ন ললাটে নিয়ে তারপর কঙ্ক আর কোনোদিন পাশা খেলেন নি। গননা করে দেখা গেলো পাণ্ডবদের এক বছরের অজ্ঞাতবাস সমাপ্ত হয়েছে। সকলে আত্মপ্রকাশ করলেন। মৎস্যরাজ বিরাট স্বীয় কন্যা উত্তরাকে অর্জুনের হাতে দিতে চাইলেন। অর্জুন বললেন, “মহারাজ! রাজ অন্তঃপুরে দেবী সুদেষ্ণা আমাকে বিশ্বাস করে কল্যানীয়া উত্তরার নৃত্যশিক্ষার ভার ন্যস্ত করেছিলেন। আর আমি আপন পুত্রীস্নেহে রাজনন্দিনী উত্তরাকে শিক্ষা দান করেছি। এই অবস্থায় উত্তরার পাণিগ্রহণ আমার পক্ষে একান্ত অসমীচীন হবে। তবে আমার একটি প্রস্তাব মহারাজ বিবেচনা করে দেখতা পারেন। আমি পুত্র অভিমন্যুর সাথে উত্তরার বিবাহ দিতে ইচ্ছুক!” বিরাট আনন্দে আপ্লুত হলেন। দ্বারকায় সংবাদ গেলো। তার কিছুদিন পরে অভিমন্যু আর উত্তরা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন।
হস্তিনাপুরের আকাশে এক টুকরো কালো মেঘের ছায়া ঘনিয়েছে। সর্বাপেক্ষা চিন্তিত যুবরাজ দুর্যোধন। ভীষ্ম, বিদূর, ধৃতরাষ্ট্র সকলেই চিন্তিত। কিন্তু তাদের চিন্তা ভিন্ন ভিন্ন। অভিমন্যুর বিবাহের পর আর্যাবর্তের প্রধান রাজ্যগুলি এখন পাণ্ডবদের মিত্র। পাঞ্চাল, মৎস্য তো তাদের সহযোগী। যাদবরাও তাদের বিরুদ্ধে তো নয়ই বরং পাণ্ডবদের প্রতি একটু অধিক বন্ধুভাবাপন্ন। সুরালয়ে উপবেশিত আছেন দুর্যোধন। তার কপালে চিন্তার ছায়া। মদিরাপাত্র অধরা। প্রদীপের শিখা কম্পমান। বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাস শেষে পাণ্ডবেরা এখন অধিক শক্তিমান। তারা এখন অর্ধেক কুরুরাজ্য দাবী করবেন, আর তাদের এ দাবী ন্যায়সঙ্গত। এই অভিমত মহামন্ত্রী বিদূরের। তিনি শান্তিতে রাজ্যভাগের পক্ষে। কুরুরাজ্যে দ্বিধাবভক্ত হলেও, কৌরব ও পাণ্ডবেরা উভয়েই ভ্রাতা। অতীতের সমস্ত তিক্ততা ভুলে উভয়েই শান্তিতে রাজত্ব করুন। তাতে কুরুবংশের মঙ্গল। বিদূরের মনে আর একটি সুপ্ত বাসনা, তার ঔরসজাত পুত্র যুধিষ্ঠির অন্তত সিংহাসনে বসুক। নীরবে শুনছিলেন রাজা ধৃতরাষ্ট্র। মুখ খুললেন তাত ভীষ্ম। “বিষয়টি যত সরল মনে করছ, ততটা সরল বোধ হয় নয়। পুত্র ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠভ্রাতা হয়েও শুধু অন্ধ বলে সিংহাসন বসতে পারেন নি। পাণ্ডু রাজ সিংহাসনে বসেছিলেন। তার মৃত্যুর পর ধৃতরাষ্ট্র রাজা হয়েছেন। তার পুত্র যুধিষ্ঠির হবেন কি বর্তমান রাজার পুত্র দুর্যোধন রাজা হবেন, এ প্রশ্নের নিষ্পত্তি কিন্তু এখনও হয় নি। দ্বিতীয়ত আমি মনে করি কুরুরাজ্যের বিভাজন হলে, যতই দুই রাজ্যের মধ্যে সৌহার্দ্য থাকুক না কেন, শেষ পর্যন্ত হস্তিনাপুর দুর্বল হবেই। দুপক্ষই একে অপরের কারণে সর্বদা চিন্তিত থাকবে। আর তাছাড়া মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র প্রাজ্ঞ রাজা, তিনি আমাদের কথা মান্য করেন। কিন্তু দুর্যোধন রাজা হলে, সে আমাদের কথা মান্য নাও করতে পারে। তাছাড়া আর্যাবর্তের রাজনৈতিক অবস্থাও যথেষ্ট সঙ্কুল। বেদবাদী ও বৈষ্ণবদের মধ্যে বিরোধ এখন প্রকাশ্যে আসে নি বটে, তবে তা বিরোধের আকার নিতে শুধু সময়ের অপেক্ষা!” “দুর্যোধন ও যুধিষ্ঠিরের মধ্যে সংঘাত হলে আপনি কোন পক্ষ নেবেন, তাত?” মুখ খুললেন রাজা ধৃতরাষ্ট্র। প্রশ্নের আকস্মিকতায় একটু থমকে গেলেন গাঙ্গেয় ভীষ্ম। তিনি কোন পক্ষে যাবেন? সত্যিই তো কোনোদিন এই প্রশ্নটার মুখোমুখি হন নি তিনি। যখনি সমস্যা সামনে এসেছে, তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন। ভীষ্ম নীরব রইলেন। একই প্রশ্ন বিদূরকে করলেন ধৃতরাষ্ট্র, “আপনি ভ্রাতা বিদূর?” বিদূর চমকে উঠলেন। তিনি কোনপক্ষে যাবেন? পুত্র যুধিষ্ঠিরের পক্ষে না কি দুর্যোধনের পক্ষে? তিনি ভাবলেন। তারপর বললেন, “মহারাজ, আমি হস্তিনাপুরের মহামন্ত্রী। আমি হস্তিনাপুরের সিংহাসনের প্রতি দায়বদ্ধ। আর আপনি এখনও হস্তিনাপুরের সিংহাসনে, অবিভক্ত কুরুরাজ্যের মহারাজাধিরাজ। তাই আমি আপনার পক্ষেই থাকব!” “গুরু দ্রোণ? আপনিও কি দুর্যোধনের পক্ষে?” “মহারাজ! এ কথা ঠিক অর্জুনের সামর্থে আমি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে পরাজিত করেছি। অর্ধেক পাঞ্চাল আমার অধিগত। কিন্তু মনে মনে আমি জানি আমি ব্রাহ্মণ, শিক্ষক। রাজা হওয়া আমার সাজে না। যেদিন অপমানিত আমি আপনার আশ্রয় ভিক্ষা করেছিলাম, সে দিন আমাকে আশ্রয় দিয়ে কুরুকুমারদের অস্ত্রশিক্ষার ভার দিয়েছিলেন। সেদিনই আমি মহারাজের অন্নদাস হয়ে গিয়েছি। পার্থ আমার প্রিয় শিষ্য তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি কুরু সিংহাসনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, এ ব্রাহ্মণের অঙ্গীকার।“ সুরালয়ের রক্ষীরা সসম্ভ্রমে পথ মুক্ত করল। নিঃশব্দে প্রবেশ করলেন রাণী ভানুমতী। দুর্যোধন তাকে দেখে আশ্চর্য হলেন। তিনি পিছন ফিরে তাকালেন, রক্ষীরা বিদায় নিল। “দেবী হঠাৎ এস্থলে?” “আর্য সুযোধন! আপনি আজকাল সুরালয়ে সায়ংকাল অতিবাহিত করেন। অগত্যা এখানে আসতে হল!” দুর্যোধন প্রমাদ গনলেন, ভানুমতী নিশ্চিত কারণ ছাড়া এত গম্ভীর হন না। কিন্তু বিষয়টি কি? দুর্যোধন ভাবলেন। “আর্য সুযোধন, যে বীর আমাকে হরণ করে এনেছিলেন, যে বীর প্রজাপালক, যে বীর পররাজ্যলোলুপ নন, যে বীর আপন স্নেহচ্ছায়ায় ভ্রাতেদের রক্ষা করেন, যে বীর মাতা ও পিতাকে দেবতার ন্যায় শ্রদ্ধা করেন, সেই বীর সুযোধন আজ কোথায়? আরেকজন মানুষ, যিনি ক্রুর, ক্ষমতালিপ্সু, সর্বাপেক্ষা যিনি নারী নিপীড়ক, সেই মানুষটি আমার অপরিচিত। কল্যাণী যাজ্ঞসেনীকে যে অসম্মান আপনি করেছেন, বলুন আর্য সুযোধন তা কি বীরোচিত? ক্ষত্রিয়চিত? আপনারা পূর্ণ রাজসভায় সকলে মিলে এক অসহায়া নারীকে ধ্বস্ত করলেন, বিবস্ত্র করলেন, তা কি লজ্জার নয়? আপনি কোনও পাণ্ডব ভ্রাতাকে আঘাত করেন নি, ভ্রাতৃজায়া, এক নারীকে লাঞ্ছনা করেছেন। আমার স্বামী এ হীন কর্ম করতে পারেন ভেবে আমি লজ্জায় মাটিতে মিশে গেছি। স্বয়ং বাসুদেব এসে পাঞ্চালীকে রক্ষা না করলে, তার পরিণতি কি হতো, তা ভাবলে আমার শরীর অবশ হয়ে আসে। দেবর দুঃশাসন, আর্য কর্ণ, সকলে সেদিন একসাথে ধর্ম বিস্মৃত হয়েছিলেন। এক পশু আপনাকে গ্রাস করেছিল!” “দেবী ভানুমতী!” চিৎকার করে উঠলেন দুর্যোধন। “আমাকেও কি লাঞ্ছিত করবেন আর্য? কৃষ্ণার মতো? বিবস্ত্র করবেন আপনাকে প্রশ্ন করার জন্য?” “এখনি এ স্থান ত্যাগ করুন রাজ্ঞী ভানুমতী!” দুর্যোধন যেন অনুনয় করলেন। “আপনার কাছে অনুমতি চাইতে এসেছি আর্য সুযোধন। আমার কাজ শেষ হয়েছে। পুত্র বড় হয়ে গেছে, কন্যার বিবাহ হয়ে গেছে। কলিঙ্গের জন্য মনটা বড় উতলা হয়েছে। পিতার জন্য, মাতার জন্য, কলিঙ্গের গাছপালা, মানুষ, সমুদ্রের জন্য বড় ব্যাকুল হয়েছি আমি। অনুমতি করুন আর্য সুযোধন, আমি কলিঙ্গে যাই একবার!” দুর্যোধন নীরবে বসে থাকেন। উন্মাদের মতো সুরা পান করে যান। যন্ত্রণায় তার মুখমণ্ডল বিকৃত হয়ে আসে। দেবী ভানুমতী নিঃশব্দে বিদায় নেন।

আসন্ন যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে অর্জুন এলে্ন দ্বারকায়, প্রিয় সখা মাধবের কাছে পরামর্শের অভিলাষে। কৃষ্ণ বললেন, "পার্থ, এখন থেকে আমাদের সকল কথা গোপনীয় হবে। এমনকি সখী যাজ্ঞসেনীও জানবেন না। নিজেদের শক্তি সম্যক জানতে হবে, আর অবগত হতে হবে অপরপক্ষের শক্তির পুখানুপুঙ্খ্য। যুদ্ধে যা সবচেয়ে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, তা হল রণকৌশল। যুদ্ধ মানেই হল সম্প্রীতির শেষ, বল দ্বারা প্রশ্নের নিষ্পত্তি। ধর্মের কূট নিষ্পত্তি হয় আলোচনা সভায়, যুদ্ধে নয়। তাই কোনও যুদ্ধই ধর্মযুদ্ধ হয় না, যুদ্ধ শুধু স্বার্থযুদ্ধই!" "তাহলে কি আমরা হস্তিনাপুর আক্রমণ করব ? বিদ্যুৎগতিতে হস্তিনাপুর জয় করে তাত ধৃতরাষ্ট্রকে বাধ্য করব ইন্দ্রপ্রস্থের অধিকার দানে?" বললেন ফাল্গুনি। "‘তুমি কি মহামন্ত্রি বিদুরকে মূর্খ ভাবো? তাঁর গুপ্তপুরুষরা হস্তিনাপুর সুরক্ষিত রেখেছে, আর তা ছাড়া হস্তিনাপুর আক্রমণ অত্যন্ত অবিবেচকের কাজ হবে, তার প্রত্যাঘাত হবে মারাত্মক। দুর্যোধন আক্রান্তের সহানুভূতি পাবেন সমস্ত রাজাদের কাছে। এমনকি যাদবদের কাছেও। সকলে পাঞ্চালদের দোষ দেবে হস্তিনাপুর আক্রমণ করে পররাজ্য হস্তগত করার জন্য!" "তাহলে কর্তব্য কি, বাসুদেব?" অর্জুনের জিজ্ঞাসা। "‘রণক্ষেত্র নির্বাচন!" স্মিত হাসেন বাসুদেব। " হস্তিনাপুরকে নিজের রাজ্যের বাইরে টেনে আনতে হবে। যেখানে যুদ্ধ করার সকল সুবিধা তোমরা পাবে। যেখানে চারপাশ ঘিরে তোমাদের মিত্র বা নিরপেক্ষরা অবস্থিত। যে স্থানের সাথে তোমরা অধিক পরিচিত, কৌরবেরা নন। যেখানে ভূপ্রকৃতি অসমান, বিশাল বাহিনীর পক্ষে অসুবিধাজনক, এমন স্থান!" বাসুদেব থামেন। "কিন্তু কোন সেই স্থান, সখা?" পার্থ আর স্থৈর্য চেপে রাখতে পারেন না। " যমুনার তীরে, পাঞ্চালের দক্ষিণ সীমায়, কুরুক্ষেত্রে!" অর্জুনের প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত করেন বাসুদেব। সভা বসেছে হস্তিনাপুরে। দুর্যোধন উঠে দাঁড়ালেন, "মহারাজ! তাত ভীষ্ম! মহামন্ত্রী বিদুর! আপানারা হস্তিনাপুরের রক্ষক। আপনারা বুদ্ধিমান ও প্রাজ্ঞ! আপনারা উপদেশ করুন, আসন্ন যুদ্ধ আমরা কিভাবে করব?" বিদুর বললেন, "যুদ্ধের পাঁচটি আবশ্যিক উপাদান, অর্থ, মিত্র, সৈন্য, শস্ত্র ও কৌশল। এগুলি একত্রীকরণ, বিন্যাস আর প্রয়োগ জয়কে নিশ্চিত করে। এসকলের সব কয়টিতে প্রযত্নবান হওয়া আবশ্যক!" মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বললেন, "অর্থের বিষয়টি বিদুর দেখবেন, সৈন্য, শস্ত্র আর কৌশলের ভার অর্পণ করলাম তাত ভীষ্মকে আর মিত্র সম্পর্কিত দায়িত্ব যুবরাজ দুর্যোধনের। তাকে সহায়তা করবেন গান্ধার যুবরাজ শকুনি এবং অঙ্গরাজ কর্ণ। তাত ভীষ্মকে সহায়তা করবেন গুরু দ্রোণ ও আচার্য কৃপ!" নীরবতা ভাঙলেন গাঙ্গেয়, বললেন, "বেশ, আমার উপদেশ, দুর্যোধনের উচিত বাসুদেবের শরণ নেওয়া। তিনি তার বৈবাহিকও বটেন আবার বৈষ্ণবদিগের মধ্যে অনন্ত প্রভাবশালী!" "মহারাজ যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমি একটি কথা নিবেদন করি!" বললেন কর্ণ। মহারাজ অনুমতি দিলে কর্ণ বলেন, "সবার আগে আমাদের মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের উপদেশ নেওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া তিনি সর্বমান্য!" ভীষ্ম ও বিদুর উভয়েই কর্ণকে সমর্থন করলেন। তখন দুর্যোধন উঠে দাঁড়ালেন, সভাকে চকিত করে প্রশ্ন করলেন, "যুদ্ধ কোথায় হবে? কারা শুরু করবে? কারা প্রতি আক্রমণ করবে?" সকলে প্রশ্নের আকস্মিকতায় চুপ করে রইলেন, শুধু শকুনি একটু বেশি চমকিত হলেন। আশ্রমে বসে আছেন মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। তাঁর সামনে বিদুর, দুর্যোধন আর শল্য। মহর্ষি সকলের কুশল জিজ্ঞাসা করছেন, এমন সময়ে সেখানে উপস্থিত হলেন যুধিষ্ঠির আর কৃষ্ণ। বেদব্যাস তাদেরকেও কুশল প্রশ্ন করলেন। তারপর তাদের আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। সকলেই তাঁর আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন, এক বাসুদেব ছাড়া। কিছুক্ষণ নিরুত্তর থেকে ব্যাস বললেন, "এই যুদ্ধে কাউকেই আমি আশীর্বাদ করতে পারিনা। আশীর্বাদ বা অভিশাপে কেউ যুদ্ধে জয়ী বা বিজিত হন না; হন পুরুষার্থ দ্বারা। কিন্তু আমি গভীর দুর্লক্ষণ প্রত্যক্ষ করছি। আমি লক্ষ্য করছি সনাতন বৈদিক ধর্মের চরম বিপদ। আগত মাৎস্যন্যায়ের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। একমাত্র বাসুদেব পারেন এই দুর্বিপাক থেকে সকলকে রক্ষা করতে!" সকলে নিরুত্তর রইলেন। তখন বাসুদেব তিক্ত কন্ঠে বললেন, "মার্জনা চাইছি মহর্ষি, না, আমিও পারি না। যা ঘটবার তা ঘটতে দেওয়াই বিধেয়। নিয়তি কেন বাধ্যতে!" তারপর দুর্যোধন এলেন দ্বারকায় যাদব কূলের সাহায্য প্রার্থনায়। সেই সভা কৃষ্ণের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। কৃষ্ণ লক্ষ্য করলেন কেমন করে তার স্বপ্নের সাম্রাজ্য একটু একটু করে ভেঙ্গে পড়ছে। সেই সভায় অন্ধক, ভোজ, কুকুর বংশীয়রা কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করবার কথা ঘোষণা করলেন। বলরাম বললেন, এই অধর্মের যুদ্ধে তিনি পক্ষপাত শূন্য থাকবেন। শুধু সাত্যকি, প্রদ্যুম্ন, কুন্তিভোজ ঘোষণা করলেন, তারা পাণ্ডবদের সহায়তা করবেন। শেষে বাসুদেব বললেন যে তিনি যুদ্ধে অস্ত্রগ্রহন করবেন না। উভয়পক্ষেই বৈষ্ণবগণ আছেন, তাই তিনি যুদ্ধে অপারগ। তবে যেহেতু পান্ডবগন তাঁর প্রীতি ও শ্রদ্ধার পাত্র, তাই তিনি প্রয়োজনে তাদের মন্ত্রণা প্রদান করবেন। এবং তিনি সকল যাদবদের নিজ নিজ বিবেকানুসারে পক্ষ অবলম্বনের স্বাধীনতা দিলেন। পাণ্ডবদের সাহায্যে রইলেন পাঞ্চাল, বিরাট প্রমুখ ছয়টি রাজশক্তি। তার মধ্যে পাঞ্চালরাজ ও বিরাটরাজ দ্রুপদই প্রধান, কিন্তু তাদের মূল শক্তি হল নাগ, কিরাত, অসুর, জরা, গন্ধর্ব, কিন্নর, বানর ইত্যাদি অনার্য শক্তি। সহদেব এই যুদ্ধে পাণ্ডব সৈন্যের সেনাপত্য গ্রহনের জন্য রাজা দ্রুপদের নাম প্রস্তাব করলেন। কিন্তু অর্জুন পাঞ্চালদের সৈন্য সংখ্যার বিশালতা চিন্তা করে পাঞ্চাল যুবরাজ ধৃষ্টদ্যুম্নের নাম প্রস্তাব করলেন। কৃষ্ণ অন্যান্য সকলে তা অনুমোদন করলেন। আর তখনই বাসুদেবের পরামর্শে দ্রুত পাঞ্চালসেনা কুরুক্ষেত্র দখল করে নিলে, পাণ্ডবরা কৌরবদের যুদ্ধে আহ্বান করলেন। ভীষ্ম চিন্তাক্লিষ্ট হলেন। বিপুল সৈন্য বাহিনী কুরুক্ষেত্রের দিকে রওয়ানা হল ঘুরপথে, পাঞ্চাল রাজ্যকে পাশে রেখে, অর্ধবৃত্তাকারে দক্ষিণমুখে। কৌরবদের সেনাদলে কমবেশি ছত্রিশটি রাজবংশ। কিন্তু জরাসন্ধের আর শিশুপালের মৃত্যুর পর সকলেই হতোদ্যম। কৌরবদের অবস্থা আরও সঙ্গীন। যতই বাগাড়ম্বর করুন, দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি কোনও যুদ্ধই করেন নি বহুদিন। শুধু একবার ঘোষযাত্রায় বিরাটরাজের গোধন অপহরন করতে গিয়ে অর্জুনের কাছে বিপর্যস্ত হয়ে পলায়ন করেছিলেন। শকুনি সেই যে গান্ধারীর সাথে হস্তিনাপুরে এসেছিলেন, তারপর আর গান্ধারে ফিরে যাননি। শুধু হস্তিনাপুরের প্রাসাদে অলস জীবন কাটাতে আর নিজের গুরুত্ব জাহির করতে ধৃতরাষ্ট্র ও দুর্যোধনকে কুমন্ত্রণা দেওয়া ছাড়া তার আর কোনও কাজ ছিল না। কর্ণ কখনো উপঢৌকনে পাওয়া রাজ্য, অঙ্গে, যাননি। হস্তিনাপুরেই প্রতিপালিত হয়েছেন। তলায় তলায় হস্তিনাপুর রাজশক্তি ভঙ্গুর হয়ে উঠেছিল। হস্তিনাপুর পরিচালনা করতেন বিদুর আর ভীষ্ম। অথচ দুর্যোধন রাজা। সেইসব চিন্তা করে বাসুদেব দেখলেন পাণ্ডবরাই শেষ পর্যন্ত জিতবেন, যদিও তাদের বহু মুল্য দিতে হবে। কিন্তু তাঁকে ভাবাচ্ছিল যাদবদের এই দুপক্ষে ভাগ হয়ে যাওয়া। এক কুয়াশামাখা সকালে, মকর সংক্রান্তির কিছু আগে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হল। শোনা যায়, আঠার দিন এই যুদ্ধ চলেছিল। প্রথম দশদিন প্রকৃতপক্ষে তেমন যুদ্ধ হয় নি। ভীষ্ম যুদ্ধ থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। নিজের জীবন দিয়েও তিনি সফল হলেন না। তার মৃত্যুর পর ভাল রকম ক্ষয়ক্ষতি হয় উভয় পক্ষের। আহত ভীষ্ম মকর সংক্রান্তির পরের দিন উত্তরায়ন শুরু হলে, দেহত্যাগ করলেন। বাসুদেবের প্রতিস্পর্ধি শেষ বৈষ্ণব এভাবেই চলে গেলেন। ভীষ্মের মৃত্যুর পর কুরুক্ষেত্রে আর কোনও নির্দয়তার বাধা রইল না। একে একে দুই পক্ষের প্রায় সমস্ত বীর যোদ্ধাগণ শমনভবনে গমন করলেন। এই মহাযুদ্ধে কৌরব ও পান্ডবেরা জ্ঞাতি শূন্য হলেন। পান্ডবপক্ষে অভিমন্যুসহ তারা সকল পুত্র হারালেন। কিন্তু তখনও বিনাশের কিছু বাকি ছিল। নির্জন দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে দুর্যোধন আত্মগোপন করে ছিলেন। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন, তাই হয়েছে। অভিশপ্ত কুরুবংশ ধ্বংস্ প্রায়। দুর্যোধন কি মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছিলেন ভারতবর্ষের ভবিতব্য? বনবাসীদের সহায়তায় আর কৃষ্ণের কারণে দুর্যোধনের খোঁজ পেলেন পান্ডবেরা। আহত দুর্যোধনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন ভীমসেন। দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার প্রতিশোধ যে এখনও বাকি! তীর্থ যাত্রা শেষে বলরাম সেখানে উপস্থিত হলেন। গদাযুদ্ধ শুরু হল। কৃষ্ণ ভীমকে ইঙ্গিত করলেন দুর্যোধনের জানুতে আঘাত করবার জন্য। যা ছিল সেইকালের দ্বন্দ্বযুদ্ধে একেবারেই অচিন্তনীয়! বৃকোদর তাই করলেন। ক্রুদ্ধ বলরাম ভীমসেনকে শাস্তি দিতে উদ্যত হলেন। মাধব তাকে কোনক্রমে নিরস্ত করলেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির নতশিরে তা দেখলেন। মুখে এক টুকরো হাসি নিয়ে দুর্যোধন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে লাগলেন। মৃত্যু গ্রাস করার পূর্বে তিনি একবার আকাশের দিকে হাত তুললেন, অন্তিম আশায়। তিনি কি কাউকে খুজছিলেন? কলিঙ্গে তখন রাত্রি। দেবী ভানুমতী গবাক্ষ দিয়ে চাঁদের আলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। দেখতে দেখতে চাঁদ ডুবে যেতে লাগল। ভানুমতী দেখলেন, দূরে সমুদের মধ্যে এক ছায়ামূর্তি। ভানুমতী চিনতে পারলেন সেই ছায়ামূর্তিকে। দ্রুত দেবী ভানুমতী বেশ পরিবর্তন করে নিলেন। পরনে নীলাম্বরী শাটিকা, শ্বেত কাঁচুলি। কেশবন্ধনে পরিধান করলেন লাজসজ্জা। গলায় মুক্তার হার, কোমরে সোনার কোমরবন্ধ, পায়ে নূপুর। হাতে চম্পকের মালা। দ্রুতপদে চলেছেন কৌরবকূলবধু চারুহাসিনী। দ্বারীরা সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়ায়। ভানুমতী চলেছেন সমুদ্রের দিকে। তার মুখমণ্ডলে নববধুর ব্রীড়া। লক্ষ্য করেছেন সেই পুরুষ ঢেউএর মাথায় চড়ে তার দিকে দুহাত বাড়িয়ে আসছেন। ধীরে ধীরে জলে পা দিলেন কলিঙ্গরাজদুহিতা ভানুমতী। ঢেউ তখন প্রকাণ্ড উঁচু হয়ে উঠেছে। তার শীর্ষে তার প্রিয় আর্য সুযোধন। এবার তার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন ভানুমতী। চম্পকের মালাখানি দুহাতে তুলে ধরলেন তিনি, তার সুযোধনের গলায় পরিয়ে দেবার জন্যে। বিশাল ঢেউটি তাকে গ্রাস করল।