
মাধবী'র উপাখ্যান মহাভারতের। এক নারীর অবমাননা ও পণ্যায়নের গল্প।
উমা আর মহেশ্বর প্রমোদভ্রমণে সুরম্য বনানীতে বিচরণ করছিলেন। সেই বনানীতে এক কল্পবৃক্ষ ছিল। পার্বতীর ইচ্ছা হল, এখুনি তার একটি কন্যাসন্তান জন্মাক। সেই কল্পবৃক্ষ অশোক তার অভীপ্সা পূরণ করল। কন্যা জন্ম নিল। পার্বতী সেই কন্যার নাম দিলেন অশোকসুন্দরী। সেই বনানীর অন্তর্গত এক গুহাতে অশোকসুন্দরী রয়ে গেলেন। কিছুদিন পরে হুন্দ নামে এক দস্যু তাকে কামতাড়নায় অপহরণ করে। অশোকসুন্দরী তাকে বলেন, মহারাজ আয়ুর পুত্রের সাথে তার বিবাহ হবে। ঘটনাচক্রে মহারাজ আয়ু সেই দস্যু হুন্দকে হত্যা করে অশোকসুন্দরীকে মুক্ত করেন ও তার পুত্র নহুষের সাথে তার বিবাহ দেন। অশোকসুন্দরী ও নহুষের এক সন্তান জন্মায়, তার নাম যযাতি। যথাকালে প্রতিষ্ঠানপুরের সিংহাসনে বসলেন যযাতি। তার দুই রানী, শর্মিষ্ঠা ও দেবযানী। দেবযানীর গর্ভে দুই পুত্র ও এক কন্যা জন্মায়, যদু, তুর্বসু ও মাধবী। আর শর্মিষ্ঠার গর্ভে তিন পুত্র, দ্রুহ্যু, অনু ও পুরু। ক্রমে যদু হতে যদুবংশ, তুর্বসু হতে যবনবংশ, দ্রুহ্যু হতে বৈভোজ বংশ আর পুরু হতে পুরু বা কুরুবংশের উৎপত্তি হয়। আর রইলেন তাদের বোন মাধবী।
ঋষি বিশ্বামিত্র তার আশ্রমে উপবিষ্ট। তার সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রিয় শিষ্য গালব। আজ গালব একটি প্রার্থনা নিয়ে গুরুর কাছে এসেছেন। তিনি তার গুরুকে গুরুদক্ষিণা দিতে চান। বিশ্বামিত্র নীরব রইলেন। গালব তার গুরুকে বারম্বার নিবেদন করতে থাকলেন গুরুদক্ষিণার জন্য। বিশ্বামিত্র চিন্তা করলেন গালবের কাছে কি চাওয়া যায়। গোধনে তার বিশাল আশ্রম পরিপূর্ণ। গোধনের প্রয়োজন তার নেই। তবে কি চাওয়া যায়? বিশ্বামিত্র একটি প্রায় অসাধ্য গুরুদক্ষিণা চাইলেন গালবের কাছে, এক সহস্র শ্যামৈককর্ণ অশ্ব! চাঁদের মত শুভ্র গাত্রবর্ণ, কিন্তু একটি কান কালো হওয়া চাই, সে রকম এক হাজার ঘোড়া। গালব চিন্তিত হলেন, তবু গুরু তার গুরুদক্ষিণা চেয়েছেন! তাকে পেতেই হবে সে রকম ঘোড়া।
গালব গেলেন মহারাজ যযাতির কাছে। যযাতি গালবকে যথোচিত অভ্যর্থনা করলেন। গালব তার কাছে শ্যামৈককর্ণ অশ্বের কথা বললেন। মহারাজ যযাতির ভ্রূ কুঞ্চিত হল। অনেক ভেবেচিন্তে তিনি বললেন, “ঋষিবর! এক সহস্র শ্যামৈককর্ণ অশ্ব আমি আপনাকে দিতে পারবো না। কিন্তু তার বিনিময়ে আমি রাজনন্দিনী মাধবীকে দিতে পারি। মাধবী দৈবগুণসম্পন্না। আপনি তাকে গ্রহণ করুন!”
“তাতে আমার কি লাভ?” গালব বিস্মিত হলেন।
“মাধবীর দৈবী ক্ষমতার বলে সন্তানের জন্ম দেওয়া মাত্রই পুনরায় কনকাবস্থা প্রাপ্ত হবেন। অর্থাৎ পুনরায় কৌমার্য ফিরে পাবেন!”
সেই কশ্যপ সাগরের তীর ছুঁয়ে তারা আসছিলেন পূর্বের দিকে, পারস্য, গান্ধার পার হয়ে, পর্বতসঙ্কুল উপত্যকা পার হয়ে গঙ্গা যমুনা সরস্বতী বিধৌত জম্বুদ্বীপে। এক সময়ে গাত্র বর্ণ শুভ্র ছিল, পথশ্রমে তা তাম্র বর্ণ হয়েছে। দীর্ঘ পথে আরও মানুষ জড় হয়েছে। তারা সকলেই চলেছে জম্বুদ্বীপের উদ্দেশ্যে। তাদের মুখের ভাষা নানান, লিপিও নেই। তাদের সাথে নারীর সংখ্যা খুবই অল্প, শুধু পথশ্রমের উপযোগী সমর্থ নারীরাই সাথে। আর তাদের মালবাহক অশ্ব। প্রয়োজনীয় সামগ্রী কখনও অশ্বের পৃষ্ঠে, কখনও বা দ্বিচক্রবাহী রথে। এই যাত্রা দু সহস্র বছর ধরে চলে আসছে।
জম্বুদ্বীপের উত্তরভাগ গভীর জঙ্গলে ঢাকা। কিন্তু সমভূমি। এখানকার স্থানীয় মানুষ সকলেই প্রায় বনবাসী। ফল মূল আর শিকার করা প্রাণীর মাংস তাদের আহার। কিছু মানুষ জঙ্গল কেটে চাষাবাদ শুরু করেছে। এদের একটি বিরাট অংশ সরস্বতী নদীর তীরে বাসতি স্থাপন করেছে। সেই সমুদ্র পর্যন্ত তাদের জনপদ ছড়িয়ে আছে। তাদের নগর পরিকল্পনা, জলব্যবস্থা দেখে উত্তরের আগন্তুকেরা চমৎকৃত হয়। নানা কথ্য ভাষার মধ্যে ধীরে ধীরে একটা সাধার, সকলের বোধগম্য রূপ নিচ্ছিল। প্রথম আগন্তুকের পর দুই সহস্র বছর অতিবাহিত হয়েছে। এক ভীষণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কালান্তক বন্যার পর দিরঘদিন অনাব্রিস্তির ফলে সরস্বতী নদী মৃত। সরস্বতী নদীর তীরবর্তী জনপদগুলি এখন পরিত্যক্ত। সেইসব জনপদের মানুষ যাত্রা করেছে পূর্বের দিকে। তারাও গঙ্গা যমুনা দোয়াবে ঘর বেঁধেছে। কেউ কেউ বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। এর কিছু পরে ঋকবেদ রচিত হচ্ছিল। আর সেই সকল নানা ভাষা সঙ্কলিত হয়ে ধীরে ধীরে একটি ভাষায় রূপ পরিগ্রহ করছিল।
সেই সংস্কৃত ভাষার শৈশবকালে ঋকবেদের সুত্রপাত। মহাভারত সৃষ্টি হবার বহু আগেই ঋকবেদের সপ্তম ও দশম মন্ডলে রাজা যযাতি উল্লিখিত হন। বেদে এক মহাযুদ্ধের উল্লেখ আছে ‘দশরাজ্ঞ’ নামে। অর্থাৎ দশ রাজার যুদ্ধ। সেই সময়ে রাজা রাজড়ারা বিভিন্ন ঋষিদের অনুগামি হতেন। আর ঋষিদের মধ্যে ক্ষমতাদখলের লড়াই লেগেই থাকত। সেইভাবে ঋষি অঙ্গিরস, ভৃগু, শুক্রের মধ্যে অসূয়া ছিল প্রবল। কথিত আছে মহারাজ যযাতি এক রানী দেবযানীর পুত্ররা ছিলেন শুক্রাচার্যের অনুগামী আর রানী শর্মিষ্ঠার পুত্রেরা ছিল ভৃগু পন্থী। অন্যান্য রাজারাও জুটে গিয়েছিলেন। ক্ষমতার দখল নিয়ে এই দশ রাজার মধ্যে প্রবল যুদ্ধ হয়। মনে করা হয়, মহাভারতের বীজ এই দশ রাজার কাহিনি থেকেই উপ্ত হয়েছে। এই রাজাদের পিতা যযাতির কন্যাই হলেন মাধবী।
উৎকৃষ্ট অশ্বের প্রতি ঋষি বিশ্বামিত্রের এতো মোহ কেন? অশ্বের প্রতি সে সময় সকলেরই লোভ ছি বিষয়টিল, বিশেষত সে অশ্ব যদি বিরল প্রজাতির দ্রুত ধাবমান অশ্ব হয়। উৎকৃষ্ট প্রজাতির অশ্বের মধ্যে শ্যামৈককর্ণ অশ্ব বিরলতম। চাঁদের আলোর মোট উজ্জ্বল সাদা আর তার একটি কান শ্যামবর্ণ, ধূসর। শোনা যায় এক অশ্ব ব্যবসায়ী এমনিই এক সহস্র অশ্ব আনছিলেন জম্বুদ্বীপে। সিন্ধুনদ পার হবার সময় প্রবল জলস্রোতে কিছু অশ্ব ভেসে যায়। জনশ্রুতি, আটশত শ্যামৈককর্ণ অশ্ব জম্বুদ্বীপে এসেছিল। কিন্তু সংখ্যাটি কি সত্যই আটশত? এর উত্তর মাধবীর গল্পে পাওয়া যাবে।
সকল ধর্মেই সন্তান প্রসবের উপান্তে নারীদের কন্যকাবস্থা প্রাপ্তির গল্পও বলা হয়েছে। রামায়ণে বনবাস কালীন সীতার কুমারীত্বের কথা আছে। মহাভারতে সত্যবতী, কুন্তী, দ্রৌপদী ইত্যাদির কুমারীত্বের কথা আছে। বাইবেলা যীশুমাতা মেরীও কুমারী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ইসলামেও বেহেস্তে বাহাত্তর জন চিরকুমারী ‘হুরের’ কথা আছে। ভারতীয় পুরানেও উর্বশী, রম্ভা, ঘৃতাচী প্রমুখ অপ্সরারা চিরকুমারী। এরা সকলেই মহৎ বংশধারার আদি জননী। মনে হয় আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজভাবনার বিপরীতে যখন পুরুষতান্ত্রিক ধর্মগুলি জন্ম নেয়, তখন থেকে নারীর সন্তানের জন্মদানের বিশেষ ক্ষমতাটি লঘু করার জন্যই এ সকল কুমারীত্বের তত্ব খাড়া করা হয়েছে। এ জীবনবিজ্ঞান বিরোধী তত্ব।
গালবেরও একটু খানি গল্পও আছে। তার শৈশব ছিল অত্যন্ত কষ্টের। সে ছিল মাতার কাছে মানুষ হওয়া পিতৃহীন শিশু। মতান্তরে ঋষি বিশ্বামিত্রের সন্তান। বিশ্বামিত্র তাকে তার মাতার নিকট রেখে, সেই নারীকে ত্যাগ করেন। তার মা শিশুটির গলায় দড়ি বেঁধে রাখত। এখনও গৃহকাজ করার সময় মায়েরা তার সন্তানদের গলায় বা কোমরে দড়ি পরিয়ে রাখে। যাই হোক, এই গলায় দড়ি পরিয়ে রাখার জন্যেই তার নাম গালব রাখা হয়। গালব একটু বড় হবার পর তার মাতা বিশ্বামিত্রের কাছেই গালবকে ভৃত্য তথা শিষ্য হিসাবে গচ্ছিত রাখে। গালব নিষ্ঠার সাথে সেই দাসবৃত্তি পালন করতে থাকে। গালবের যখন ষোল বছর বয়েস, তখন বিশ্বামিত্র তাকে মুক্তি দেন। গালব তার শিক্ষার জন্য গুরুদক্ষিণা দিতে চায়, কিন্তু বিশ্বামিত্র বলেন, এতদিনের সেবায় গালবের গুরুদক্ষিণা পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু গালব বলে, না তার গুরুদক্ষিণা এখনও বাকি আছে। সে ঋষিকে পীড়াপীড়ি করতে থাকে। আর তখনই সম্পদলোভী বিশ্বামিত্র এক কান কালো দুধসাদা ঘোড়া চেয়ে বসেন।
গালব ভাবে, কি করে এই ঘোড়া পাওয়া যায়? তাই সে গেলো রাজা যযাতির কাছে, প্রতিষ্ঠানপুরে। রাজা হিসেবে যযাতির যত নামডাক ছিল, সেই তুলনায় তার অর্থ সম্পত্তি ছিল না। তবে তার দানী সাজার ইচ্ছে ছিল ষোল আনা। গালব এসে তার কাছে শ্যামৈককর্ণ অশ্ব চাইল। কিন্তু যযাতির কাছে সেই রকম অশ্ব ছিল না। পরিবর্তে যযাতি গালবকে তার কন্যা মাধবীকে দিতে চাইলেন। বললেন মাধবী অত্যন্ত গুণের। তিনি আরও বললেন, মাধবীকে অন্য রাজাদের কাছে নিয়ে যেতে। মাধবী বিস্মিত স্তব্ধ হয়ে গেলো। গালবও।
শেষ পর্যন্ত গালব মাধবীকে নিয়ে চলল। রাজকন্যা মাধবী এক সহায়সম্বলহীন আশ্রমবাসী গালবের হাত ধরল। মাধবী দুঃখ পেল পিতার এহেন আচরনে, তবু মাধবী মেনেই নিল। তখনো তার মনে ছিল প্রেমের অঞ্জন। গালব আর মাধবী চলল সাকেতের পথে। সাকেত তুলনায় বর্ধিষ্ণু রাজ্য। ইক্ষ্বাকু বংশের মহারাজ হর্যাশ্ব সিংহাসনে আসীন। হর্যাশ্ব রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ। লোকমুখে গালব শুনেছে, হর্যাশ্বের অশ্ব শালাটি সুবৃহৎ এবং নানা প্রজাতির অশ্বে পূর্ণ। মহারাজ হর্যাশ্বের সমীপে উপস্থিত হয়ে গালব নিবেদন করল, “’মহারাজ! গুরুদক্ষিণা দান করবার নিমিত্ত আমি সাহায্যপ্রার্থী। এই কন্যার নাম মাধবী, অপর একটি নামও আছে, দৃষ্টদ্বতী। ইনি মহারাজা যযাতির পুত্রী। আপনি এই অলোকসামান্যা নারীকে গ্রহণ করুন। আমি অবগত হয়েছি যে, আপনি অদ্যপি সন্তানহীন। মৃত্যুর উপান্তে জল পাবেন না। আমি গননা করছি, এই নারী আপনাকে সন্তান দেবেন!”
“পরিবর্তে?”
“পরিবর্তে আপনি আমাকে আপনার অশ্বশালা থেকে সমস্ত শ্যামৈককর্ণ অশ্ব দান করবেন!”
মহারাজ হর্যাশ্ব গালবের কথা বিশ্বাস করলেন, বিশেষত সংগের নারিটির দিকে তার লোলুপ দৃষ্টি মাধবীর চোখ এড়ালো না। কামুক পুরুষের দৃষ্টি নারীরা সহজেই অনুভব করতে পারে। মহারাজ হর্যাশ্ব মাধবীর দিকে চাইলেন, যেন কোন পণ্য পরখ করছে এমন চোখে চাইলেন মাধবীর দিকে। সে সময়ে নারীর সেরা হতে গেলে যে সমস্ত গুণ থাকা দরকার মাধবীর সকলই বর্তমান.। যে ছয়টি অংগ উন্নত হবার কথা, তা সমুন্নত, যে সাতটি অঙ্গ লঘু হবার কথা তা চিকন, যে তিনটি অংগ গভীর হবার কথা তা সুগভীর, যে পাঁচটি অঙ্গ রক্তিম হবার কথা তা রক্তবর্ণ। হর্যাশ্ব সন্তুষ্ট হলেন। মাধবী পণ্যের মত হাতবদল হয়ে গেল। কামাতুর হর্যাশ্ব উন্মাদের মত মাধবীর সংগ কামনা করলেন। “তুমি আমাকে সন্তান দাও!” মাধবী ভাঙ্গা গলায় গালবকে বলল, “আমি ঋষির বরে সন্তানের জন্ম দেওয়া মাত্রই কন্যকাবস্থা প্রাপ্ত হব। তারপর তুমি তখন আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেও!
বৎসরান্তে মাধবীর গর্ভে একটি পুত্র জন্মাল। মহারাজ হর্যাশ্ব অত্যন্ত প্রীত হলেন। অষ্ট বসুকে স্মরণ করে পুত্রটির নাম রাখা হল বসুমানস। মাধবী আবার কুমারী অবস্থা প্রাপ্ত হল। অর্থাৎ সে আবার পণ্য হিসাবে গণ্য হতে পারবে। হর্যাশ্ব গালবকে দুই শত শ্যামৈককর্ণ ঘোড়া দিলেন। গালব সেই ঘোড়াগুলিকে মহারাজের কাছেই গচ্ছিত রেখে মাধবীকে নিয়ে রওয়ানা হল।
[উন্নতেসুউন্নত ষষ্টু, সূক্ষ্ম সূক্ষ্মেষু সপ্তাসু, গম্ভীরা ত্রিষু গম্ভীরেস্ব, ইয়ম রক্তাসা সা পঞ্চাসু, শ্রোণ্যৌ ললাটকাষু ঘ্রাণম সেতি সুদান্তম – মহাভারত, উদ্যোগপর্ব ৫.১১৪.২]
তারপরে মাধবীকে নিয়ে গালব গেলো কাশীতে। কাশী নরেশ দিবোদাস তখনকার দিনে এক খ্যাতনামা নৃপতি। ঋকবেদে আর একজন দিবোদাসের নাম পাওয়া যায়। তিনি তখন গোষ্ঠীপতি ছিলেন, ধন্বন্তরির বংশজ, লক্ষ্মণের মামা, রাজা দশরথের অশ্বমেধ যজ্ঞে নিমন্ত্রিত ছিলেন। এই গল্পের দিবোদাস রামের চতুর্দশ পূর্বজ। তাই মনে হয় দুজন আলাদা মানুষ। যদিও মহাভারতে রামায়ণের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ আছে, যা মনে হয় পরবর্তী কালের প্রক্ষেপ। যাইহোক, এই দিবোদাসের পিতা সুদাস। তিনি আয়ুর্বেদের প্রচার করেছিলেন। দশরাজ্ঞে এই দিবোদাস অংশগ্রহন করেছিলেন বলে মনে করা হয়।
কিন্তু দিবদাসের দুই শত এক কান কালো দুধ সাদা ঘোড়া ছিল। কি আর করা যাবে, গালব মনে করল। সে মাধবী নিয়ে কাশীতেই এলো। মাধবীর কথা দিবদাস আগেই শুনেছিলেন। দিবোদাসের পূর্বে কোন সন্তান ছিল কি না, তা জানা যায়না। সম্ভবত ছিল না, নইলে দিবোদাসকে মাধবীর গল্পে আনা হত না। সেই রাজা দিবদাস মাধবীকে বিবাহ করলেন এবং মাধবীর গর্ভে তার একটি পুত্র লাভ হল। সেই পুত্রের নাম প্রত্যর্দন। একবছর পড়ে দিবোদাসের বংশরক্ষা হয়ে গেছে, তাই তার কাছে মাধবীর প্রয়োজন ফুরালো। আবার শর্ত অনুযায়ী দুই শত শ্যামৈককর্ণ অশ্ব রাজার কাছেই গচ্ছিত রেখে মাধবীকে নিয়ে গালব পথে বেড়িয়ে পড়ল।
মহাভারতে এই একাধিক স্বামীত্বের গল্পও বারবার এসেছে। মাধবীর গল্পের ছায়া আছে দ্রৌপদীর জীবনেও, তার পঞ্চস্বামীত্বে। একাধিক ভর্তা স্বত্বেও বেদবাদীরা নারীদের সতী বলেছেন, নারীর পণ্যায়নের ইতিহাসে প্রলেপ দেবার জন্যেই।/p>
এরপর গালব গেলেন কাশীর নিকটে ভোজ নগরে। ভোজ নগএর রাজা তখন চন্দ্রবংশীয় ঊশিনর। ঊশিনর বাকি রাজাদের মতই মাধবী গ্রহণ করলেন পুত্রের কামনায়। যথারীতি মাধবীর গর্ভে ঊশিনরের ঔরসে শিবীর জন্ম হল। শর্তমত গালবকে তিনি দু শো শ্যামৈককর্ণ অশ্ব দান করলেন। মাধবী আবার কন্যকাবস্থা প্রাপ্ত হল। এ পর্যন্ত ছ শো অশ্ব পাওয়া গেছে। গালবের মিত্র সুপর্ণ গালবকে বলল, পার হবার সময় মাত্র ছ শো ঘোড়াই সিন্ধু নদী পার হতে পেরেছিল। বাকিরা স্রোতে ভেসে গেছে। সুপর্ণ তাকে উপদেশ দিল, ওই ছ শো ঘোড়া নিয়ে বিশ্বামিত্রের কাছে যেতে। গালব আর কি করে? ছয় শয় শ্যামৈককর্ণ নিয়েই তার গুরু বিশ্বামিত্রের সমীপে উপস্থিত হল। গারুর কাছে গিয়ে গালব সমস্ত বিবরণ দিল। এও বলল, মাত্র ছয় শত ঘোড়াই ভূ ভারতে আছে। গুরু যদি বাকি অশ্বের পরিবর্তে মাধবীকে গ্রহণ করেন! গায়ত্রী মন্ত্রের রচয়িতা রাজর্ষি বিশ্বামিত্রের লালসা লকলক করে উঠল।
বিশ্বামিত্র মাধবীকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করলেন। মুনি ঋষিরা কোনকালেই জিতকাম ছিলেন না। তাহলে তাদের বংশ রক্ষা হয় না। যথাকালে মাধবীর গর্ভে তার একটি পুত্র জন্মলাভ করল। তার নামকরণ হল অষ্টক। এরপর মাধবীকে তিনি মুক্তি দিলেন। গালবের সংগৃহীত ছয় শত শ্যামৈককর্ণ অশ্ব নিয়ে বিশ্বামিত্র সন্তুষ্ট হয়ে গালবকে গুরুদক্ষিণার দায় থেকে মুক্ত করেন। মাধবীকে নিয়ে গালব চললেন তার পিতা যযাতির নিকট। যযাতি কন্যাকে দেখে প্রীত হলেন। এরমধ্যে মাধবী গালবকে ভালবেসে ফেলেছে। সে গালবের ঘরণী হতে চাইল। গালবের একটাই শর্ত, মাধবীকে পুনরায় কুমারী অবস্থা প্রাপ্ত হতে হবে! এই প্রথম মাধবী প্রতিবাদ করল। তাই তার আর কারোর চিরকালের স্ত্রী হওয়া হল না। পিতার অনুমতি নিয়ে সে চলল বনে, পর্ণকুটিরে একাকী জীবনে। বহুদিন পরে তার গর্ভজাত চার পুত্র বড় হলে গেলো। তারা প্রত্যেকেই মহান রাজবংশের উত্তরাধিকারী। তার এলো তাদের মায়ের কাছে। জন্মদাত্রীকে সম্মানপূর্বক পাদবন্দনা করে তারা বলল, “হে মাতঃ, হে তপোধন! আমরা ধন্য যে চারটি বংশধারায় আপনার শোনিত বইছে। মহারাজ যযাতি সশরীরে স্বর্গারোহন করবেন। আপনি সম্মতি দিন আর আমাদের আশীর্বাদ করুন!” মাধবী তার সন্তানদের দিকে তাকাল। তাদের সস্নেহ আশীর্বাদ দিল। তারপর একদিন মাধবী অরণ্যে মৃত্যুবরণ করলেন। মাধবীর গল্পও এখানেই শেষ। কিন্তু মাধবীর কাহিনি অনেকগুলি প্রশ্ন রেখে গেলো।
সেই সময়ে সমাজে নারীর স্থানটি কি রকম ছিল? আজকের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সেটা বিচার করা কি সমীচীন? নারীর কুমারীত্ব কি জৈবিক, না কি মানসিক? তার বাধ্যতামূলক বহুগামীতা কি আজকের সমাজ মেনে নেবে? মাধবীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিল চার চারটি রাজবংশ। তার সন্তানরা জড়িয়ে পড়েছিল ‘দশ রাজার যুদ্ধে’। মাধবীর গর্ভ থেকেই জন্ম হয়েছিল কুরুবংশের পূর্বজগণ। যদু বংশেরও। মাধবীর কালের বহু পড়ে বেদ সৃষ্টি হল। তার পড়ে রামায়ণ মহাভারতের সৃষ্টি। মাধবীর গল্প মহাভারতের উদ্যোগ পর্বেই বলা হয়েছে। এইসব কাহিনীতে সব কালেই এক একেকজন বিশ্বামিত্রের দেখা পাই। এই বিশ্বামিত্র কি গায়ত্রীর রয়য়িতা? কিম্বা বশিষ্ঠের সমকালীন? মাধবীর কারণেই অসুর আর দেবকূল, অঙ্গিরস আর ভৃগুর অনুগামীরা নিজেদের বিবাদ মিটিয়ে একত্রিত হয়েছিলো?
আসলে আমার মনে হয়েছে, মাধবীর কাহিনি প্রকৃতির দ্যোতক! প্রকৃতি যেমন বহুভোগ্যা, মাধবীও বহুভোগ্যা হয়েছিলো। ফসল ফলানর পর যেমন পৃথিবী আবার কুমারী মৃত্তিকায় পরিণত হয়ে আবার রজঃস্বলা হন, নতুন প্রাণের উন্মেষ ঘটে তার জঠরে। মাধবীর গল্পে তেমনি মাধবী বারবার সন্তানের জন্ম দিয়ে আবার কৌমার্যে ফিরে গেছে। পৃথিবী যেমন অপমানিতা হন না, মাধবীও তেমনি বহুভোগ্যা হয়েও অবমানিতা হয় নি। নারীর ও প্রকৃতির এই যে চিরন্তন সম্মান, তাকে সেকালে সমাদর করা হতো। আজ সেই বোধটাই শেষ হয়ে গেছে। আধুনিক মানুষের কাছে বারেবারে ধ্বস্ত হচ্ছে নারী ও প্রকৃতি।