
নাঃ... অনেক ভেবে দেখলাম বুঝলি, পরজনমে আর আমি তোর প্রেমিক হতে চাই না। সোয়ামি তো নয়ই। আমি জানি, এমনধারা কথা শোনার পর তোর ঐ ডাগর চোখ দুটো আমার দিকে ছুঁড়ে দেবে একরাশ জিজ্ঞাসা। উৎকন্ঠা। অবিশ্বাস। আচ্ছা তুই আন্দাজ কর দেখি, পরজন্মে আমি কি হতে চাই? হু হু... তোর আন্দাজের দৌড় আমার জানা আছে।। নিশ্চই ভাবছিস, পরজনমে আমি তোর গলার লকেট হব।
নাঃ ওসব ন্যাকা প্রেমিকের বোকা বোকা শখ আমার হয় না। আচ্ছা... যদি বলি, পরজন্মে আমি তোর বুকশেলফের একটা বই হব... মানবি তুই? তোর বুকশেলফের চকচকে পৃষ্ঠাওয়ালা দূর্মূল্য বই হওয়ার সাধ আমার নেই। ওদের ভাগ্যে তোর করপল্লবের স্পর্শ বড়ই দূর্লভ। আমি হতে চাই ক্ষীণকায়, পাতলা ফিন ফিনে পৃষ্ঠার উপর সস্তা প্রিন্টিংয়ের হাসি-মজার-পাঁচমেশালি গল্পের বইটা। কোনো এক ক্লান্ত দুপুরে তুই আমায় কাছে টেনে নিবি। তোর কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকব আমি। তোর বেহিসেবী স্পর্শে শিহরণ জাগবে আমার শরীরে। তোর চোখে ছায়া পড়বে আমার অক্ষরের। আমি তাকিয়ে থাকব তোর দিকে। শুভদৃষ্টি হবে আমাদের। মিলন হবে মননের।
হয়তো, তোর প্রেমাস্পদ তোকে উপহার দেবে, খ্যাতনামা কোনো কবির প্রেমের কাব্য সংকলন। দেখব তোদের কাব্যালাপ। কাব্যের রসস্রোতে আমি ততদিনে স্থানচ্যূত। বুকশেলফ থেকে তোর অগোছাল পড়ার টেবিল। সেখানে শৈথিল্যের অনাদর। কাব্যিক কাবাবের কাছে গদ্যের ডাল-ভাত চিরকালই বড় অসহায়। কাব্যিক অহংকার দাবিতে আমি অক্ষম। আমার মুক্তি তোর স্পর্শসুখে।...... তারপর হঠাৎ একদিন কাব্যের ঝংকার হয়ে ওঠে বেদনার টংকার। প্রেমাস্পদের সাথে বিচ্ছেদ। মনে মনে ভাবলুম- ভাগ্যিস তোর প্রেমিক হই নি !
দুঃখ, ক্ষোভে, অশ্রুতে জর্জরিত তুই। প্রচন্ড ক্ষোভে একদিন আমায় ছুঁড়ে ফেললি মেঝের উপর। ওঃ সেকি প্রচন্ড আঘাত! মলাটটা শতচ্ছিন্ন। মেরুদন্ডটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। খুলে গেল বেশ কয়েকটা পৃষ্ঠা। যন্ত্রণায় আছন্ন রইলাম কয়েকদিন।...... তারপর কোনো এক রাতে আবার কাছে টানলি আমায়। আমার ক্ষতে আঠা লাগিয়ে দিলি পরম আদরে। আবার মিলন হল মননের। তোর আলিংগনে আবদ্ধ হলাম আমি। আবিষ্ট হলাম তোর তপ্ত নিঃশ্বাসে। আমার কোলে মাথা রেখেই ঘুমের দেশে পাড়ি দিলি। প্রত্যক্ষ করলাম আমার নিদ্রামগ্ন স্বপনচারিনীকে। তোর সুখের দিনে কাব্য বিলাস হয়ে ওঠবার সাধ্য আমার ছিল না। তোর দুখ জাগানিয়া রাতের ঘুমপাড়ানি গান হওয়াতেই আমার মোক্ষলাভ।
এভাবেই আদর-অনাদরে কাটে আরও কয়েকটা বছর। তারপর কোনো এক শুভক্ষণে তুই বাঁধা পড়বি সাত পাকে। যুবতীর চঞ্চলতা পরিপূর্ণতা পায় নারীত্বের গভীরতায়। তোর কাব্যরসিক বর তোকে জড়িয়ে রাখে কাব্যালঙ্কারে। আমাকে জড়ায় স্মৃতিদোষের ধূলিকণারা। তোর কোল আলো করে আসবে ফুটফুটে এক পরী। তোরই মত দেখতে। তোর কাব্যরসিক বরের জীবনানন্দ প্রিয়। সে তার নাম দিতে চায় আকাশলীনা। কিন্তু তুই তার নাম রাখলি তিলোত্তমা। আমারই এক চরিত্র। তোর অবচেতনে এখনও আছি তাহলে!
তোর মেয়েও বড় হয়ে উঠছে। তুই এখন বিগত যৌবনা। বয়সজনিত গাম্ভীর্যের ছাপ তোর স্বভাবে। আমার শরীরেও থাবা বসিয়েছে বার্ধক্য। পৃষ্ঠাগুলো ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। আর তুই সেই একবার আমায় ছুঁড়ে ফেলেছিলি... মনে আছে? তারপর থেকেই মেরুদন্ডটা বড় সমস্যায় ফেলে।
সেদিন সন্ধ্যায় তুই আর তোর সোয়ামি প্রেমালাপে মশগুল ছিলি। আমি বেশ উপভোগ করছিলাম। সকৌতুকে ভাবছিলাম-“ বাব্বা... এত বছর বিয়ে হয়ে গেল... তবু এখনও কপোত কূজন শেষ হয়নি!” হঠাৎই তোর মুখে আমার নামটা শুনে চমকে উঠলাম। কিন্তু তারপর যা শুনলাম...... আমার সমস্ত সত্তা কেঁপে উঠল। তোদের বাড়িতে নতুন কাব্যসংকলন আসছে। স্থানাভাব। তাই পুরনো বইদের বিদেয় করবি!! তার মধ্যে আমিও......, না না এরকমটা করিস না। আমায় ছিঁড়ে ফেল, নষ্ট করে দে, পুড়িয়ে ফেল... কিন্তু বিক্রি করিস না...। আর পাঁচটা হাতের হিসেবি স্পর্শের ভিড়ে তোর বেহিসেবী স্পর্শগুলোকে হারাতে চাই না!!... কিন্তু হায়...... জড়ের আর্তনাদ কে কবে শুনেছে!
কোনো এক সকালে এক ষন্ডা লোকের নোংরা হাতে আমায় তুলে দিলি তুই। লোকটা তোর হাতে গুজে দিল কড়কড়ে নোট। তোর মুখে তখন একটু একটু করে ফুটে উঠছে ‘কাব্যিক অহংকার’।