
হিমশীতল গিরিবর্ত্মে উপল ব্যথিত পথে কায়ক্লেশে পথ পরিক্রমা করছেন ছয়টি মানুষ তারা চলেছেন মহাপ্রস্থানের পথে, জীবনের উপান্তে, এক অলৌকিক লক্ষ্যে । সেই অসহ সুন্দর সঙ্কুল পথে পড়ে গেলেন দ্রৌপদী । তাঁর জীবনভর যন্ত্রণার বুঝি অবসান হোল এইদিনে । অস্ফুট কাতর ধ্বনি বেরিয়ে এল অসহায় আর্ত এক নারীর কণ্ঠ থেকে । তীক্ষ্ণ অর্কপ্রভায় পুড়ে জেতে লাগল তাঁর বরানন । তাঁর চোখের তারায় প্রতিবিম্বিত হতে লাগল মৃত্যুর সৌন্দর্য । ধীরে ধীরে এক নিবিড় ছায়া ঢেকে দিলো তাঁর মুখ । সমবেদনার এক মন্দ্র কণ্ঠস্বর যেন দূর থেকে ভেসে এল ।- তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে, কৃষ্ণা ?
দ্রৌপদী চোখ মেললেন সেই চিরচেনা স্বরে । বড় কষ্টে ম্লান হাসিতে ভরে গেলো তাঁর মুখ সঘন ব্রীড়ায় । -ভীম, তুমি ? যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল, সহদেব সবাই এগিয়ে গেছে, শুধু তুমি কেন দাঁড়ালে আমার জন্যে ? আমি তো তাদেরও স্ত্রী, তাদের সন্তানদেরও জননী ! তবু শুধু তুমি একা কেন ?পরম মমতায় বৃকোদর নিজের হাতের উপাধানে তুলে নিলেন দ্রৌপদীর মাথা ।- কথা বোলোনা, কৃষ্ণা, তোমার কষ্ট হবে ।যাজ্ঞসেনী ভাবেন, অর্জুন তো তাকে জয় করে নিয়ে এসেছিল । কিন্তু ভীম কেন বারবার প্রতিবার তাঁর কষ্টে, অপমানে, তুচ্ছ আবেদনে, সুখে, প্রসন্নতায় তাঁর পাশে থেকেছে ?
তাঁর মনে পরে যায় সেই কৌরবসভা ! গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম, প্রজ্ঞাবান বিদুর, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, গুরু দ্রোণ, বিজ্ঞ কৃপাচার্য সভা আলো করে বসে ছিলেন । তাদের সামনে, তাদের অনুমোদনে চলছিল দ্যূতক্রীড়া । আর ধর্মরাজ ! একের পর এক অধর্মের বাজি হারছিলেন । নিজে, সকল ভাইদের হারবার পর, তিনি বাজি ধরলেন দ্রৌপদীকে । পান্ডব কূলবধূ, দ্রুপদনন্দিনী, একবস্ত্রা পাঞ্চালীকে ! রিক্ত, পরাজিত পান্ডব ভ্রাতাদের সামনে, ওই ধর্মজ্ঞ কূলজ্যেষ্ঠদের নীরব অনুমোদনে দুঃশাসন তাঁর কেশ আকর্ষণ করে প্রকাশ্য সভায় এনে ফেললেন । ঠিক তখনই ভীম উঠে সহদেবকে অগ্নি আনতে বললেন । তারপর ক্রোধকম্পিত গলায় বললেন,- পাশা খেলায় সমস্ত ধন সম্পত্তি হারিয়েছ, আমরা নিরুত্তর ছিলাম । রাজ্য বিসর্জন দিয়েছ, আমরা ভাইয়েরা কিছু বলিনি । তুমি অন্যায় জেনেও আমাদেরও দাস করে দিয়েছ ওই দুর্যোধনের কাছে, অব্যক্ত যন্ত্রণায় তাও মেনে নিয়েছিলাম ! কিন্তু এতদূর দ্যুতাসক্তি ? তুমি কূলবধূ পাঞ্চালীকে, ওই একবস্ত্রা যাজ্ঞসেনীকে তুমি বাজী রাখ এমনই দ্যুতাসক্তি ? যে দুবাহু দিয়ে তুমি পাশার দান দাও, সেই বাহুদ্বয় আমি তোমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করব ! সহদেব, আগুন আন । আমি ওই বাহুদুটি দাহ করব !অর্জুন তখন তাকে কোনক্রমে নিবৃত করেন । তারপর বৃকোদর সেই কৌরব সভায় সবাইকে বললেন,- ক্ষাত্রধর্মের কি নির্মম পরিহাস ! ওই পাঞ্চালীকে সভামধ্যে এমন নিষ্ঠুর অবমাননা করা হোল আর আপনারা ধর্মজ্ঞানী কুরুবৃদ্ধগণ একে প্রচ্ছন্ন অনুমোদন দিলেন ! সত্য বটে রাজধর্ম, হে মহারাজ ! কিন্তু আমি কৌন্তেয়, মধ্যমপান্ডব ভীমসেন, প্রতিজ্ঞা করছি, যে ধার্তরাষ্ট্র দুঃশাসন কেশ আকর্ষণ করে পান্ডবজায়া দ্রৌপদীকে লাঞ্ছনা করেছে, দ্রুপদনন্দিনীর বস্ত্রহরণ করে তাঁকে অপমানিতা করেছে, আমি তার প্রতিশোধ নেব । ওই দুরাত্মার বক্ষপঞ্জর চূর্ণ করে আমি তার হৃদপিণ্ড নিংড়ে রক্তপান করব আর সেই রুধির ধারায় পাঞ্চালী প্রক্ষালন করবেন তাঁর কেশদাম । - আর পাপী দুর্যোধন ! যে অনাবৃত ঊরুদ্বয় প্রদর্শন করে অশ্লীল বাসনায় পাঞ্চালীকে করেছো কামনা, গদাঘাতে ওই ঊরুদ্বয় চূর্ণ করব জেনে রেখো ! পৃথিবীর কোনও শক্তি সেদিন আমাকে নিবৃত্ত করতে পারবেনা । সরীসৃপের মত ভূমিসজ্জায় স্থান হবে তোমার ! আমি যদি এই প্রতিজ্ঞাচ্যুত হই আমার পিতৃপুরুষ যেন পরলোকে গতিপ্রাপ্ত না হয় আর আমি যেন নরকস্থ হই !এই ভীষণ প্রতিজ্ঞা করে বৃকোদর অঙ্গবস্ত্র পরম ঘৃণায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অনাবৃত প্রস্তরে বসেছিলেন ।
এই ভীম, পাঞ্চালী ভাবেন ।এই গিরিবর্ত্মে, এই সঙ্কুল পথে আজ ভুমিলগ্না পান্ডব রাজ্যেশ্বরী, হায় ! মধ্যম পান্ডব পরম মমতায় দ্রৌপদীকে শুশ্রূষা করেন । নিমীলিত চোখে দ্রৌপদী বলে চলেন,- কি ছেলেমানুষীই না করেছি, বৃকোদর, মনে পড়ে, সেই বদরিকাশ্রমে ? বালিকার মত তোমার কাছে স্বর্ণ কমলের বায়না করেছিলাম । তুমি, ভীম, একমাত্র তুমি বলেই, সেই গভীর জঙ্গলে গিয়ে, কত কান্ড করে, কত যুদ্ধ করে আমায় স্বর্ণ কমল এনে দিয়েছিলে । সেদিন আমার বড় গর্ব হয়েছিল, বড় সুখ হয়েছিল !ভীম সান্ত্বনার স্বরে বলেন,- সেই জটাসুরকে বধের কথাও তো মনে পড়ে । আর মনে পড়ে, পরাজিত হয়ে পঞ্চচূড় হওয়া জয়দ্রথের করুণ মুখ । আমার প্রিয়া কৃষ্ণাকে হরণ করা । সে মূর্খের শাস্তি হওয়ার ছিল মৃত্যু । তুমি না ধৃতরাষ্ট্র তনয়ার স্বামীশোক নিবারণ করতে, জয়দ্রথকে ক্ষমা করেছিলে । আমি শুধু তার অভিনব কেশকর্তন করে, পঞ্চচূড় করে ছেড়ে দিলাম । জয়দ্রথ পালিয়ে বেঁচেছিল ।- জান কৃষ্ণা, এ কথাটা আমি কাউকে বলিনি, আজ এই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তোমাকে বলছি । সারা জীবন আমি একটি পাপ বয়ে বেড়াচ্ছি । সেই পাপ সারা জীবন আমাকে বজ্রকীটের মত দংশন করেছে । অথচ মাতার নির্দেশে এক অন্যায় প্রতিজ্ঞায় সত্যবদ্ধ আমি সেই পাপের যন্ত্রণা বয়ে চলেছি জীবন ধরে ।
আমি আজও ভুলিনি রাক্ষসনন্দিনী হিড়িম্বাকে, তোমার পাণিগ্রহণের আগে আমি তাঁকে বিবাহ করেছিলাম । তাঁর গর্ভে সর্বজ্যেষ্ঠ পান্ডবকুমারের জন্ম হয়েছিল । তিনি ছিলেন সকল পাণ্ডব স্ত্রীগণের জ্যেষ্ঠা । কিন্তু রাক্ষস কূলোদ্ভব বলে সেই সম্মান তিনি পাননি । কিন্তু আমি, ভীমসেন, নিজেই তো নাগরাজ পবনের ঔরসজাত ! প্রজন্মে প্রজন্মে কত ধারার শোণিত মিশেছে এই কুরুবংশে ! তবু কি ভঙ্গুর এই জাত্যাভিমান ! তারপর তুমি এলে জীবনে ।- তুমি, যজ্ঞাগ্নি থেকে প্রকাশিত মানবী ! আচ্ছা কৃষ্ণা, তুমি কখনো ভেবেছ, কতদূর প্রতারনা এটি ? নারী পুরুষের মিলন ছাড়া কখনো কোনও প্রানের সৃষ্টি হয় । তুমি কি বোঝনি যে তুমি ও তোমার ভাই আসলে মহারাজ দ্রুপদের ঔরসজাত নয়, তাঁর স্নেহে পালিত অপত্য অপত্যা শুধু । ঠিক এইভাবে পৌরাণিক দেবতা পবনের নামে আমার পিতাকে কতদূর অপমান করা হোল ! অনার্য মহাত্মা আঞ্জনেয়কে ভ্রাতা বলে রটনা করে শুধু তাঁকে অপমান করা হোল না, আমাকেও অপমান করা হোল ।
দ্রৌপদী অল্প হাসলেন । তাঁর মুখের বলিরেখায় কষ্টের আলোছায়া খেলে গেলো । তিনি ধীরে ধীরে বললেন । - এই হয় বৃকোদর ! যতই চেষ্টা করনা, সত্য কিছুতেই পিছন ছাড়ে না ! সে তাঁর মুল্য ঠিক পরিশোধ করে নেয় । হয়ত কোনও কৃষ্ণবর্ণা দাসীই ছিলেন আমার মাতা, তাই আমি কৃষ্ণা । হয়ত আমার শরীরের অনার্য রক্তধারা ঠিক চিনেছিল তোমার অনার্য রক্তধারাকে, তাই বুঝি এতো ভালবাসা ? আমাকে বিবাহ করার পর তোমার ভাইয়েরা আবার বিবাহ করেছিলেন । আর আমাকে যিনি জয় করেছিলেন, সেই পার্থ তো বহুবিবাহের একরকম ইতিহাসই গড়ে তুলেছিলেন । কিন্তু তুমি আর তো পাণিপীড়ন করলে না কোনও রাজদুহিতার, কোনও অনিন্দসুন্দরীর ? কেন ভীম ?মধ্যমপান্ডব আত্মগত হলেন । ভাবলেন, এই প্রশ্নটা তো কেউ আগে তাঁকে করেনি । সত্যিইতো । দ্রৌপদীকে বিবাহ কার পরেও যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল, সহদেব তো বিবাহ করেছেন, শুধু তিনি ছাড়া । তিনিকি একেবারে অন্য রকম ? ভীম জেনেছেন পিতা পান্ডু মাতা কুন্তীর কাছে এক বলশালী পুত্র যাচ্ঞা করেছিলেন । সেহেতু মাতা কুন্তী নাগরাজ পবনে উপগত হয়েছিলেন এবং তারই ফলস্বরুপ অসামান্য বলশালী বৃকোদরের জন্ম । তাই যখন সেই বাল্যকালে দুর্যোধন তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে মৃত মনে করে জলে ভাসিয়ে দেয়, বনবাসী নাগরাই তাঁকে উদ্ধার করে, শুশ্রূষা করে তাঁকে পুনর্জীবন দান করে । নাগেরা বোধহয় জানত যে এই পাণ্ডুপুত্রটি তাদের রক্তধারা বহন করে । আর সেই কারনে তারা তাঁকে বিশেষ প্রীতির চোখে দেখত ।সেই বারণাবতে, কৌরবদের চক্রান্তে তাদের জতুগৃহে অগ্নি সংযোগ করে হোল, তখন এই নাগেদের সহায়তায় মাতা কুন্তী আর চার ভাইকে রক্ষা করেছিলেন ভীম । কৃষ্ণকে তিনি ভালবাসতেন, শ্রদ্ধাও করতেন । কিন্তু অর্জুনকে বাঁচাবার জন্য প্রিয়পুত্র ঘটোৎকচের বলিদান তিনি মন থেকে মানতে পারেন নি, এই দুঃখ চিরকাল বহন করে চলেছেন তিনি । যেমন করে বহন করে চলেছেন কৃষ্ণার গর্ভজাত পুত্র সুতসমের মৃত্যু ।
তথাপি নিজ মনে এই শোকের পাষাণভার বহন করেও তিনি সকল কর্তব্যে হিমালয়ের মত অবিচল থেকেছেন । আজ এই মুহূর্তে তাঁর প্রাণাধিক পাঞ্চালী তারই বাহুডোরে মারা যাচ্ছেন । আর সেই শোক তাঁকে জলন্ত অগ্নির মত দহন করছে । তাঁর উষ্ণ অশ্রুধারা দ্রৌপদীর কপোলতল সিঞ্চিত করছে । যেন এই শেষ মিলনের অশ্রুধারা যাজ্ঞসেনীর সমস্ত দুঃখের বলিরেখাগুলিকে মুছে দিচ্ছে । জ্ঞান হারাবার আগে যেন হৃদয়ের গভীরে বেজে ওঠে পাঞ্চালীর শেষ প্রার্থনা ।- পরজন্মে তুমিই আমার স্বামী হোয়ও ভীম । যদি আবার এই পাঁচ ভাইকেই বরণ করতে হয়, তাও আনন্দে সয়ে নেব । কিন্তু কথা দাও, বৃকোদর, তুমি এঁদের বড়ভাই হবে ।
এই কথা বলতে বলতে কৃষ্ণা চিরকালের মত চোখ বুজলেন । ভীমের বুক ভাঙ্গা আর্তনাদ সেই গিরিকন্দরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল । ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসে । অবসন্ন ভীম তাঁর আদরের পাঞ্চালীকে শৈলশিখর নিঃসৃত বারিধারায় বিসর্জন দিয়ে, উদ্দেশ্যহীন প্রেতের মত এগিয়ে চলেন ।