
[স্থান কুরুক্ষেত্র। সারাটা রণাঙ্গন জুড়ে পড়ে আছে যোদ্ধাদের শব। যুদ্ধের উপান্তে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, বিদুর, কুন্তী, পাঞ্চালীসহ পান্ডবেরা এসেছেন। এসেছেন কৃষ্ণ। স্বজন হারানোর বিলাপে ভরে উঠছে সে বধ্য ভূমি। ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন কুন্তি, বিদুর, আর পাণ্ডবেরা। সবহারা গান্ধারী সকলকে ক্ষমা করে দিলেন, এক কৃষ্ণ ছাড়া। কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে তার উক্তি ]
গান্ধারী ।। এই স্বজনহারানো বধ্যভুমিতে তুমি কেন এসেছ মাধব? ওই দেখ দ্বৈপায়ন হ্রদতীরে পড়ে আছে প্রাণপ্রিয় পুত্র সুযোধনের শব। আকাশের দিকে অঙ্গুলিসংকেত তার? তার বক্ষে ক্রন্দনরতা ভানুমতী। গুরুজঘনা, পীনোন্নতা, কমলাক্ষী পুত্রবধু আমার। বৃকদরের অন্যায় গদাঘাতে ভগ্নজানু সুযোধন! ভানুমতীর বিলাপে আকাশ বাতাস ক্রন্দনমুখর। ভীমসেন হত্যা করেছে বটে, কিন্তু আসল হন্তারক তুমি হে মাধব! তুমিই তাকে অন্যায় যুদ্ধে প্ররোচিত করেছিলে। বুদ্ধি দিয়েছিলে ঊরুতে আঘাতের। প্রিয় বলরাম ক্ষুব্ধ হয়েছিল এই অন্যায় যুদ্ধে। হে মাধব, তোমার কুলবধু লক্ষণার কথা বিস্মৃত হয়েছিলে তুমি। বিস্মৃত হয়েছিলে প্রিয় সুযোধনের প্রাণের পুত্তলি লক্ষণার শোক। বৈবাহিক ছিলে তুমি সুযোধনের। ভীমসেন প্রতিজ্ঞা করেছিল যাজ্ঞসেনীর অবমাননার প্রতিশোধ সে নেবে। সে নিয়েছে। কিন্তু তুমি হে মাধব! কোন দুস্প্রভাবে তোমার মতিচ্ছন্ন হল? পুত্র সুযোধনের অঙ্গুলিসংকেত একমাত্র তোমার পানে। হ্যাঁ, শুধু তোমার দিকেই তার শেষ অঙ্গুলিসংকেত। তার পুত্রদের তুমি হত্যায় প্ররোচিত করেছো। ওই তরুণ নিষ্পাপ আমার দৌহিত্রগণের কি দোষ ছিল হে মাধব? লোকে বলে তুমি করুণানিধান! মিথ্যা বলে। এইসব নারীদের করুন ক্রন্দন, অশ্রুজলের ভার তুমি বহন করবে অবশিস্ট জীবন। এইসব নারীদের প্রতি এত নিষ্করুণ তুমি?
ওই দেখ হে কেশব, বিদীর্ণবক্ষ দুঃশাসন শায়িত আছে রণভুমে। ভীমের গদাঘাতে শমনসদনে যাত্রা করেছে সে। ভ্রাতা সুযোধনের ছায়াসঙ্গী ছিল সে। ভ্রাতার আজ্ঞাই ছিল তার পালনীয় ধর্ম। সে অন্যায় করেছিল পাঞ্চালীর কেশ আকর্ষণ করে, তাকে অসীম লাঞ্ছনায় বিদ্ধ করে। কিন্তু সেও তো ভ্রাতার আদেশে। ক্ষাত্রধর্মচ্যুত হয়েছিল পুত্র দুঃশাসন। সৌবল শকুনির মন্ত্রণায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে সে ঘোর অন্যায় করেছিল। বৃকোদর তার বক্ষ চূর্ণ করেছে গদাঘাতে। তাতেও শান্তি হয় নি। হে মধুহন্তারক, প্ররোচিত করেছিলে তুমি তাকে ভ্রাতার বক্ষচ্ছেদ করে রুধির পান করার! কি পাশবিক কর্ম। তবু তুমি প্রশ্রয় দিয়েছ এ হেন ঘৃণ্য পাপের! হে কেশব, ওই শোন তার দয়িতার বিলাপ, মর্মভেদী আর্তক্রন্দন। ওই দেখ দুঃশাসনের পুত্রদের শব। এই বিস্তীর্ণ রণভূমে গৃধিনীর দল ছিন্ন করছে সেই শব। ওই বালকদের কি অপরাধ ছিল হে কেশব?

ওই দেখ কৃষ্ণ! ওইখানে শায়িত আছে প্রাণপ্রিয় আমার পুত্র বিকর্ণ। তার স্বর্ণপ্রভ দেহ আজ শত নালিকাস্ত্রে বিদ্ধ। কুরুসভায় বিকর্ণ একমাত্র পাঞ্চালীর অবমাননার প্রতিবাদ করেছিল। দ্রৌপদীর স্বামীগণ নিশ্চুপ ছিল প্রস্তরবৎ। কুরুবৃদ্ধগণ মৌন ছিলেন। সেই অবমাননার কালে একমাত্র প্রতিবাদ করেছিল আমারই পুত্র বিকর্ণ। কিন্তু হে কৃষ্ণ! তাকেই মরতে হল। ওই দেখ মাতা ধরিত্রীর বুকে নতজানু হয়ে আছে তার দেহ। তুমি কৃষ্ণ, তাকেও জীবিত ছাড়লে না? কেন কৃষ্ণ? কেন এতো রক্ত পিপাসা তোমার?
ওই দেখ পদ্মপলাশলোচন! ওইখানে পড়ে আছে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের প্রিয় পুত্রগণ! দুর্মুক্ষ, চিত্রসেন, বিবিস্বতি, দশাশ্ব আর তাদের ভ্রাতাগণ। আমার একশত সন্তান। স্বাপদের দন্তুর আঘাতে ছিন্নভিন্ন তাদের দেহ। নিষ্ঠুর যুদ্ধে নিহত তাদের শবগুলি পর্যন্ত অঙ্গহীন, অসম্মানিত হয়ে পড়ে আছে শৃগালের বিচরণ ক্ষেত্রে! তাদের পুত্রগণও পিতাদের সাথে মৃত। পুত্রবধূগণ সান্ত্বনাহীনা। এই বিশাল বধ্যভূমি জুড়ে শুধুই ক্রন্দন আর শোকবিলাপের মর্মভেদী ধ্বনিতে পরিব্যপ্ত। কিন্তু হে জগন্নাথ! এ সকল দুর্মর দুর্ঘটনা তুমি রোধ করতে পারতে। কিন্তু তা তুমি কর নি!
আমি এই মৃতের প্রান্তরে বিলাপ করছি সকল সন্তানের জন্য। ওই দেখ যদুকুলচূড়ামণি, রুধিরধারায় স্নাত স্নেহের পুত্তলি সুভদ্রানন্দন অভিমন্যু। তার সোনার শরীর ভল্লের আঘাতে ছিন্নভিন্ন। রনভূমে শুয়ে আছে আমার স্নেহপুত্তলী। তার বক্ষে আছাড়ি বিছারি করছে মহারাজ বিরাটের দৌহিত্রি বালিকা উত্তরা। অকাল বৈধব্যের যাতনা কি তার প্রাপ্য ছিল? বল বাসুদেব যখন দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, জয়দ্রথ আর অশ্বত্থামা মিলিতভাবে গুপ্ত হত্যা করেছিল সুপ্ত পাঁচ পান্ডবতনকে, তখনও কি তোমার হৃদয় কেঁপে ওঠে নি? পাঞ্চালীর পঞ্চপুত্র! তখনও কি তোমার নির্বেদ তোমাকে বিবশ করেছিল? ওই দেখ যশোদানন্দন, অইখানে পড়ে আছে উত্তর, সুদক্ষিণ আর লক্ষ্মণের মৃতদেহ। কুরুবীরগণ, মহারাজ বিরাট, পাঞ্চালরাজ, যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, এমনকি স্বয়ং অর্জুন, কেউই পারে নি এইসব মৃত্যু রোধ করতে। আর তুমি, লোকে বলে তুমি অন্তর্যামী, জ্ঞানত এইসব মৃত্যু হতে দিয়েছিলে। অথচ তুমি পারতে যদুনন্দন। কিন্তু প্রচেষ্টা কর নি। রক্তের নেশা তোমাকেও উন্মাদ করে দিয়েছিল!
তুমি মৃত বৃষসেন জননীর বিলাপ শুনতে পারছ? একদিকে স্বামী কর্ণ, অন্যদিকে সন্তান বৃষসেন। স্বামীহারা পুত্রহারা রমণীর ক্রন্দন তোমাকে কি স্পর্শ করে না অমিত্রসূদন? পুত্রসম বসুসেন যখন সব্যসাচীর নিকট পরাজিত হল তোমারই কুমন্ত্রণায়, তখন কি প্রসন্নতা লাভ করেছিলে বাসব? শল্যরাজ মৃত, কাম্বোজ, বিরাট, পাঞ্চাল অগণ্য রাজা আর শমনসদনে। তোমার প্রসাদে কুরুকুল নির্বংশ হয়েছে। জম্বুদ্বীপের সমুদায় রাজন্যকুল শেষ হয়ে গেছে। এই ভাতৃঘাতী সমরে একটি যুগের সমাপ্তি হয়েছে। সকল অবলা রমণীকুল কি নিয়ে বেঁচে থাকবে, বলতে পারো হে জগন্নাথ? আর পিতামহ ভীষ্ম, পরম বৈষ্ণব গাঙ্গেয়, কুরুকুলপ্রদীপ। তিনিও চলে গেলেন মাতা গঙ্গার আশ্রয়ে। হে বৈষ্ণবহৃদয়সম্রাট, পরম বৈষ্ণব গঙ্গাপুত্রকে তুমি অসূয়া করতে! তাই ছলে তাকে হত্যা করতে তোমার হৃদয় কম্পিত হল না! এই বীর শূন্য শ্মশান প্রান্তরে কার পূজা তুমি পাবে? কে তোমায় অর্ঘ্য দেবে পুরুষোত্তমের?

আমার মন শোকে নিমজ্জিত। দুঃখে প্রস্তবৎ। এই রণাঙ্গনে, স্বাপদসঙ্কুল প্রান্তরে অগণন পুত্র, দৌহিত্র, ক্ষত্রিয়, বান্ধব, আত্মীয় শায়িত। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র ও আমি নির্বংশ হয়েছি। পিতৃপুরুষেরা জলদানে বঞ্চিত। কে আমাদের শ্রাদ্ধ করবে বাসুদেব? সন্তানের চিতায় শান্তিজল দিতে হবে এই অভাগিনী মাতাকে! এই কি তোমার বিশ্বরূপ? লোকে বলে তুমি নাকি অন্তর্যামী! তুমি জানতে এই পরিনাম। তোমার অতুল ক্ষমতা, সকলেই তোমার বান্ধব ছিল। তুমি তো পারতে কৃষ্ণ, এ যুদ্ধ নিবারণ করতে। তবু এ ধরাকে নিঃক্ষত্রিয় করলে! এর শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে হে বাসুদেব!
সাক্ষী থাকুক এই বধ্যভূমি, আদিগন্ত আকাশ, বাতাস, অন্তরীক্ষ। সাক্ষী থাকুন দেবলোক, পিতৃলোক, সপ্তর্ষি, অষ্টবসু। আমি গান্ধারতনয়া, কুরুকুলরাজ্ঞী গান্ধারী, যদি আজীবন অপাপবিদ্ধা হয়ে থাকি, যদি কণামাত্র পুণ্যলাভ করে থাকি, যদি পতিব্রতা একগামিনী হয়ে থাকি, তবে আমি তোমাকে অভিশাপ দিই, এই মুহূর্ত হতে তোমার সকল ঐশ্বরত্ব অন্তর্হৃত হোক হে মাধব। ভবিষ্যতে তুমি ধীরে ধীরে বলহীন হবে। যে অন্যায় ভাতৃঘাতী যুদ্ধে প্ররোচনা দিয়েছিলে, সেইরূপে তোমার প্রিয় যদুবংশ কুরুবংশের ন্যায় ধ্বংস হবে। যেমন তোমার কুমন্ত্রণায় অন্যায় যুদ্ধে প্রিয় সুযোধন, কর্ণ, পিতামহ ভীষ্ম আর অগণিত ক্ষত্রিয় যোদ্ধাগণ নিহত হয়েছেন, তেমনই তোমার যাদব বীরগণ শমনসদনে নিশ্চিত গমন করবেন। আমার শতপুত্র যেমন এই রণাঙ্গনে শায়িত আছে আমাদের নির্বংশ করে, তেমনি তুমিও নির্বংশ হবে। যেমন অভাগিনী কুরুকুলবধুগণ বল্লভহীনা পরাশ্রিতা হয়েছেন, তেমনি সমগ্র যাদবরমনিগণ স্বামীসন্তানহীনা অনাশ্রিতা হবেন, কেশব!
আমি অভিশাপ দিই, যেমন হস্তিনাপুর নিষ্প্রদীপ হয়ে গেছে, তেমনি দ্বারাবতী একদিন নিষ্প্রদীপ হয়ে যাবে। একদিন সমুদ্র উত্তাল হবে, আকাশ লোহিতবর্ণ, বাতাস ক্রুদ্ধ অশ্বের ন্যায় ধেয়ে আসবে দ্বারাবতীর দিকে। ক্রুদ্ধ রত্নাকর প্লাবিত করবেন তোমার সাধের দ্বারাবতী! যেমন কালান্তক যমদূতগণ ধাবিত হয়েছিল কৌরবকুলে, তেমনি বিদেশী দস্যুরা পংগপালের মত দ্বারকার প্রবেশ করবে সহস্র দ্বারপথে।
আর তুমি, হে জগন্নাথ, হে নারায়ণ, হে পদ্মপলাশলোচন, হে পুরুষোত্তম কৃষ্ণ। শ্রবণ কর জননী গান্ধারীর শেষ অভিশাপ! তোমার সকল চিহ্ন মুছে যাবে অন্তিমকালে। ওই সুদর্শন চক্র, ওই স্যমন্তক মণি, ওই কৌমুদকি গদা, ওই পাঞ্চজন্য শঙ্খ, সকলই অন্তর্হৃত হবে আকাশে। জনহীন দ্বৈপায়ন হ্রদতীরে বিশ্রামরত পুত্র আমার! সেই সুযোধনকেও তুমি হত্যা করালে অন্যায় যুদ্ধে। বৃকোদর নিমিত্তমাত্র, সত্যই হন্তারক তুমি হে যশোদানন্দন! আমি অভিশাপ দিই, তোমারও নিঃশ্রেয়স মৃত্যু হবে। নির্জন বনমাঝে। কুরুক্ষেত্রে যেমন তুমি মৃগয়া করেছ ক্ষত্রিয় বীরদের, আমার শতপুত্র, আত্মীয় দৌহিত্রদিগে, তেমনই তোমাকেও শিকার করবে কোন শিকারি লুব্ধক! তোমার অন্তিম সংস্কারের জন্য কোন উত্তরাধিকারী জীবিত থাকবে না। এই হবে তোমার পরিণতি হে কৃষ্ণ!