
সুচেতনা,
আজ সকালে অফিস যাওয়ার পথে ডাকবাক্সটা দেখে হঠাৎই চারটে লাইন মাথায় এল –
সত্যিই সে যেন বিগত জন্ম এক - যখন প্রায় নিয়মিত তুই আমায় পাঠাতিস চিঠি... আর আমিও, অনিয়মিত হলেও পাঠাতাম – তাও ঠিক চিঠি না, এলোমেলো অকবিতা। তুই সেটুকু পেতেই উদ্গ্রীব হয়ে থাকতিস... আর আমিও তোর চিঠির অপেক্ষায়। তুই এখন আর চিঠি পাঠাস না – না, ইমেল-ফোনের দোষ দিয়ে লাভ নেই কারণ আমাদের পরিচয়ই তো হয়েছিল চ্যাট-ইমেল এসবের সূত্র ধরে। তবু দুজনেরই ভাল লাগত চিঠি... আমার অবশ্য চিঠি পেতে বেশি ভাল লাগত... তোর লিখতে এবং পেতে দুটোই, আসলে তুই খুব সুন্দর গুছিয়ে চিঠি লিখতে পারিস... আমার সেই ক্ষমতা নেই – তাই অগোছালো এলোমেলো লেখার থেকে অকবিতা পাঠাতাম, কখনো কখনো কুঁড়েমির জন্যে পোস্টও করতাম না... পাঁচ-ছ’মাস পর দেখা হলে তোর হাতে গুঁজে দিতাম কয়েকটা চিরকূট। মেল অবশ্য নিয়মিত করতাম তোর চিঠির উত্তরে। তারপর আমরা যখন এক শহরের বাসিন্দা হলাম তখন তো চিঠি পাঠানো ব্যাপারটা উঠেই গেল... তবু তুই মাঝে সাঝে চিরকুট আনতিস... সেও একদিন বন্ধ হল। ফলত, চিঠি ব্যাপারটাকে আমরা আর বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না।
সেও তো প্রায় বছর তিন চার হয়ে গেল... তবু আজ ওই লাল বাক্সটা দেখে মনে হল একটা চিঠি লিখি... আর চিঠি আর কাকেই লিখি – তুই ছাড়া আর কেই বা আছে! দেখ, আবার ভুল করে ফেললাম, তুইও তো এখন আর নেই। এই সব হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক, ফোনের যুগে তোর সাথে আমার কথা বলাই মানা, তোর নতুন প্রেমিকের গোঁসা হবে আমি কথা বললে। তাই এই চিঠির অবতারণা – কারণ খুব ভাল করেই জানি, এ চিঠি আর যাই হোক তোর হাতে কোনদিন পৌঁছাবে না।
তোকে বোধ হয়, শেষ চিঠি লিখেছিলাম (যদিও তাকে চিঠি বলে না হয়ত) ‘মাধুকরী’ বইটা উপহার দেওয়ার সময়। বইটা কিনেছিলাম হাওড়া স্টেশনে, নিজের কাছে কোন কাগজ ছিল না, বইটার পিছনের মলাটের দুটো পাতায় লিখেছিলাম, স্টেশনে বসে বসেই। মনে আছে, সেদিন তোকে ‘কুর্চি’ সম্বোধন করেছিলাম – কারণ তখন আমি জানি, রুষা তার স্বামী পৃথুকে ছেড়ে চলে গেছে, যেমন তুই আমাকে – অবশ্য আমি তোর স্বামী ছিলাম না। সেদিন ঝোঁকের মাথায় কি হিসাবে কুর্চি বলেছিলাম লিখেছিলাম জানি না, কিন্তু অবচেতনে একটা ব্যাপার হয়ত কাজ করে থাকবে – ‘আমার স্ত্রী হতে যদি নাও পারিস, অন্তত কুর্চি-র মত সারা জীবন একটা আশ্রয় হয়ে থাক... যার কাছে অন্তত চুপ করেও বসে থাকতে পারব ঘন্টার পর ঘন্টা... বা লিখতে পারব খাপছাড়া দু-একটা চিঠি বা এ যুগের মেল’। ...হয়নি। তার কিছু দিন পরে পরেই স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলি, আমার আর তোর সাথে যোগাযোগ রাখা উচিৎ না।
এর প্রায় সবকিছুই তোর জানা... তুই পরবর্তী জীবনের গল্প তো তোর আরও বেশি জানা, সে তুই জানতে চাস আর নাই চাস। কারণ তুই পরবর্তী জীবন আবার সেই তুই পূর্ব জীবনের সমান। আমি আমার একলা ঘরের কোণে ল্যাপটপ, বই, খাতায় মুখ গুঁজে... হ্যাঁ, অফিস টাইমের কথা বাদ রেখেই বলছি। আমার চাকরি জীবনে ওই তুই-তুতো পাঁচ-ছ’ বছর বাদ দিলে বাকি পুরো এক ছক – অফিস-বাড়ি-ল্যাপটপ-বই-কবিতা এবং টুকিটাকি লেখালিখি – সখের। বরং ওই হ্যাপেনিং লাইফের পাঁচ-ছ’ বছরটাই আমার গল্প করার মত... আর এই বিষয়টা নিয়ে তো অন্য কারোর সাথে গল্প করা যায়ও না... তাই তোর সাথেই হোক স্মৃতি রোমন্থন – কোথাও কিছু ভুল বললে বা ভুলে গেলে ধরিয়ে দিস...জানিস, আমার জীবনের সেরা দিন সেই কুমোরটুলি যাওয়ার দিনটা... আচ্ছা, সেদিন আমাদের কোথায় যাওয়ার ছিল বল তো? কলেজস্ট্রীট? ভুলে গেছি... তবে সেদিন যে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল, আর আমরা ট্রামে চেপে পড়েছিলাম হঠাৎই, কোন গন্তব্য ছাড়াই - সেটা মনে আছে... ‘ট্রাম যদ্দুর যায় তদ্দুর যাব’ – এই বলে তো টিকিট করলাম। ট্রাম গেল শ্যামবাজার অব্দি... সেখান থেকে কোথায় যাওয়া যায় যাওয়া যায় করে কুমোরটুলি... আইডিয়াটা কার ছিল?
নিশ্চয় আমার... হে হে হে... নাহ, আমার মত নিরেট মাথায় ওই আইডিয়া আসবে না... সময়টা দুর্গাপুজোর আগে আগে ছিল বলে গোটা কুমোরটুলি জুড়ে শুধু দুর্গা আর দুর্গা... আর তুই আর আমি... কারো যেন আমাদের দিকে ভ্রূক্ষেপই নেই... আমরাও দিব্যি নিজেদের মত অলিগলি ঘুরে শেষমেশ গঙ্গার পাড়ে... বৃষ্টিটা যেন তখনই জোরে এল... তুই ছাতা বের করলি, আমার তো সেসব সঙ্গেও থাকে না ছাই... এক ছাতার তলায় দুজনেই ভিজছি – চারিদিক ঝাপসা... দূরে ঘুমটিটাও আবছা... সেই বৃষ্টির মাঝে দুজোড়া ঠোঁট এক হয়েছিল – সেটাই বোধ হয় পাব্লিক প্লেসে আমাদের প্রথম চুম্বন, তাই নয় কি? কি জানি বা!
আসলে সবই গুলিয়ে ফেলি আজকাল – স্মৃতিগুলো একটার উপর একটা চেপে গিয়ে আগে পরে ভুলিয়ে দেয়... মনে থাকে না সাল তারিখের অনুবর্তিতা – শুধু মনে হয় দিনগুলো ছিল... ছিল না, আছে। আমার আশেপাশে – নিজের মতো এক একটা দিনকে নিজের সাথে জুড়ে কাটিয়ে নিই... তোর নিস্তার নেই রে পাগলী, সে তুই যতই দূরে যা... যতই ভুলে থাক, যতই ভুলে যেতে বল... আসলে ‘যেকটা দিন তুমি ছিলে পাশে’ সেকটা দিনই তো ছিল এই ইচ্ছেমৃত জীবনের জীবন যাপন... বাকি সবই দিন গুজরান।
আচ্ছা, এসএমএসে আগে, দু-চার লাইনের কোবতে লিখলেই তোকে এসএমএস করে দিতাম, পরে আমি হারিয়ে ফেললেও তুই লিখে দিতিস আমার ডায়েরির পাতায়... সেরকমই চারটে লাইন এই কদিন আগে, বাসে যেতে যেতে মনে এল, এসএমএস এ লিখেও রাখলাম, তবে ড্রাফটে –
হ্যাঁ, স্মৃতিগুলো ধুলো ঝাড়া করতেই এরকম চিঠি লেখা... প্রথমে মিথ্যা লিখেছিলাম, মাধুকরীর মলাটে লেখা চিঠিটা তোকে লেখা আমার শেষ চিঠি নয়, তারপরে আরও অনেক লিখেছি, এরকমই – যেগুলো তোর কাছে কোনদিনই যাবে না। তবু লিখি; আর প্রতিবারই শেষ করি সেই প্রথম দিকের মত, একই রকম ভাবে – ভাল থাকিস, ভাল বাঁচিস, ভাল রাখিস...